×

মুক্তচিন্তা

বিরোধীরা শেখ হাসিনা বিরোধী কেউই তার বিকল্প নন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ মে ২০১৯, ০৭:৪০ পিএম

বিরোধীরা শেখ হাসিনা বিরোধী কেউই তার বিকল্প নন
বিরোধীরা শেখ হাসিনা বিরোধী কেউই তার বিকল্প নন
শেখ হাসিনা গত ৩৮ বছরে মনে হয় বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজেকে সেভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ও প্রস্তুতিতে নিয়ে এসেছেন। যে কারণে তিনি নানা জনের নানা মত ও সমালোচনার পরও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক চ্যালেঞ্জকে এগিয়ে নেয়ার অদ্বিতীয় রাষ্ট্র নায়ক রাজনীতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। মানুষতো বিকল্প দল ও নেতাকে দেখতে চায়। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতাকারী নয় বরং দেশপ্রেমিক, দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো মিশন-ভিশনের অধিকারী নেতাকে দেখতে চায়।
১৭ মে আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৮১ সালে ওই দিন তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে নিজ দেশের মাটি স্পর্শ করেন। যে মাটিতে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে তার পরিবারের সবাই পৈশাচিকভাবে নিহত হন। একইসঙ্গে তার কয়েকজন নিকটাত্মীয়ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। সেই সময় দেশে থাকলে তার ভাগ্যেও হয়তো পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো ঘাতকের বুলেটের আঘাতে মৃত্যু অবধারিত হতো। এরপর প্রায় ৬ বছর নির্বাসিত জীবন দুই বোনের। তিনি স্বামী-সন্তান নিয়ে শেষ পর্যন্ত দিল্লিতে এসে থাকলেন। আওয়ামী লীগ ১৯৮১ সালে দলের সম্মেলনে অনেকটা আকস্মিকভাবে সভাপতি নির্বাচিত করে। সেখান থেকেই তার দেশে আসার সুযোগ সৃষ্টি। এরপর রাজনীতির হাল ধরা, নিজেকে রাজনীতির একজন করে নেয়া, পিতার যোগ্য উত্তরসূরি করা, দেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পুনরুজ্জীবন ঘটানো, আওয়ামী লীগকে ইতিহাসের এই গুরুদায়িত্ব নেয়ার মতো করে গড়ে তোলা ইত্যাদি অনেক কিছুই তাকে তখন কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে। তিনি যদিও রাজনীতিতে একেবারেই নবীন নন, তারপরও আওয়ামী লীগের মতো দলে সভাপতির মতো দায়িত্ব নেয়ার চিন্তা তখনো তার থাকার কথা নয়, কিন্তু ইতিহাস তার কাঁধে তখন সেই গুরুদায়িত্বটি চাপিয়ে দিয়েছিল যেটি বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে একেবারেই ভিন্ন রকম হতো। শেখ হাসিনা পিতামাতা, ভাই, আত্মীয়স্বজনসহ অনেকের মৃত্যু শোক বুকে নিয়ে আওয়ামী লীগের মতো সংগঠনের সভাপতির যে দায়িত্ব তখন নিলেন, তখন অন্য কারো পক্ষে পিতার সেই আসনে বসার দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার ভার বহন করা সম্ভব হতো কিনা জানি না। তবে বঙ্গবন্ধুর রক্তের কণা এবং রাজনীতির ঐতিহ্য রক্তে ও মননে বহনকারী শেখ হাসিনাকে তখন এমন গুরুদায়িত্ব নিয়েই বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভালোবাসার ঋণ পরিশোধ করার সুযোগ তিনি হারাতে চাননি। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের যে পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে ফিরে এলেন, দলের দায়িত্ব নিলেন সেটি তার জন্য অনেক বড় দায়িত্ব ছিল। কিন্তু সেই দায়িত্ব হাতে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জাতীয় রাজনীতির অনেক ইস্যুই আওয়ামী লীগকে হাতে তুলে নিতে হলো। যেখান থেকে জাতীয় রাজনীতি, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক প্রস্তুতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং নেতৃত্ব দেয়ার বাস্তবতা তৈরি করা বেশ কঠিন কাজ ছিল। সেই কাজটি নানা