×

জাতীয়

রোহিঙ্গা ঘিরে পাসপোর্ট চক্র

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ মে ২০১৯, ১১:৫৫ এএম

রোহিঙ্গা ঘিরে পাসপোর্ট চক্র
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্তে আসা রোহিঙ্গারা নানাভাবে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। এ দেশে কাজের সুযোগ না থাকায় তারা ভাগ্য বদলের আশায় দালাল চক্রের সহায়তায় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার শরণার্থী। এ জন্য অতি গোপনে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে। গত এক বছরে কুতুপালং, বালুখালী ও লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের অনেকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে গিয়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিস থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে। রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরি করে দেয়ার পেছনে ঢাকা ও বিভিন্ন পাসপোর্ট অফিসের অসাধু চক্র ও পুলিশের কতিপয় সদস্যের যোগসাজেশ রয়েছে। দালাল চক্র ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা জন্ম সনদ সংগ্রহ করে বাংলাদেশি পরিচয়ে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। এভাবে অসংখ্য রোহিঙ্গা দালালদের মধ্যস্থতায় বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ শুক্রবার ঢাকার খিলক্ষেতের একটি বাসা থেকে ২৩ রোহিঙ্গাকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ওই বাসায় মিলেছে ৫৬টি পাসপোর্ট। তবে রোহিঙ্গাদেরপাসপোর্ট তৈরির জন্য ঢাকায় আনা দালাল চক্রের মূলহোতা হাজি ইব্রাহীম খলিল ও রহিম পলাতক রয়েছে। তাদের বাড়ি চট্টগাম জেলায়। তাদের আটকের চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন গতকাল শনিবার ভোরের কাগজকে জানান, এখন শুকনা মৌসুম। বর্ষা মৌসুমে চারদিকে পানি থাকে। শুকনা মৌসুমে তারা বিভিন্ন পথে ক্যাম্প থেকে বেড়িয়ে যেতে পারে, বর্ষায় পানি থাকায় যা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, ১১ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। মূল সড়কে পুলিশের ৭টি চেকপোস্ট রয়েছে। রোহিঙ্গারা বিকল্প শুকনা সড়কে ক্যাম্পের বাইরে বের হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এখন পর্যন্ত ক্যাম্প থেকে বের হওয়া ৫৮ হাজার রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে ফেরানো হয়েছে। এত কিছুর পরও রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্পের বাইরে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়তে না পারে পুলিশ সেদিকে লক্ষ্য রাখছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পশ্চিম শাখার উপকমিশনার মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান জানান, এই চক্রের মূলহোতা হাজি ইব্রাহীম খলিল। তিনি পলাতক রয়েছেন। খলিলের জামাতা মোশারফ হোসেন শিপনকে আটক করা হয়েছে। জব্দকৃত ৫৬টি পাসপোর্ট কাদের তা জানতে তাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। খলিলকে আটক করা গেলে কিভাবে এসব পাসপোর্ট তৈরি হয়েছিল তা জানা যাবে। তার সঙ্গে রহিম নামে এক ব্যক্তি রয়েছেন। তিনিও পলাতক। রোহিঙ্গাদের সংগ্রহ করেন রহিম। এরপর পাসপোর্ট তৈরি করা হয়। মোখলেছুর রহমান বলেন, দুদিন আগে সড়ক পথে টেকনাফ ও উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী এবং লেদা ক্যাম্পের ২৩ রোহিঙ্গাকে ঢাকায় এনে খিলক্ষেতের ওই বাড়িতে জড়ো করা হয়। রোহিঙ্গারা যেখানে ছিল তার পাশের ফ্ল্যাটেই ছিল বাড়ির মালিকের ছেলে কাজল। তার তত্ত্বাবধানে সেখানেই বাংলা ভাষা ও চালচলনের ওপর প্রশিক্ষণ চলছিল। এই প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর বিভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করে তাদের নামে পাসপোর্ট তৈরির প্রক্রিয়া চলছিল। তিনি বলেন, ২৩ রোহিঙ্গার নামে কোনো পাসপোর্ট নেই। তবে উদ্ধারকৃত পাসপোর্ট কাদের তা জানার চেষ্টা চলছে। ২৩ জন রোহিঙ্গাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পুলিশের এই উপ-কমিশনার বলেন, বাড়ির কেয়ারটেকারসহ ৪ জনকে ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। উদ্ধারকৃত পাসপোর্ট যাচাই-বাছাই করতে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) পাঠানো হয়েছে। পাসপোর্টগুলো আসল না নকল এবং এসবের পুলিশি যাচাই-বাছাই (পুলিশ ভেরিফিকেশন) করা হয়েছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ঠিকানা ব্যবহার করে এসব পাসপোর্ট তৈরি হয়েছে। খিলক্ষেত থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সংঘবদ্ধ একটি দালাল চক্রের মাধ্যমে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে রাজধানীতে ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গারা। গ্রেপ্তাকৃতদের কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, তারা মালেয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছিল। এ জন্য তাদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল। তিনি বলেন, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে শুক্রবার ভোররাতে ডিবির একটি টিম খিলক্ষেতের মধ্যপাড়ার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে। মামলা দায়েরের পর ডিবির পশ্চিম টিম এর তদন্ত করছে। বিমানবন্দরের কাছাকাছি হওয়ায় এই বাড়িটি বেছে নিয়েছিল তারা। টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ প্রদীপ কুমার দাস বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্পের বাইরে বের হতে না পারে সে জন্য তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করেন। কিন্তু এরপরও দালাল ও অসাধু চক্রের সহায়তায় তারা নানা কায়দায় ক্যাম্পের বাইরে বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করে। পুলিশ প্রায়ই তাদের ধরে ক্যাম্পে ফেরত পাঠাচ্ছে। পুলিশের ১০টি টহল টিম কাজ করছে। শুকনো মৌসুম হওয়ায় পাহাড় দিয়ে পালাচ্ছে অনেক রোহিঙ্গা। উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের অন্তর্ভুক্ত কুতুপালং ও বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প। এই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গারা এখন উন্মুক্ত। তারা প্রকাশ্যে চলাফেরা করেন। চলাচলে কোনো বাধা নেই। এ ব্যাপারে উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনকে বারবার বলা হলেও কোনো উদ্যোগ নেই। রোহিঙ্গাদের এখন কক্সবাজার জেলা জুড়ে অবাধ বিচরণ। যা উদ্বেগজনক। এদিকে বালুখালী, কুতুপালং ও লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একাধিক মাঝি (দলনেতা) জানান, ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের কোনো কাজ নেই। এ দেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেক সম্পদশালীও রয়েছেন। তারা কাজ করতে চান। এই সুযোগে মালেশিয়া, সৌদী আরব, কাতার, কুয়েত এবং শ্রীলঙ্কায় ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দালাল চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বেশ কিছু রোহিঙ্গা পাসপোর্ট পাওয়ায় এবং বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ায় নতুন করে অনেকে উৎসাহিত হচ্ছেন। প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে ঢাকার বিভিন্নস্থানের ঠিকানা ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরি করা হচ্ছে। চুক্তিমতো টাকা পরিশোধের পর সড়ক পথে টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের নেয়া হচ্ছে ঢাকায়। পুলিশ ও বিজিবির চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে প্রায়দিনই রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে আসছে। পুলিশ ও বিজিবির বাধায় ক্যাম্পে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে অধিকাংশই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App