×

জাতীয়

বাজারে ভেজালের রাজত্ব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ মে ২০১৯, ১১:৪৭ এএম

বাজারে ভেজালের রাজত্ব
পবিত্র এই রমজান মাসে সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতারিতে আমরা খাচ্ছি নানা ধরনের খাবার। ঘরে তৈরি খাবারের পাশাপাশি ইফতারের টেবিলে থাকে বাইরে থেকে কিনে আনা হরেক রকম মুখরোচক খাবারও। সব শ্রেণির মানুষের মধ্যেই নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাবারের আকাক্সক্ষা থাকলেও প্রতিদিনই ভেজালবিরোধী অভিযানে বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্য ধ্বংস করছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ফলে আবারো সামনে চলে এসেছে সেই প্রশ্ন কী খাচ্ছি আমরা? বাজারের বিক্রীত পণ্যের অবস্থা আসলে কেমন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, মুড়িতে দেদারসে ব্যবহার করা হচ্ছে ইউরিয়া সার। রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে জুস-শরবতে। পেঁয়াজু, বেগুনি, সবজিবড়া, বিভিন্ন কাবাব, আলুর চপে ব্যবহার করা হচ্ছে পোড়া তেল। আকর্ষণীয় করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষতিকারক সিনথেটিক রং। সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও আকর্ষণ বাড়াতে খাবারে নির্দিষ্ট মাত্রায় ফুড কালার (খাদ্যোপযোগী রং) মেশানোর অনুমোদন রয়েছে। তবে ফুড কালারের দাম বেশি হওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা এ কাজে ব্যবহার করছেন কাপড়ে ব্যবহৃত কম দামি রং। অনেক সময় ভাজার তেলে মেশানো হচ্ছে মবিলও। এতে খাবার মচমচে হচ্ছে ঠিকই, তবে বারোটা বাজছে পাকস্থলীর। শঙ্কার বিষয় হলো স্বনামধন্য ও ভরসার আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত খাদ্য ব্র্যান্ডগুলোতেও মিলছে ভেজাল। সরেজমিন অনুসন্ধানের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু রমজানকে সামনে রেখে রাজধানীসহ সারা দেশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কারখানা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে স্থাপিত এসব কারখানায় তৈরি হচ্ছে নকল ও মানহীন বাংলা সেমাই, লাচ্ছা সেমাই, নুডলস, ঘি, হলুদ, মরিচ, মসলা, বেসন, আটা, ময়দা, ভোজ্য তেল, পাউরুটি, কেক ইত্যাদি। কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর নানা উপকরণ, রাসায়নিক দ্রব্য ও রাসায়নিক রং মেশানো হচ্ছে এসব পণ্যে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে, আবার কোথাও তাদের ম্যানেজ করে, কৌশলে বাইরে তালা ঝুলিয়ে নোংরা পরিবেশে উৎপাদন করা হচ্ছে ভেজাল পণ্য। এরপর বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের লেবেল লাগিয়ে সেগুলো বাজারজাত করা হচ্ছে সারা দেশে। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) তথ্যে জানা যায়, দেশে সরকারি অনুমোদিত কারখানার চেয়ে ভেজাল পণ্য তৈরির কারখানা বহুগুণ বেশি। যারা বিভিন্ন উৎসব মৌসুমে সরব হয়ে ওঠে। পুরান ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার, বড়কাটরা, সদরঘাট, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, রহমতগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, হাজারীবাগ, কোতোয়ালি, ইসলামবাগ, বংশাল, শ্যামপুর, কদমতলী, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, সূত্রাপুর, পোস্তগোলা, ধোলাইখাল, ফরিদাবাদ, ইসলামপুর, সোয়ারীঘাট, দেবীদাস লেন, কামালবাগ, শহীদনগর, উত্তরার উত্তরখান, দক্ষিণখানে নকল কারখানার ছড়াছড়ি। টঙ্গীসহ রাজধানীর পার্শ্ববর্তী জেলার বেশ কয়েকটি স্থানে ভেজাল পণ্য তৈরির কারখানা রয়েছে। পুষ্টিবিদ তামান্না শারমিন ভোরের কাগজকে বলেন, নষ্ট বা ভেজাল যে কোনো খাদ্যই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আর এ ধরনের মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ভেজাল পণ্য দীর্ঘমেয়াদি খেলে আমাদের খাদ্যনালিতে এক ধরনের প্রলেপ সৃষ্টি করে। এর ফলে হজম সমস্যা থেকে নানা ধরনের পেটের সমস্যা হতে পারে। এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এদিকে দেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের খাদ্যপণ্যে ভেজাল থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। আদালত মন্তব্য করেছেন, ভেজালের তালিকায় রূপচাঁদা ও তীর সয়াবিন তেলসহ অনেক নামি-দামি ব্র্যান্ডের পণ্য আছে দেখছি! প্রাণ, ফ্রেশের হলুদের গুঁড়াতেও ভেজাল, তাহলে আমরা কোথায় আছি? বিএসটিআই পরীক্ষায় প্রমাণিত ৫২টি প্রতিষ্ঠানের ভেজাল ও নিম্ন মানের পণ্য জব্দ ও উৎপাদন বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের শুনানিতে গতকাল বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। অন্যদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুল্লাহ আল মামুনের নেতৃত্বে ডিবি ও ক্রাইম বিভাগের সমন্বয়ে একটি দল রাজধানীর নিউমার্কেট এবং রমনা এলাকায় অভিযান চালায়। সে সময় নিউমার্কেটের ফলপট্টি এলাকার খেুজরের মেয়াদ না থাকায় মো. সিরাজের খেজুরের দোকানকে ৫ হাজার টাকা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য প্রস্তুত ও বিক্রয় করার অভিযোগে বেইলি রোডের ফিস কেকের মালিককে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া নকল ড্রিংক পাউডার, আচার, হজমি ট্যাবলেট, আইসক্রিম ও জুস তৈরির দায়ে গতকাল রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের দুটি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দিয়েছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেই সঙ্গে তিন জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। একই অভিযানে একটি সেমাই তৈরির কারখানাকে ১ লাখ জরিমানাও করা হয়েছে। এর একদিন আগে রাজধানীর বাদামতলী ফলের আড়তে অভিযান চালায় র‌্যাব। সে সময় প্রায় কয়েক টন খেজুর জব্দ করা হয়। ভেজালবিরোধী অভিযানে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে র‌্যাব। এ বাহিনীর লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান ভোরের কাগজকে বলেন, ভেজাল পণ্যে বাজার সয়লাব তথ্যটি সঠিক নয়। তবে রোজার মাসকে কেন্দ্র করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফার আশায় এ কাজ করে। র‌্যাব সব সময়ই এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছে। শুধু রমজানেই নয়, পুরো বছরজুড়েই আমরা ভেজালরোধে কাজ করে যাচ্ছি। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে কেউই ছাড় পাবে না। আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মাঠে সরব রয়েছেন। বিএসটিআইর সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজুল ভোরের কাগজকে বলেন, ভেজাল পণ্য রোধে আমরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আমরা নিয়মিত ভেজালবিরোধী অভিযান অংশ নিচ্ছি। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মাহফুজুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, আসলে ভেজাল রোধে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আর এসব নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইনও রয়েছে। বিশেষ ক্ষেত্রে এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। তবে এসব ক্ষেত্রে সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App