×

মুক্তচিন্তা

প্রতিপক্ষ বেহাল আওয়ামী লীগ ঠিক আছে তো?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ মে ২০১৯, ০৯:৩৩ পিএম

বিএনপি যে নানা নাটকীয়তা শেষে সংসদে গিয়েছে, এটা নিশ্চয়ই একটি ইতিবাচক দিক। এখন বিএনপি সংসদে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করুক, সরকারের বিরুদ্ধে তাদের যেসব কথা আছে সেগুলো বলুক, তারা তাদের বিকল্প কর্মসূচি মানুষের কাছে তুলে ধরুক- তাহলে হয়তো ধীরে ধীরে রাজনীতির পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে। হুমকি-ধমকি দিয়ে অহেতুক হাওয়া গরম করার পথ পরিহার করতে না পারলে বিএনপির পক্ষে পায়ের তলায় মাটি পাওয়া সহজ হবে না।বিএনপি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর তেমন কোনো গণভিত্তি নেই।
আওয়ামী লীগ বর্তমানে অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এখন শেখ হাসিনার হাতে। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সরকারপ্রধান। তিনি যেমন শক্ত হাতে হাল ধরে আছেন, তেমনি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের এখন বেহাল অবস্থা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলের এতটা দুঃসহ অবস্থা আগে কখনো হয়েছিল বলে প্রবীণরাও মনে করতে পারেন না। আন্দোলন তো দূরের কথা দল-জোটের ঐক্য রক্ষা করাই এখন বিরোধী পক্ষের জন্য দুরূহ হয়ে পড়েছে। কেবল বিএনপি নয়, অন্যসব দলও আছে বড় রকমের অশান্তি, অস্বস্তিতে। বিরোধীরা কবে, কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তা অনিশ্চিত। রাজনীতি সম্পর্কে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করাও এখন কঠিন। তবে বাইরে থেকে দেখে এখন আওয়ামী লীগকে নির্ভার মনে হলেও ভেতরে ভেতরে তাদেরও আছে দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা। কথায় আছে, ‘বেশি ভালো ভালো নয়’। কখন কী ঘটে তা নিয়ে টেনশন কম নয়। আমাদের দেশের রাজনীতিতে ‘হঠাৎ’ ফ্যাক্টর একটি বড় বিষয়। অনেক সময় আগাম প্ল্যান করে যা হয় না, কখনো কখনো তা আকস্মিকভাবেই হয়ে যায়। বিরোধী দলের দিক থেকে কোনো বিপদ সংকেত না থাকায় সরকারের উচিত হবে, এই ফাঁকে তাদের ঘর গোছানোর কাজটি সম্পন্ন করা। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারাটাও ব্যবস্থাপনার একটি বড় গুণ। ¯্রােতের কারণে আওয়ামী লীগে কিছু বেনোজল ঢুকে গেছে। এগুলো ক্লিন করা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির চার এমপির শপথ গ্রহণ এবং মহাসচিবের শপথ গ্রহণ থেকে বিরত থাকার বিষয়টি নিয়ে বিএনপির ভেতরে উত্তেজনা হয়তো আছে, দলের সিনিয়র নেতারা হয়তো মন খারাপ করে আছেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে এসব নিয়ে কোনো চাপ-তাপ নেই। বিএনপি সংসদে না গেলে রাজনীতির কী ক্ষতি হতো কিংবা এখন যাওয়ায় কী লাভ হবে তা কারো কাছেই খুব স্পষ্ট নয়। গত কয়েক বছর ধরে অপরাজনীতির যে চর্চা দেশে লাগামহীনভাবে চলেছে তার পরিণতিতে রাজনীতি নিয়েই মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে অনীহা। রাজনীতি এখন মানুষের জন্য নয়। রাজনীতি হচ্ছে এখন দলের জন্য, দলের নেতাদের জন্য। ক্ষুদ্রতা এবং সংকীর্ণতা রাজনীতিকে বৃত্তবন্দি করে রেখেছে। বৃত্ত ভাঙতে সময় লাগে। ত্যাগ লাগে। সাহসও লাগে। রাজনীতিতে এখন ত্যাগ ও সাহসের আকাল চলছে। সরকার তথা আওয়ামী লীগ দেশের রাজনীতির ওপর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে। সংসদে বিরোধী দলের উপস্থিতি একেবারেই দুর্বল। গণতন্ত্রে অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন একটি বড় ব্যাপার। কিন্তু আমাদের দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা একটি ভঙ্গুর অবস্থানে এসে পৌঁছেছে বলে মনে করা হচ্ছে। নির্বাচনের নামে প্রহসনের আয়োজন দেখে সাধারণ মানুষ নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হচ্ছে। গণতান্ত্রিক শাসনে জবাবদিহিতার যে একটি ব্যাপার থাকে তা এখন আমাদের সামনে আর খুব দৃশ্যমান হয়ে উঠছে না। কারো কারো কাছে এটাকে একদলীয় শাসনের আলামত বলে মনে হচ্ছে। এই যে একটি গুমোট অবস্থা, এটা ভালো লক্ষণ নয়। তবে এটাও ঠিক, এই অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। সরকার বদলের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর আস্থা না রেখে জবরদস্তির মাধ্যমে, হত্যা-ক্যুয়ের মাধ্যমে ক্ষমতা বদল বা দখলের যে ধারা দেশে চালু করা হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতায়ই আমরা আজকের অবস্থায় এসেছি। