×

অর্থনীতি

গণছাড় পেলেন ঋণখেলাপিরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ মে ২০১৯, ০১:১৭ পিএম

গণছাড় পেলেন ঋণখেলাপিরা
খেলাপি ঋণ অর্থনীতির বড় বোঝা; অর্থমন্ত্রীও ঘোষণা দিয়েছিলেন খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না। অথচ বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন আর কঠোরতা নয়, বরং বোঝা নামাতে আপসের পথেই হাঁটছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের কাছে নতি স্বীকার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালা অনুমোদন করে দেশের ঋণখেলাপিদের গণহারে ব্যাপক ছাড়ের নীতিমালা জারি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনা অনুযায়ী, ছোট, মাঝারি বা বড় সব ঋণখেলাপিই পুনঃতফসিলের সুযোগ পাবেন। ঋণখেলাপিদের আগের অনারোপিত সব সুদ মাফ করে দেয়া হবে। আগামী ১০ বছর মেয়াদের ৯ শতাংশ সুদে এই ঋণ পরিশোধের সুযোগ পাবে তারা। এদিকে নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারী ভালো গ্রাহকদের পুরস্কার হিসেবে দেয়া হবে সনদ, প্রকাশ করা হবে তাদের ছবি। পরিশোধিত সুদের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মওকুফ করা হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত পৃথক দুটি সার্কুলারি জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক এ কে এম আমজাদ হোসেন স্বাক্ষরিত এই নির্দেশনার সুবাদে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরাও এখন থেকে ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ পাবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় দেয়া এ নিয়মের ফলে খেলাপি দৃশ্যত কমবে, তবে প্রকৃত খেলাপি থেকে যাবে। যদিও তাকে আর খেলাপি বলা যাবে না। এতে করে খেলাপিদেরই উৎসাহিত করা হবে। সবাই খেলাপি হতে চাইবে। এতে করে একদিন এই ছাড় ক্যান্সার কোষের মতো পুরো ব্যাংকিং খাত ধ্বংস করবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক ডিজি এবং অর্থনীতিবিদ তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, এই ছাড়ের ফলে ঋণ সংস্কৃতি ভেঙে পড়বে। ব্যাংকিং খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভালো গ্রাহকরা ঋণ ফেরত দিতে চাইবে না। কারণ খেলাপি হলেই সুবিধা বেশি। সূত্রে জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে ওই নীতিমালা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সার্কুলারের মাধ্যমে তা নীতিমালা হিসেবে জারি করল। ‘ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা’ শীর্ষক সার্কুলারের শুরুতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণবহিভর্‚ত কারণে ব্যবসায়ী/শিল্পোদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ব্যাংকের ঋণ অনেক ক্ষেত্রেই নিয়মিতভাবে পরিশোধিত হচ্ছে না এবং সংশ্লিষ্ট ঋণ বিরূপভাবে শ্রেণিকৃত হয়ে পড়ায় ঋণ বিতরণ ও আদায় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদনশীল খাতসহ অন্যান্য খাতে স্বাভাবিক ঋণপ্রবাহ বজায় রাখাসহ ব্যাংকিং খাতের বিরূপভাবে শ্রেণিকৃত ঋণ নিয়মিত আদায়ের লক্ষ্যে কতিপয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক ঋণখেলাপিরা সুযোগ পাবেন। ছাড় গ্রহণের জন্য আগামী ৯০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১৬ আগস্টের মধ্যে খেলাপিরা আবেদন করবেন। ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে আগামী ১০ বছর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের সুযোগ পাবেন। তবে প্রথম এক বছর কোনো টাকা পরিশোধ করতে হবে না। পুনঃতফসিলকৃত ঋণের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বা ব্যাংকের কস্ট ফান্ডের সঙ্গে ৩ শতাংশ যোগ করে। খেলাপি ঋণের সুদ ব্যাংক আয় হিসেবে দেখাতে পারে না। তাই পৃথক হিসেবে রাখতে হয়। পৃথক হিসেবে রাখা সব সুদ মাফ করে দেয়া হবে। এই সুবিধা গ্রহণকারীরা ব্যাংক থেকে আবার নতুন করে ঋণ নিতে পারবেন। তবে প্রচলিত নিয়ম মেনে সতর্কতার সঙ্গে ঋণ দিতে বলা হয়েছে। নতুন ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলে পুনঃতফসিল সুবিধা বাতিল হবে। সুবিধাগ্রহণের পর নিয়মিত অর্থ পরিশোধ না করলেও তাদের খেলাপি করা যাবে না। এখানেও ছাড় দেওয়া হয়েছে। ৯টি মাসিক কিস্তির ৩টি এবং ত্রৈমাসিক ৩ কিস্তির ১টি পরিশোধ না করলেও নিয়মিত থাকা যাবে। তবে মাসিক কিস্তির মধ্যে ৬টি ও ত্রৈমাসিক কিস্তির ২টি পরিশোধ না করলে পুনঃতফসিল সুবিধা বাতিল করা হবে। স্বাধীনতার পর থেকে যারা ঋণখেলাপি, তাদের এককালীন এক্সিট সুবিধা দেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের খেলাপি ঋণের হিসাব হবে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরের এক কালীন হিসাবায়ন ভিত্তিতে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের পর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যত খেলাপি ঋণ আছে তার হিসাব করা হবে। কোনো ঋণখেলাপি যদি মনে করে এককালীন ঋণ পরিশোধ করে খেলাপির তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবেন, তাহলে সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে সার্কুলারে। এতে বলা হয়েছে, ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে ঋণখেলাপিরা ঋণ পরিশোধের জন্য এক বছর পর্যন্ত সময় পাবেন। আগের সব সুদবাবদ পাওনা মওকুফ করা হবে। এককালীন পরিশোধের জন্য সুদহার আরও কম- ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ডের সমান। তবে এক বছরের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করলে সুবিধা বাতিল হবে। এই এককালীন এক্সিট সুবিধা ও পুনঃতফসিল সুবিধা কার্যকরের ৯০ দিনের ব্যাংক ও গ্রাহকের মামলা স্থগিত করতে হবে। পরবর্তীতে গ্রাহক কোনো শর্ত ভঙ্গ করলে সুবিধা বাতিল করে মামলা পুনরায় চালু হবে। এদিকে ভালো গ্রাহকদের নতুন করে কোনো সুবিধা দেয়া হয়নি। গত ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি ভালো গ্রাহকদের প্রণোদনা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। তবে ওই নির্দেশনা বেশিরভাগই মানেনি। গতকাল আবার ওই প্রণোদনার দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কোনো গ্রাহক সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পূর্ববর্তী ৪টি ত্রৈমাসিক কিস্তি পরিশোধ করলে তিনি ভালো গ্রাহক হিসেবে বিবেচিত হবেন। তবে স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে তিনি ভালো গ্রাহক হিসেবে বিবেচিত হবেন না। বিগত এক বছর পরিশোধ করা সুদের ওপর ১০ শতাংশ ছাড় পাবেন ভালো গ্রাহকরা। বর্তমানে ঋণ নিতে গেলে ১২ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত ঋণের সুদ দিতে হচ্ছে। কোনো গ্রাহক ১৫ শতাংশ সুদে ১০০ টাকা ঋণ নিয়ে বছর শেষে ওই ১৫ টাকা পরিশোধ করলে তিনি ১০ শতাংশ ছাড় পাবেন। অর্থাৎ ১৫ টাকা সুদ পরিশোধ করা হয় সে ছাড় পাবে দেড় টাকা। অর্থাৎ ভালো গ্রাহকের সুদহার দাঁড়াবে সাড়ে ১৩ টাকা, যেখানে খেলাপিদের সুদ হবে ৯ শতাংশ। ভালো গ্রাহকদের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডেও ছাড় দিতে বলা হয়েছে। বার্ষিক রিপোর্টে তাদের ছবি প্রকাশ ও বার্ষিক সভায় তাদের সম্মাননা সনদ দিতে বলা হয় সার্কুলারে। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ৫০০ কোটির বেশি খেলাপি গ্রাহককে ছাড় দেয়া হয়। ওই সময় ১ ও ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১২ ও ১৮ বছরের জন্য প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়মিত করে নেন ১৫ গ্রাহক। পরে তাদের অনেকেই খেলাপি হয়ে গেছেন। এ ছাড়া ২০১৪ সাল থেকে বিশেষ ছাড়ে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নবায়ণ করা হয়েছে। তারা আবার খেলাপি হয়ে গেছে। ওই সুবিধা গ্রহণকারীরা আবার ছাড় সুবিধা পাচ্ছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App