চড়াই-উতরাই পার করে ১৯৯৬তে ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেলেন। তিনিও কিছুটা বুঝে নিতে পারলেন কিন্তু তার সেই বুঝ বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় পরিবর্তন ইত্যাদিকে একেবারে ভিন্নভাবে ১৯৯১ এবং ২০০১-এর নির্বাচনে পাল্টিয়ে দেয়া হলো। এরপর ৫ বছর আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার রাষ্ট্রীয় অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। তাকেসহ গোটা দলের নেতৃত্বকে হত্যা করে ‘দ্বিতীয় পঁচাত্তর’ সংগঠিত করার চেষ্টা করা হলো। বেঁচে গেলেন কিন্তু তিনি দমে গেলেন না। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। ২০০৮-এর নির্বাচনে তিনি জনগণের যে সমর্থন পেলেন তাকে সম্বল করে তিনি দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিলেন। একাত্তরের ঘাতকদের প্রতিশ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করলেন, বিকৃতি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে নতুন প্রজন্মকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিলেন, অর্থনৈতিকভাবে গোটা দেশটাকে স্বাবলম্বী করার রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়ন শুরু করলেন। তার এই সবকিছুকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল বিএনপি, জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে। ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল সরকার উৎখাতের। নির্বাচন বানচাল করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। এই সবকিছুকে প্রতিহত করেই ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অতিক্রম করা হলো। দেশের আবারো এক বছর পরে সরকার উৎখাতের নৈরাজ্যকর আন্দোলন করা হলো। সেটিও ব্যর্থ হলো। এরপর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, পরিকল্পনা, ভিশন-মিশন, ইত্যাদি নতুনভাবে দৃশ্যমান হতে থাকে। যত তিনি বিরোধীদের দ্বারা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হলেন তত তিনি আরো দৃঢ়তার সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উন্নয়ন যাত্রা অব্যাহত রাখার অবস্থানকে গুরুত্ব দিলেন। রাজনীতিতে তিনি ক্রমেই রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক বেশি দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্বে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকলেন। ২০১৯-এর নির্বাচনে তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত হলেন, আরো এমন কিছু নেতাসর্বস্ব দল যারা এক সময় তার সঙ্গে আওয়ামী লীগ করেছেন। তাদের কেউ কেউ প্রায় তিন দশক আগে, কেউ কেউ দেড় দশক, কেউ কেউ ৫/৬ বছর আগে তার দল ছেড়ে চলে গেছেন। এরা সবাই গত নির্বাচনের আগে হুট করে নতুনভাবে ফ্রন্ট গঠন করলেন। উদ্দেশ্য একটাই ছিল ক্ষমতা থেকে শেখ হাসিনাকে নামানো। তবে তারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে একাত্ম হলেন। এটি মোটেও আদর্শিক কোনো লড়াই ছিল না, গণতন্ত্রের তো নয়ই, সম্পূর্ণই ব্যক্তি শেখ হাসিনা বিরোধী চিন্তার প্রতিফলন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর যেসব উদ্যোগ নিলেন তা প্রশংসিত হলেও ২০০১-এর নির্বাচনে ১৯৭৫-এর ঘাতক এবং তাদের সহযোগী ও সুবিধাবাদী গোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে পরাজিত করার সব নীলনকশাই বাস্তবায়িত করেছিল গোপনে। সেটিই দৃশ্যমান হলো পরবর্তী ৫ বছরে আওয়ামী লীগের ওপর নির্যাতন এবং শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা থেকে। শুধু শেখ হাসিনাই নয়, বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর নিরাপদ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিণত করার সব আয়োজনই তখন সম্পূর্ণ করা হয়েছিল। এসব পরিকল্পনা আরো বেশি দৃশ্যমান হতো যদি ২০০৭ সালের নির্বাচনে চার দলীয় জোট বাধাহীনভাবে ক্ষমতায় ফিরে আসত। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশে শেখ হাসিনা বিপুল বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর রাজনীতির বাতাবরণে আওয়ামী বিরোধী শক্তির আরো বেশি জঙ্গিপনা, উগ্রপনা এবং শেখ হাসিনাবিরোধী রাজনীতির প্রকাশ ঘটতে থাকে। এটি ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঘুরেফিরে অব্যাহত ছিল। শেখ হাসিনা এসব প্রতিবন্ধকতা, প্রতিকূলতা এবং বিরোধিতাকে দৃঢ় হাতে পরাস্ত করার ফলে তার বিরোধীদের বড় জোটটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল হতে থাকে। কিন্তু সেই দুর্বলদের পাশে এসে যারা দাঁড়ালেন তারা কেউই শেখ হাসিনার বিকল্প হিসেবে নিজেদের রাজনীতিতে তৈরি করেননি। এর ফলে দেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া দল ও নেতাদের কথা ও কাজে কেবলই শেখ হাসিনার বিরোধিতাই দেখা যায়। কিন্তু তার বিকল্প হয়ে দাঁড়ানোর মতন কারো মধ্যেই রাজনৈতিক চিন্তা, রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে অর্থনৈতিকভাবে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তৈরি করার জায়গায় নেয়ার জন্য আদৌ ভাবনা চিন্তা করতে দেখা যাচ্ছে না। তাদের বেশিরভাগেরই গণতন্ত্রের প্রতি মায়াকান্না ও অশ্রুপাত করতে শোনা যায়। কিন্তু জামায়াত, বিএনপিসহ দেশের সাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী রাজনৈতিক দল ও শক্তি গণতন্ত্রের জন্য কতটা সহায়ক নাকি ধ্বংসকারী হতে পারে সেই সূক্ষ্ম রাজনৈতিক বিশ্লেষণ তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। মুখের কথায় বা মায়াকান্না অথবা অশ্রুপাত করে গণতন্ত্রের মানুষ হওয়া যায় না, নেতাও হওয়া যায় না, গণতন্ত্রের আদর্শকে ধারণ, বহন, গ্রহণ এবং এগিয়ে নেয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও প্রস্তুতি থাকতে হবে। শেখ হাসিনা গত ৩৮ বছরে মনে হয় বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজেকে সেভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ও প্রস্তুতিতে নিয়ে এসেছেন। যে কারণে তিনি নানা জনের নানা মত ও সমালোচনার পরও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক চ্যালেঞ্জকে এগিয়ে নেয়ার অদ্বিতীয় রাষ্ট্র নায়ক রাজনীতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। তার বিপরীতে গণতন্ত্রের মাথায় বলুন, আর আড়াই হাজার বছর পরে সক্রেটিসের আবির্ভাবেই বলুক ইত্যাদি মনগড়া অভিধা দিয়ে রাজনৈতিক বিকল্প নেতাকে জন্ম দেয়া যায় না। সেই গণতন্ত্রের মাতার শাসনকাল বাংলাদেশ দেখেছে। ২০০১, ২০০৬ শাসনকালে গণতন্ত্রের মাতাকে দেখে সক্রেটিসকে তাহলে নতুন করে বিষপান করে আত্মহত্যা করার কথাই ভাবতে হতো। এসব বানোয়াট কল্পকাহিনী দিয়ে নয় বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের শিখতে হবে কীভাবে এই দেশে বঙ্গবন্ধু তৈরি হয়েছিলেন, তাজউদ্দীন তৈরি হয়েছিলেন, ভাষাণীর মতো জনজাগরণ সৃষ্টির নেতাও তৈরি হয়েছিলেন। কিন্তু এখন যারা দেশে গণতন্ত্রের জন্য মায়া কান্নাকাটি করছেন তারা কেন শেখ হাসিনার বিকল্প হওয়ার চেষ্টা করছেন না? সেইরকম আরেকজন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা হয়ে উঠছেন না? মানুষতো বিকল্প দল ও নেতাকে দেখতে চায়। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতাকারী নয় বরং দেশপ্রেমিক, দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো মিশন-ভিশনের অধিকারী নেতাকে দেখতে চায়। শেখ হাসিনার মধ্যে তা আছে বলেই অনেক সমালোচনার পরও তিনিই এক এবং অদ্বিতীয়। মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App