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি চর্চায় তারা একেবারেই অভ্যস্ত নয়। বিশেষ করে সামরিক শাসনের ছাতার নিচে জন্ম নেয়া বিএনপি-জাতীয় পার্টি গণতন্ত্রের গায়ে পেরেক মেরেও যে কীভাবে মানুষের সমর্থন পায় তা এক বিস্ময়ের ব্যাপার। দেশের ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগ যে আজ অগণতান্ত্রিক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে এর জন্যও অনেকাংশে দায়ী বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। খারাপ রাজনীতির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে খারাপ প্রবণতায় আওয়ামী লীগও জড়িয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা বদলের চেয়ে আন্দোলনের নামে জবরদস্তি করে বা গায়ের জোরে সরকার ফেলে দেয়ার যে ঝোঁকে বিএনপি আচ্ছন্ন হয়েছিল বা এখনো আছে, সেটা দেশের রাজনীতির জন্য বড় বিপদ ডেকে এনেছে। বিএনপি চেয়েছে যে কোনো উপায়ে সরকার ফেলে দিয়ে নিজেরা ক্ষমতায় যেতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগকেও সাধারণ নিয়মেই যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকার জেদ পেয়ে বসেছে। এই উভয় জেদের পরিণতি আজকের অবস্থা। রাজনীতিতে আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট এখন তীব্র। কেউ কেউ আছেন যারা মনে করেন পরিস্থিতি পরিবর্তনের একক দায় সরকার ও আওয়ামী লীগের। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপিকেই আত্মশুদ্ধি করে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে আসতে হবে। তারা আর আগুন-সন্ত্রাস করবে না, তারা কোনো ধরনের সহিংসতার সঙ্গে জড়াবে না, সন্ত্রাসীদের মদদ দেবে না- এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যা, একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। বিএনপিকে একদিকে আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ততা অর্জন করতে হবে, অন্যদিকে তাদের রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তনের বিষয়টি দেশের সাধারণ মানুষের কাছেও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। এখানে ঘাটতি রেখে, খাদ রেখে বিএনপি রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি করতে পারবে না। বিএনপি যে নানা নাটকীয়তা শেষে সংসদে গিয়েছে, এটা নিশ্চয়ই একটি ইতিবাচক দিক। এখন বিএনপি সংসদে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করুক, সরকারের বিরুদ্ধে তাদের যেসব কথা আছে সেগুলো বলুক, তারা তাদের বিকল্প কর্মসূচি মানুষের কাছে তুলে ধরুক- তাহলে হয়তো ধীরে ধীরে রাজনীতির পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে। হুমকি-ধমকি দিয়ে অহেতুক হাওয়া গরম করার পথ পরিহার করতে না পারলে বিএনপির পক্ষে পায়ের তলায় মাটি পাওয়া সহজ হবে না। বিএনপি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর তেমন কোনো গণভিত্তি নেই। দল আছে অনেক, জাতীয় পর্যায়ের নেতাও আছেন অনেক, কিন্তু তাদের পেছনে নেই জনতা। জনতাকে সঙ্গে পেতে হলে তাদের হয়ে তাদের জন্য তাদের নিয়েই রাজনীতি করতে হবে। শূন্যে গদা ঘোরানোর রাজনীতি কাউকেই কোনো সুফল দেবে না। বিএনপির মিত্রহীন হওয়ার একটি আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ২০ দলীয় জোট ভাঙছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও নড়বড়ে অবস্থায়। ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে বিএনপিতে সন্দেহ-অবিশ্বাস এখন চূড়ান্ত। কামাল হোসেনের সঙ্গে জোট করে বিএনপির কোনো লাভ হয়নি, লাভ হয়েছে আওয়ামী লীগের, সরকারের- এটা বিএনপির অনেকেই বিশ্বাস করেন। কামাল হোসেনকে খুশি করতে গিয়ে বিএনপি পুরনো মিত্র ২০ দলীয় জোটকে অখুশি করতে হয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের কারণে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক শীতল হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিএনপি হয়তো ভেবেছিল যে তারা গাছেরটাও খাবে, তলারটাও কুড়াবে। ২০ দলে থেকে রক্ষণশীল, আধা রক্ষণশীলদের সমর্থন পাবে আবার ঐক্যফ্রন্টে থেকে প্রগতিশীল-সুশীল-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সব কিছুর ভাগীদার হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এবার সরকার পক্ষ, আওয়ামী লীগ ছিল অতি সতর্ক। নির্বাচনে জেতার জন্য যা যা করা দরকার তার সবই সরকার করেছে। সরকার চাইলে কী করতে পারে সে সম্পর্কে ধারণা নিতে ভুল করেছে বিএনপি। নিজেরা ক্ষমতায় থাকতে কী সব করেছে তা ভুলে গিয়ে আওয়ামী লীগের কাছে স্বচ্ছতা প্রত্যাশা করেছে। বিএনপি এবার এতদিনের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে। কথায় আছে, নিমন্ত্রণ বাড়িতে গিয়ে বড় পাতা পাতলেই বেশি খাবার পাওয়া যায় না, পরিবেশনকারীর হাতের একটি বরাদ্দ আছে। বিএনপিকে এসব বুঝতে হবে। মানুষ সব দেখছে, বুঝতেও পারছে। শেখ হাসিনায় প্রায় সব মানুষ হ্যাঁ হলেও কিছু মানুষের না-ও আছে। এই বিষয়টি বিএনপিকে মাথায় রাখতে হবে। রাজনীতিতে হারজিত আছে। বিএনপি এখন হারের মধ্যে আছে। তাকে জয়ের জায়গায় যেতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। বিভুরঞ্জন সরকার : যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App