×

সাময়িকী

রবীন্দ্রনাথের ‘লোকহিত’ চিন্তা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ মে ২০১৯, ০২:৩৫ পিএম

রবীন্দ্রনাথের ‘লোকহিত’ চিন্তা
রবীন্দ্রনাথের সমাজ পরিবর্তনের ভাবনা ছিল গভীরভাবে মানবিক ও অধিকার পরিপ্রেক্ষিত-নির্ভর। জমিদারি পরিচালনার কাজে তিনি এসেছিলেন পূর্ববঙ্গে। মাটি ও মানুষের খুব কাছাকাছি এসে তিনি সমাজের নানা অসঙ্গতি ও সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব ও দুর্দশা হৃদয় দিয়ে অনুভব করার সুযোগ পান। প্রজাদের অভাব ও দুঃখ দূর করার জন্য নানা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও জীবনঘন সামাজিক সংস্কারে তিনি হাত দেন। শিলাইদহ ও পতিসরে কৃষি উন্নয়ন, কুটির শিল্পের প্রসার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, পূর্তকর্ম, স্বাস্থ্যসেবা, সালিশ বিচারসহ অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজে নিজের উদ্ভাবনীমূলক চিন্তা ও অর্থের সম্মিলন ঘটান। নিজের সন্তান, বন্ধু ও আত্মীয়দের পর্যন্ত এসব কর্মে যুক্ত করেন। এসব কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতায় শান্তিনিকেতনে শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিটি ক্ষেত্রের মূলে ছিল মানুষের সম্মিলন। মণ্ডলী, হিতৈষীসভা কিংবা সমবায় সমিতি যে নামেই জানি না কেন, প্রতিটি উদ্যোগেই ছিল মানুষের সংগঠিত প্রয়াসের প্রতিফলন। তিনি যে সাধারণের হিতাকাক্সক্ষী এবং তাদেরই একজন সে কথা বলতেও ভুল করেননি। পরিচয় কবিতায় তাই তিনি লিখেছেন, মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক আর কিছু নয়, এই হোক শেষ পরিচয়। লোকসাধারণের হিতের জন্যেই রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মানুষকে একত্র করতে চেয়েছেন। তিনি মনে করতেন মানুষ সংগঠিত হলে উন্নয়ন সহজ হয়। সেজন্যই তিনি ১৯০৪ সালে লেখা ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে ‘সমাজ’ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। শিলাইদহে সমগ্র এলাকাকে কয়েকটি মণ্ডলে ভাগ করে কবি সমবায়ভিত্তিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করেন। যদিও তা পরবর্তীতে নানা কারণে বেশি দূর এগোয়নি। পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনে গঠিত ‘শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী সমিতি’, শিলাইদহে ‘পল্লী সমিতি’, পতিসরে ‘লোকসভা’, ‘মণ্ডলী’, ও ‘হিতৈষীসভা’সহ বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এসব ভাবনা ও উদ্যোগের পেছনে রবীন্দ্রনাথের লোকসাধারণের হিতসাধনের চিন্তা ছিল একেবারেই মৌলিক ও সৃজনশীল। তাঁর সেই ভাবনার অন্তর্নিহিত সুরটি ধরতে পারলে আমাদের সমকালীন উন্নয়নভাবনাকে আরো মানবিক ও অধিকারভিত্তিক করার তাগিদ অনুভব করব বলে আমার বিশ্বাস। তাঁর ‘কালান্তর’ পর্বের ‘লোকহিত’ প্রবন্ধটি সকল অর্থেই একটি যুগান্তরী রচনা। এখানে তিনি এমন কিছু মৌলিক বিষয়ের অবতারণা করেছেন যা বর্তমানের সমাজ ভাবনাকেও সমানতালে প্রভাবান্বিত করার ক্ষমতা রাখে। আজকাল প্রতিটি রাজনৈতিক দলই জনহিতকর কাজের দীর্ঘ তালিকা দিয়ে থাকে। নির্বাচনী ইশতেহারে দলগুলো এখন আরো সুপরিকল্পিতভাবে এসব লোকহিতকর চিন্তাকে তুলে ধরে। উন্নয়নের ফর্দ এখন নির্বাচনী ইশতেহারের প্রধান অংশ। তাতে দোষের কিছু নেই। তবে এই ভাবনার মূলে যেন নাগরিক অধিকারের বিষয়টি শক্ত করে প্রোথিত থাকে সে শিক্ষাই আমরা পাই রবীন্দ্রচিন্তা থেকে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, পরের উপকার করার জন্যে প্রথমেই অধিকার অর্জন করা চাই। ‘মানুষ কোনোদিন কোনো যথার্থ হিতকে ভিক্ষারূপে গ্রহণ করিবে না, ঋণরূপেও না, কেবলমাত্র প্রাপ্য বলিয়াই গ্রহণ করিতে পারিবে।’ (লোকহিত, রবীন্দ্র রচনাবলি (রর), দ্বাদশ খণ্ড, পৃ. ৫৪৮)। এখানে ‘প্রাপ্য’ শব্দটির মধ্যেই অধিকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। তাঁর মতে লোকসাধারণকে সকল অর্থেই ছোটো জ্ঞান করে, অনুগ্রহ প্রার্থী মনে করে দৃশ্যমান হিত করার মাঝে মানুষের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষতই করা হয়। এতে করে তাদের বরং অহিতই করা হয়। যারা প্রকাশ্যে হিত করার আত্মাভিমানে মত্ত তাদের জন্যে রবীন্দ্রনাথের বার্তাটি হচ্ছে যে, ‘হিত করিবার একটিমাত্র ঈশ্বরদত্ত অধিকার আছে, সেটি প্রীতি। প্রীতির দানে কোনো অপমান নাই কিন্তু হিতৈষীতার দানে মানুষের অপমান হয়। মানুষকে সকলের চেয়ে নত করিবার উপায় তাহার হিত করা অথচ তাহাকে প্রীতি না-করা।’ (ঐ, পৃ. ৫৪৮) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমানদের ডেকেও ভালো সাড়া না পাবার প্রসঙ্গ টেনে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন যে সেটিই ছিল স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কেননা, দীর্ঘদিন উপেক্ষিত মুসলমান সমাজকে প্রীতির ডাকে সাধারণ সামাজিকতাটুকু পালন করেনি সে সময়ের সমাজের নেতৃস্থানীয়রা। হৃদয়ে আঘাতপ্রাপ্ত মুসলমানকে হঠাৎ ‘ভাই বলিয়া’ ডাকলেও প্রত্যাশিত সাড়া মেলার কথা নয় বলে তিনি লিখেছেন। এই উদাহরণ শুধু একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্যেই প্রযোজ্য নয়। সমাজ আজ যেভাবে অভিজন ও অভাজনে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তাতে আর্থ-সামাজিকভাবে উপেক্ষিত শেষাংশকে প্রীতির ডোরে বাঁধতে না পারলে তাদের জন্য বাহ্যিক হিত করার মাধ্যমে সামাজিক শান্তি বজায় রাখা বেশ কঠিনই হবে। ভদ্রলোকের মনে যতক্ষণ পর্যন্ত এই মৌলিক ব্যর্থতার চিন্তা না অনুপ্রবেশ করবে ততক্ষণ পর্যন্ত দুই বর্গের মানুষের মাঝে শান্তির সম্পর্ক স্থাপন করা নিঃসন্দেহে সহজ হবে না। প্রকৃতপক্ষে যে মানুষ অপর মানুষকে সম্মান করতে পারে না, সে মানুষকে উপকার করতে অক্ষম। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’তে লিখেছেন শিক্ষাই সবচেয়ে বড় রাস্তা যা মানুষকে সম্পূর্ণতা এনে দেয়। কেবল রাশিয়ায় নয়, মধ্য এশিয়ায়ও বন্যার বেগে বিজ্ঞানভিত্তিক মানবিক শিক্ষার বিস্তার হয়েছে। কবি ভারতবর্ষের সম্ভাবনা ও বাস্তবতার সাথে এইসব অঞ্চলের মানুষের উচ্চ মানবিক চেতনা উন্নয়নের প্রয়াসের ব্যবধান অনুভব করে আহত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আমাদের সকল সমস্যার সবচেয়ে বড়ো রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা। এতকাল সমাজের অধিকাংশ লোক শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত-ভারতবর্ষ তো প্রায় সম্পূর্ণই বঞ্চিত। এখানে (রাশিয়ায়) সেই শিক্ষা যে কী আশ্চর্য উদ্যমে সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যায় নয়, তার স¤পূর্ণতায়, তার প্রবলতায়। কোনো মানুষই যাতে নিঃসহায় ও নিষ্কর্মা হয়ে না থাকে এই জন্যে কী প্রচুর আয়োজন ও কী বিপুল উদ্যম। ...আমরা শ্রীনিকেতনে যা করতে চেয়েছি এরা সমস্ত দেশ জুড়ে প্রকৃষ্টভাবে তাই করছে। আমাদের কর্মীরা যদি কিছুদিন এখানে এসে শিক্ষা করে যেতে পারত তা হলে ভারি উপকার হতো। প্রতিদিনই আমি ভারতবর্ষের সঙ্গে এখানকার তুলনা করে দেখি আর ভাবি, কী হয়েছে আর কী হতে পারত।’ (‘রাশিয়ার চিঠি’, রর, দশম খণ্ড, পৃ. ৫৫৫-৫৫৬) আমরা যারা সুবিধেলোভী ভদ্রলোকেরা সর্বক্ষণ সুবিধেবঞ্চিতদের শুধুই দান করে, কৃপা করে মন জয় করতে আগ্রহী তাদের জন্য রবীন্দ্রনাথের ‘লোকহিত’ ভাবনাগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন মহাজন ঋণ দিয়ে সুদ গ্রহণ করে থাকে। সেই সুদ অনেক সময় আসলকেও ছাড়িয়ে যায়। সেই মহাজন যদি ঋণগ্রহিতার কাছে সুদের পাশাপাশি কৃতজ্ঞতাও আদায় করতে চায় তাহলেই মুশকিল। তাকে তিনি ‘শাইলকেরও বাড়া’ বলে মনে করেন। এরা কখনও হৃদয় দিয়ে পেছনে পড়ে থাকা মানুষগুলোকে কাছে টানেনি। তাই তাদের প্রতি কোনো বিশ্বাস নেই। সমকালীন বাংলাদেশেও আমরা এমন অসংখ্য হিতকারীদের দেখতে পাই যাদের মাঝে এ ধরনের আত্মাভিমানের বাড়াবাড়ি দেখতে পাই। এভাবে দেশহিতৈষা হয় না। দেশহিতৈষায় হিতৈষার চেয়ে দেশের অংশ যতক্ষণ বেশি না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এই সঙ্কট থাকবেই। অন্তরের একান্ত তাগিদ থেকে প্রীতির বন্ধনে যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে বাঁধতে না পারছি ততক্ষণ পর্যন্ত লোকহিতের অন্তসারশূন্যতা থেকেই যাবে। আমরা যখন লোকসাধারণের কাছে হিতসামগ্রী নিয়ে যাই তখন শুধুই তাদের বর্ধিত হাতটাই দেখতে পাই। তাদের অন্তরের দুঃখটা অনুভব করতে পারি না। হৃদয়ের আদান প্রদান নেই বলে শুধু তাদের হাতপায়ের নড়াচড়াই দেখতে পাই। সমাজ এখন ধনের নিরিখে পুরোপুরি বিভক্ত। মানুষের পেটের জ্বালা আমরা শুধু ব্যবসায়ীর চাহিদার চোখে দেখতে পাই। ধন জিনিসটাই যে অসাম্যের বাহন এটা অনেক সময় বুঝতে পারি না। ধনীর ধনই যে দারিদ্র্য সৃষ্টির প্রধানতম হাতিয়ার সে কথাটি বুঝেও না বোঝার ভান করি। ধনীর ধনেও যে গরিবের হক আছে সে কথাটিও আমরা অনেক সময়ই স্বীকার করি না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা গরিবের মনেও আয় রোজগার করে ধনার্জনের অধিকারের বিষয়টি গেঁথে দিতে পারছি ততক্ষণ পর্যন্ত হিতচিন্তার এই নেতিবাচক দিকটি থেকে আমরা মুক্তি পাব বলে মনে হয় না। বর্তমানে ধনের বৈষম্যের চাপে সাধারণ মানুষ ছটফট করছে। তাই তারা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চাচ্ছে। তারা তাই আর ভিক্ষা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়, বরং তারা এখন দাবি করে। নিতান্ত প্রাণের গরজেই তাদের মনে এই পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। তাই দয়া করে নয়, নিজের গরজেই তাদের বেঁচে থাকার সুযোগ সৃষ্টি করাই আমাদের কাজ। কেননা, তারা এখন আমাদের ভাবিয়ে তুলতে সক্ষম হয়ে উঠছে। রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ আগেই এমনটি যে হবে তার অনুমান করেছিলেন। ‘আমাদের ভদ্রসমাজ আরামে আছে, কেননা আমাদের লোকসাধারণ নিজেকে বোঝে নাই। এইজন্যই জমিদার তাহাদিগকে মারিতেছে, মহাজন তাহাদিগকে ধরিতেছে, মনিব তাহাদিগকে গালি দিতেছে, পুলিশ তাহাদিগকে শুষিতেছে, গুরুঠাকুর তাহাদের মাথায় হাত বুলাইতেছে, মোক্তার তাহাদের গাঁট কাটিতেছে, আর তাহারা কেবল সেই অদৃষ্টের নামে নালিশ করিতেছে যাহার নামে সমন-জারি করিবার জো নাই। আমরা বড়োজোর ধর্মের দোহাই দিয়া জমিদারকে বলি তোমার কর্তব্য করো, মহাজনকে বলি তোমার সুদ কমাও, পুলিশকে বলি তুমি অন্যায় করো না এমন করিয়া নিতান্ত দুর্বলভাবে কতদিন কতদিক ঠেকাইব। চালুনিতে করিয়া জল আনাইব আর বাহককে বলিব যতটা পারো তোমার হাত দিয়া ছিদ্র সামলাও সে হয় না; তাহাতে কোনো এক সময়ে এক মুহূর্তের কাজ চলে কিন্তু চিরকালের এ ব্যবস্থা নয়। সমাজে দয়ার চেয়ে দায়ের জোর বেশি।’ (লোকহিত, রর, দ্বাদশ খণ্ড, পৃ. ৫৫১) সমাজের সেই দায় নিশ্চিত করতে হলে লোকসাধারণের পরস্পরের মাঝে একটা যোগাযোগের রাস্তা চাই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সেটা যদি রাজপথ না হয় তো অন্তত গলিরাস্তা হওয়া চাই।’ আর তাঁর মতে ‘লেখাপড়া শেখাই এই রাস্তা’। এ শিক্ষা হয়তো গাঁয়ের ‘মেটে রাস্তা’। ‘কেবলই রাস্তা’। আপাতত এ-ই যথেষ্ট, কেননা এই রাস্তাটা না হইলে মানুষ আপনার কোণে বদ্ধ হইয়া থাকে। ‘সে কারণেই একটা বৃহৎ লৌকিক যোগের জন্য চাই তার অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা। মানুষ যদি মনের চালাচালি না করতে জানে, দেশের জন্য তার অনুভব কোত্থেকে আসবে? মানুষের মনকে বিস্তৃত না করা গেলে মানুষ তার অন্তরের শক্তি কোত্থেকে পাবে? এ প্রসঙ্গে তিনি ইউরোপের কথা পেড়েছেন। ওই সময় ইউরোপে প্রাথমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয় প্রসার ঘটেছিল বলেই সেখানকার সাধারণ মানুষ লিখতে পড়তে শিখে পরস্পরের কাছে পৌঁছানোর উপায় খুঁজে পেয়েছিল। তাদের হৃদয়ে হৃদয়ে গতিবিধির বাধা দূর হয়েছিল। আর এ কারণে সেখানে অধিকার সচেতন লোকসাধারণ আলাদা সত্তায় আপন শক্তিতে জেগে উঠতে পেরেছিল। রাশিয়া ভ্রমণে কবি সেখানকার শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার লোকহিতকর দিকটি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। ‘রাশিয়ার চিঠি’তে কবি এমনি একটি অনুভূতি প্রকাশ করেছেন, ‘...এদের শিক্ষা কেবল পুঁথিপড়ার শিক্ষা নয়। নিজের ব্যবহারকে চরিত্রকে একটা বৃহৎ লোকযাত্রার অনুগত করে এরা তৈরি করে তুলছে। সেই সম্বন্ধে এদের একটা পণ আছে এবং সেই পণ রক্ষায় এদের গৌরববোধ।’ (‘রাশিয়ার চিঠি’, রর, দশম খণ্ড, পৃ. ৫৭১) এই প্রসঙ্গে শান্তিনিকেতনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কবির আকাক্সক্ষার কথা প্রকাশ পেয়েছে এভাবে, ‘আমার ছেলেমেয়ে এবং শিক্ষকদের আমি অনেকবার বলেছি, লোকহিত এবং স্বায়ত্তশাসনের যে দায়িত্ববোধ আমরা সমস্ত দেশের কাছ থেকে দাবি করে থাকি শান্তিনিকেতনের ছোটো সীমার মধ্যে তারই একটি সম্পূর্ণ রূপ দিতে চাই। এখানকার ব্যবস্থা ছাত্র ও শিক্ষকদের সমবেত স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা হওয়া দরকার সেই ব্যবস্থায় যখন এখানকার সমস্ত কর্ম সুসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে তখন এইটুকুর মধ্যে আমাদের সমস্ত দেশের সমস্যার পূরণ হতে পারবে। ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে সাধারণ হিতের অনুগত করে তোলবার চর্চা রাষ্ট্রীয় বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে হতে পারে না, তার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করতে হয় সেই ক্ষেত্র আমাদের আশ্রম।’ (ঐ, পৃ. ৫৭১-৫৭২) বিশ্বায়নের প্রভাব পড়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। তাই লোকহিতকর শিক্ষার বড়োই অভাব অনুভূত হচ্ছে। শিক্ষা এখন যেন অধিকার নয়, গণ্য হচ্ছে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে। ফলে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থায় নানা ধরণের বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক বৈষম্য ও নীতিহীনতা। শিক্ষার মানের তারতম্যের কারণে এক বাংলাদেশে কয়েক বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন এই বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, আশা-আকাক্সক্ষা ভিন্নতর হতে বাধ্য। গুণগতমানের নৈতিক ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে সমাজের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। কেটে যাবে সমাজের বিদ্যমান কূপমণ্ডূকতা। রবীন্দ্রনাথের নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষা ভাবনা আমাদের সন্তানদের মনে লোকহিত চিন্তার বিকাশ ঘটাক সেই প্রত্যাশাই করছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App