মামলা বা গ্রেপ্তার নয় তার ভাবমূর্তির কথা ভাবুন
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৩ মে ২০১৯, ০৭:৩০ পিএম
বাংলাদেশের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ উন্নত দেশে প্রবেশ করার; আর বঙ্গবন্ধুকন্যার চ্যালেঞ্জ বিশ্ব নেত্রী হওয়ার। একটি দেশ শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাত ধরেই উন্নত দেশ হতে পারে না- তাকে মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং সবার বাকস্বাধীনতার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হয়। অন্যদিকে দেশ ও কাল ছাপিয়ে একজন বিশ্বনেত্রী হওয়ার জন্য তাকে মানুষের এই অধিকারগুলো স্বীকার করে নিতে হয়, নিশ্চিত করতে হয়।বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ইতোমধ্যে সুখ্যাতি হয়েছে দুনিয়াজুড়ে। পৃথিবী বুঝে নিয়েছে, তিনি মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং মনমানসিকতার মানুষ। বাংলাদেশের কোনো শত্রুও তার এই গুণের বিরুদ্ধে একটি শব্দ বলার সুযোগ পাবে না। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানের পর এমন মানবীয় গুণাবলির বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বেই। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাকে বাহবা দিয়েছেন প্রায় সব বিশ্ব নেতারা। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভালো গুণাবলি থাকার পরও প্রচলিত সামাজিক এবং আইনগত পদ্ধতির কারণে কিছু অতি উৎসাহী প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অতি সচেতন কার্যাবলি অনেক সময়ই তাকে বিব্রত করে তোলে। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু একাধারে দেশের প্রধানমন্ত্রী, আবার আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। তার কথা ও কাজ দুরকম হতে পারে। যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী তখন তিনি পুরো বাংলাদেশের এবং সব বাংলাদেশের নাগরিকের প্রধানমন্ত্রী। যখন তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী তখন তিনি শুধুই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সভানেত্রী। প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার যেটা প্রাপ্য তা হলো মানুষের ভালোবাসা। তাকে মানুষ ভালোবাসুক তেমনটাই হওয়া উচিত বাস্তবতা, কেননা তার জন্য তিনি যোগ্য। তাকে মানুষ ভয় পাবে এমনটা নয়। তিনি গণতন্ত্রী সরকারের প্রধান, কোনো সেনাশাসক নন। তার নামের সঙ্গে থাকবে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। তিনি ১৭ কোটি মানুষের ভালোবাসা নিরঙ্কুশভাবে পাবেন কিংবা সেটা আদায় করতেই হবে- এমনটা ভাবা ঠিক নয়। তাকে পছন্দ করেন অনেক মানুষ, আবার তাকে অপছন্দও করতে পারেন কিছু মানুষ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, অপছন্দ করা সেই কিছু মানুষেরও প্রধানমন্ত্রী। সেই জাদুই তিনি ছড়াতে চেষ্টা করেছেন তার রাজনৈতিক জীবনে। খুব কাছের যে ঘটনাটি সেটাই না হয় উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরি। ফিফার নির্বাচিত কাউন্সিল সদস্য, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সদস্য ও নারী ফুটবলের প্রধান মাহফুজা আক্তার কিরণ কারাগারে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার অভিযোগ করে গত ২২ মার্চ ২০১৯ তার বিরুদ্ধে ৫০ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেন ক্রীড়া সংগঠক আবু হাসান চৌধুরী (প্রিন্স)। আদালত মাহফুজা আক্তারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। বাদীর ভাষ্য অনুযায়ী ৮ মার্চ বাংলাদেশের ফুটবল ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের ক্রীড়ামোদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে কটূক্তি করেন মাহফুজা আক্তার। তিনি বলেছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফুটবলকে অবহেলা করেছেন। তিনি ফুটবল এবং ক্রিকেটের বিষয়ে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড মনোভাব পোষণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়তো জানতেই পারেননি কে তার বিরুদ্ধে কখন কী বললেন। কেউ একজন ক্ষতিপূরণের মামলা করলেন, আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেন এবং পুলিশ ত্বরিতগতিতে আসামিকে গ্রেপ্তার করে ফেললেন। যাকে নিয়ে কথা হয়েছিল, সেই প্রধানমন্ত্রী হয়তো জানতেই পারলেন না তার নাম নিয়ে কী হয়ে গেল! পঞ্চগড়ের আরেকটি ঘটনার কথা জানলাম সামাজিক যোগাযোগ এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে। এডভোকেট পলাশ কুমার রায়ের বিরুদ্ধে কোহিনুর কেমিক্যাল কোম্পানির একটি মামলা ছিল দীর্ঘদিন ধরে। মামলা প্রত্যাহার করার দাবি নিয়ে তিনি পঞ্চগড়ে একটি পথসভা করেছিলেন। সেখানে তিনি তার বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর তার রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে অশোভন কথাবার্র্তা বলেন। তার বিরুদ্ধে পঞ্চগড়ের এক ব্যক্তির মামলা দায়ের হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কটূক্তি করার জন্য। ২৬ এপ্রিল ২০১৯ তিনি গ্রেপ্তার হন। তারপর জেলখানাতেই আগুন লেগে তার মৃত্যু ঘটে। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন হাজতি পলাশ কুমার রায়। স্বজনদের দাবি- তার মৃত্যু রহস্যজনক। বিষয়টি আত্মহত্যাই হোক কিংবা তার মৃত্যু রহস্যজনকই হোক- যেহেতু তার গ্রেপ্তারটি ছিল প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার জন্য, কাজেই এ মৃত্যুটি আগামী দিনগুলোতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তিতে বিরূপ প্রভাব ফেলার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। বহুল প্রচারিত ছিল বিশিষ্ট ফটোগ্রাফার শহীদুল আলমের গ্রেপ্তারটিও। তিনি আল জাজিরা টিভির সঙ্গে বাংলাদেশে সে সময়ে সংঘটিত ছাত্র প্রটেস্ট নিয়ে কথা বলার সময় বর্তমান সরকারের এবং প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। এমন আরো অনেক ঘটনা আছে। প্রায় একই ধরনের ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী একজন মানুষ, তার অনেক ভালো কাজের মধ্যে ভুল কাজও থাকতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। যদি সব কাজই ভালো হবে, তবে তাকে কি আর মানুষ বলার সুযোগ থাকবে? মানুষ তো তিনিই- যার কাজে সুফল আসবে; যার কাজে ভালো দিক থাকবে, আবার মন্দ দিকও থাকতে পারে কিংবা কোনো কাজে সফলতা নাও আসতে পারে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও একজন মানুষ। তাকে অনেকেই পছন্দ করবেন, ভালোবাসবেন; আবার কেউ হয়তো তাকে পছন্দ করবেন না। আমাদের সংবিধান প্রত্যেকের মতামত প্রদানের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। সংবিধানের ৩৯(১) (ক) ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার থাকবে। কোনো ব্যক্তির কাছে যদি প্রধানমন্ত্রীর কোনো কাজ কিংবা অভিব্যক্তি বিতর্কিত মনে হয় এবং সেই ব্যক্তি যদি তা প্রকাশ করেন, তবে তা হবে তার ব্যক্তিগত মতামত। তার বক্তব্য খণ্ডানো যেতে পারে যুক্তি বা অন্য বক্তব্যের মাধ্যমে। কিন্তু বক্তব্য দানকারীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটলে প্রকারান্তরে তা প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তিরই ক্ষতি হয় তা বুঝার দায়িত্বটুকু তো ভক্তদের থাকতে হবে। বিরূপ ধারণার মানুষকে যুক্তি এবং ভালোবাসা দিয়ে কাছে টানার নামই তো মহান নেতৃত্ব- যে নেতৃত্ব আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে শিখেছি, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছ থেকে শিখেছি। আমি জানি না আমার লেখাটা শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে কিনা। যদি করে, তবে স্থায়ী সমাধানটা তার কাছ থেকেই আশা করব। তিনি এই অতিউৎসাহীদের মামলা করা থেকে বিরত রাখার স্থায়ী ব্যবস্থার চিন্তা করলে বিষয়টির সুরাহা হতে পারে। তা না হলে ছোট ছোট বিষয়গুলো এবং তার কোনো সম্পৃক্ততা না থাকলেও শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তির ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ উন্নত দেশে প্রবেশ করার; আর বঙ্গবন্ধুকন্যার চ্যালেঞ্জ বিশ্ব নেত্রী হওয়ার। একটি দেশ শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাত ধরেই উন্নত দেশ হতে পারে না- তাকে মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং সবার বাকস্বাধীনতার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হয়। অন্যদিকে দেশ ও কাল ছাপিয়ে একজন বিশ্বনেত্রী হওয়ার জন্য তাকে মানুষের এই অধিকারগুলো স্বীকার করে নিতে হয়, নিশ্চিত করতে হয়। কানাডার জাস্টিন ট্রুডোকে সরাসরি আক্রমণাত্মক কথা বলার পরও কিন্তু সেই বৃদ্ধ ভলান্টিয়ারকে কানাডা সরকার কিংবা কোনো ট্রুডোভক্ত তার বিরুদ্ধে মামলা দূরে থাক, তাকে কেউ গালমন্দও করেননি। কানাডা সরকার সহ্য করতে পারলে, জাস্টিন ট্রুডো সহ্য করতে পারলে বাংলাদেশ কিংবা শেখ হাসিনা নয় কেন? মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক।