×

জাতীয়

হাসিল ও চাঁদাবাজির চালবাজি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ মে ২০১৯, ১১:১৮ এএম

হাসিল ও চাঁদাবাজির চালবাজি
রাজধানীর বাজারে গরুর মাংসের দাম নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় চলছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত দামের অতিরিক্ত টাকা নেয়ায় চলছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। অন্যদিকে, মাংসের নির্ধারিত দাম মেনে নিতে পারছেন না মাংস ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি- গাবতলী হাটে হাসিলে নয়ছয় ও চাঁদাবাজির কারণে বেশি দামে গরু কিনতে হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকনও মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য চাঁদাবাজিকে দায়ী করেছেন। তবে ইজারাদার ও পশু ব্যবসায়ীরা এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, চাহিদার তুলনায় দেশে পশু কম। গো-খাদ্যেরও দাম বেশি। পথে ঘাটে পশুবাহী ট্রাক ও ট্রলারে চাঁদাবাজি চলে। এ ছাড়া সীমান্ত বন্ধ থাকায় অবৈধভাবে কিছু গরু আসছে। এজন্য খরচও বেশি পড়ছে। সব মিলিয়ে বাজারে মাংসের দাম বেশি। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা ১৪ বছর ধরে গাবতলী পশুর হাটের ইজারাদার লুৎফর রহমান। বাংলাদেশ পশু ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচন হয় না প্রায় দুই দশক। ৬ সদস্যের এই সমিতির মহাসচিব মজিবর রহমান, বহিষ্কৃৃত (সভাপতির নামও মজিবর রহমান)। বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি ও ঢাকা মেট্রোপলিটন মাংস ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচন সর্বশেষ কবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা কারো জানা নেই। সিটি করপোরেশন নির্ধারিত দামের চেয়ে মাংসের দাম নিয়ে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব বক্তব্য রয়েছে। একজনের বক্তব্যের সঙ্গে অন্যজনের মিল নেই। পাল্টাপাল্টি অভিযোগ চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। দরবার গড়িয়েছে থানা পুলিশ ও আদালতেও। একাধিক সমঝোতা বৈঠক হলেও অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়নি। প্রকৃতপক্ষে পশুর হাটের হাসিল এবং চাঁদাবাজি নিয়ে চলছে চালবাজি। জানা গেছে, ঢাকা মহানগরী এলাকার মাংস ব্যবসায়ীদের (কসাই) পশু কেনার জন্য এখানে এক রেট আর ঢাকার বাইরের মাংস ব্যবসায়ীদের জন্য রয়েছে ভিন্ন রেট। এ ছাড়া রাখাল দিয়ে পশু কিনলে আরেক রেট। একাধিক পশু ও মাংস ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, ভারত থেকে বৈধভাবে গরু আমদানি বন্ধ রয়েছে। গত কোরবানির ঈদের পর থেকেই সীমান্ত বন্ধ রয়েছে। এখন সীমান্তরক্ষীদের যোগসাজশে কিছু গরু অবৈধভাবে আসছে। সেই হিসাবে এক জোড়া গরু সীমান্ত পার করতে ৫২ হাজার রুপি (৬৫ হাজার টাকা) গুনতে হয়। এরপর ঢাকায় আনতে ট্রাক ভাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে চাদার টাকা গুনতে হয়। এরপর গরু প্রতি কমপক্ষে ৪ হাজার টাকা করে খরচ রয়েছে। সেই হিসাব ধরে বিক্রি হচ্ছে মাংস। সীমান্ত উন্মুক্ত না হলে মাংসের দাম কমার সম্ভাবনা নেই। এ ছাড়া গাবতলীর হাটে রয়েছে চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সাভার পৌর এলাকার একজন মাংস ব্যবসায়ী জানান, হাটে মাংস ব্যবসায়ী সমিতির নেতা বারেক, শামীম ও মন্টুর সিন্ডিকেট রয়েছে। পশু ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের সঙ্গে তাদের সখ্য রয়েছে। তারা ইচ্ছেমতো হাটে খবরদারি করে। হাটে পশুর ট্রাক থামতেই তারা দরদাম নির্ধারণ করে। তাদের কারণে অনেক মাংস ব্যবসায়ী গাবতলী হাট এড়িয়ে চলছেন। এদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন গত বৃহস্পতিবার দুপুরে হাতিরপুল বাজার পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, গাবতলী হাটে চাঁদাবাজির কারণে মাংসের দাম কমছে না। চাঁদাবাজি বন্ধ করলে মাংসের দাম কমবে। বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির ১১ বছর ধরে মহাসচিব রবিউল আলম। তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি। মেয়রের বক্তব্যের জবাবে গতকাল শুক্রবার দুপুরে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, ১১ কোটি ৬০ লাখ টাকায় দেশের সর্ববৃহৎ এই পশুর হাট ইজারা হয়েছে। নিয়ম মেনে গাবতলী হাটের ইজারা হলে তা ৬০ কোটি টাকা দাঁড়াত। কাউকে টেন্ডারে অংশ নিতে দেয়া হয় না। সিন্ডিকেট করে এক ব্যক্তি একযুগ ইজারাদার। গতবছর দরপত্র ক্রয় ও জমাদানে বাধা দিলে থানায় ৪টি জিডি হয়। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের বেঁধে দেয়া তালিকা শুধু কাগজে কলমেই। মূলত মাংস ব্যবসায়ীদের নামে তারা রশিদ কাটতেই চায় না। হাসিলের নামে ইচ্ছেমতো টাকা আদায় করছে। তাদের অত্যাচারে মাংস ব্যবসায়ীরা এখন গাবতলী হাটে যেতে সাহস করেন না। হাটের ভেতরে থাকা তাদের সমিতি অফিস বন্ধ রাখা হয়েছে। সমিতির কার্যক্রমও নেই। ঢাকা মেট্রোপলিটন মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শেখ মো. আবদুল বারেক বলেন, বেশি দামে গরু কেনায় মাংসের দাম বেশি হচ্ছে। এ ছাড়া গবাদী পশুর খাবারের মূল্য বৃদ্ধিও মাংসের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, আগে সীমান্ত উন্মুক্ত ছিল। এখন সীমান্ত বলতে গেলে বন্ধ। যা কিছু হচ্ছে তা অবৈধভাবে। তাই সবমিলিয়ে দাম বেড়েছে। এ ছাড়া ট্রাক ভাড়া ও পশুবাহী ট্রাকে পথে ঘাটে চাঁদাবাজির প্রভাব পড়ছে বাজারে। এ ছাড়া গাবতলী হাটের ইজারাদার ও পশু ব্যবসায়ী চক্রের কারণে মাংসের দাম বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে গাবতলী পশুর হাটের ইজারাদার লুৎফর রহমান জানান, সিন্ডিকেট করে নয়, নিয়মিত প্রতিযোগিতা করে টানা ১৪ বছর ধরে ইজারা নিচ্ছি। এবার ১৬ কোটি টাকারও বেশি দিয়ে ইজারা নিয়েছি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র কোনো কিছু না জেনে, যাচাই না করে গাবতলী পশুর হাটে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন। মাংস ব্যবসায়ী সমিতির কথিত মহাসচিব রবিউল আলমের কথা শুনে মেয়র এমন কথা বলেছেন। বরং রবিউল আলম ও তার লোকজন হাটের পাইকারদের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকার পশু বাকিতে নিয়ে হাটের বদনাম করেছেন। এক সময়ের বিএনপির নেতা লুৎফর রহমান বলেন, সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে কখনোই বেশি টাকা হাসিল নেয়া হয়নি। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত লাইসেন্সধারী মাংস ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গরু প্রতি ১০০ টাকা, মহিষ প্রতি ১৫০ টাকা ও ছাগল ও ভেড়া প্রতি ৩৫ টাকা করে আদায় করা হয়। রাখালের মাধ্যমে গরু কেনা হলে ২০০ টাকা আর মহিষের আড়াইশ টাকা হাসিল নেয়া হয়। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শতকরা ৩ টাকা ৫০ পয়সা হারে হাসিল আদায় করা হয়। ঈদের সময় আদায় করা হয় শতকরা ৫ টাকা। তিনি জানান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে দুই দফায় করা তালিকায় ১৭৬ ও ১৩৯ জন মাংস ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আছেন ৪০৯ জন মাংস ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ পশু ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মজিবুর রহমান। তিনি ২০০০ সাল থেকে দায়িত্বে আছেন। এরপর আর কোনো কমিটি হয়নি। তিনি বলেন, কিছু মাংস ব্যবসায়ীর কারণে হাটের বদনাম হচ্ছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম মাংস ব্যবসায়ীর ‘পরিচয়পত্র’ দেয়ার নাম করে একেকজনের কাছ থেকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন। তিনি মাংস ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক হাড় ও টোপ (যা থেকে মানুষের অপারেশনের সুতা তৈরি করা হয় এবং জাপান ও ইতালিতে রপ্তানি করা হয়) নিয়ে বিদেশে রপ্তানি করছেন। মজিবর বলেন, গাবতলী হাটে এমনিতে প্রতিদিন গড়ে ৬০০ থেকে ৮০০ পশু বিক্রি হয়। তবে ঢাকার আশপাশে বেশকিছু হাট হওয়ায় এই হাটে পশু বিক্রি কমেছে। এ ছাড়া সরকারি নীতি অমান্য করে গাবতলী বেড়িবাঁধে ২৫-৩০টি গরুর ফার্ম হওয়ায় তারা সরাসরি পশু বিক্রি করছে হাসিল ছাড়া। তিনি জানান, আরিচা হাটে ৫১০ টাকা, ফরিদপুরের অরুনখোলায় ৬০০ টাকা, ধামরাই বাথুলিতে ৫০০ টাকা, কালামপুরে ৪০০ টাকা, আশুলিয়ায় ৪০০ টাকা, কেরানীগঞ্জের পাড়াগাওয়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, রাজশাহীর সিডিতে ৪৫০ টাকা, কালিয়াকৈরের কাইতলায় ৩৫০ টাকা ও বাইনাপাড়া হাটে ৪০০ টাকা করে গরু ও মহিষ প্রতি হাসিল আদায় করা হয়। যার তুলনায় গাবতলী হাটে হাসিল কম।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App