×

জাতীয়

হাইকোর্টের নির্দেশ উপেক্ষিত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ মে ২০১৯, ১১:০১ এএম

হাইকোর্টের নির্দেশ উপেক্ষিত
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি রোধে উচ্চ আদালত থেকে দফায় দফায় নির্দেশনা ও নীতিমালা জারি করা হলেও আদতে তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। অধিকাংশ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠন করা হয়নি অভিযোগ কমিটি। থানায় চব্বিশ ঘণ্টার হটলাইন নম্বর চালু কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি টহলের ব্যবস্থাও করা হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নারীদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি থানায় অভিযোগ সেল গঠনের নির্দেশনাও মানা হচ্ছে না। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে স্বতন্ত্র আইন প্রণয়নের দাবিও দেড় দশকে বাস্তবায়ন হয়নি। আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষাসহ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের উদাসীনতার কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বাড়ছে বলে অভিযোগ নারী নেত্রীদের। ফেনীর সোনাগাজীতে যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় নিপীড়ক অধ্যক্ষের নির্দেশে গভর্নিং বডির সদস্য ও পুলিশের ইন্ধনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় সাহসী এক মাদ্রাসাছাত্রীকে। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের পর ফেনীর বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নীরব যৌন হয়রানির ঘটনা বেরিয়ে আসছে। নিপীড়নের শিকারের ভয়ে কেউ পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে, কেউবা বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। ফেনীতেই নয়, দেশের বহু এলাকায় এসব ঘটনা ঘটলেও অভিযোগ শোনার কেউ নেই। ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে প্রথমবারের মতো যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নীতিমালা, অভিযোগ ও তদন্ত সেল গঠনের দাবি উঠে। হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এতে সাড়া দিলেও কালক্ষেপণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। পরের বছরের থার্টি ফার্স্ট নাইটে ঢাবির টিএসসিতে এক তরুণীকে বিবস্ত্র করার ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠলে এ বিষয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। একই দাবিতে ২০০০ সালে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) পক্ষে জনস্বার্থমূলক রিট আবেদন করা হলে বছর ছয়েক পর হাইকোর্ট ঢাকা সিটি বিশেষ করে ঢাবি এলাকায় যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি অভিযোগ গ্রহণে থানায় ২৪ ঘণ্টা হটলাইন নম্বর চালু ও প্রতিটি কমিউনিটি এলাকায় পুলিশি টহল বাড়াতে নির্দেশ দেয়া হয়। সেই সঙ্গে জনপ্রতিনিধি ও সচেতন নাগরিকদের নিয়ে জবাবদিহিমূলক কমিটি গঠন ছাড়াও পুলিশের মধ্যে ন্যায়পালের পদ তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়। তবে নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিএনডব্লিউএলএ ২০০৮ সালে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির প্রতিরোধে নতুন করে দিক নির্দেশনা চেয়ে রিট করে। সেই রিটের বছরখানেক পর ২০০৯ সালে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ‘যৌন হয়রানি’র সংজ্ঞা নির্ধারণসহ নীতিমালা জারি করেন। যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব কর্মক্ষেত্রে একজন নারীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি ও অভিযোগ সেল গঠন করতে বলা হয়। এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল কিংবা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতাবান কারো প্রভাব না খাটানোর এবং অভিযোগ প্রমাণ হলে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়। একইসঙ্গে নীতিমালার আলোকে সংসদকে আইন প্রণয়নের নির্দেশ দেয়া হলে ২০১০ সালে আইন কমিশন ২১টি ধারা সংবলিত খসড়া আইনও তৈরি করে। একই বছরে বিএনডব্লিউএলএ আরেকটি রিট আবেদন করলে ২০১১ সালে হাইকোর্ট প্রতিটি থানায় অভিযোগ গ্রহণে পৃথক সেল গঠন ও নারী শিক্ষার্থীদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে নির্দেশ দেন। শিক্ষাঙ্গনসহ কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন রোধে কয়েক দফায় জারি করা হাইকোর্টের তিনটি নীতিমালার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠনের তাগাদা দেয়। যদিও গত এক দশকে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই কার্যকর হয়নি নির্দেশনা। আবার যেসব প্রতিষ্ঠানে কমিটি করা হয়েছে সেগুলোও অকার্যকর ও নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে। গত আট বছরে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইনও তৈরি হয়নি। এদিকে আদালতের নির্দেশনার মধ্যেই ঐতিহ্যবাহী ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক পরিমল জয়ধরের বিরুদ্ধে ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে ২০১১ সালে মামলা করা হয়। ২০১৫ সালে পরিমলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। একই বছরে বাংলা নববর্ষ পালনের দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে যৌন হয়রানির শিকার হন কয়েকজন নারী। অভিযোগ উঠে, ঘটনা জানার পরও পুলিশ ও ঢাবি প্রক্টর যথাসময়ে ব্যবস্থা নেননি। এ ঘটনার দুদিন পর হাইকোর্ট আবারো রুল দেন। এভাবে গত দেড় যুগ ধরে হাইকোর্ট দফায় দফায় নির্দেশনা ও নীতিমালা জারি করলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন বন্ধ হওয়ার পরিবর্তে বেড়েই চলেছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা পেয়ে দেশের ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩০টি এবং ৯৪টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৯টিতে যেসব অভিযোগ কমিটি করা হয়, তার বেশিরভাগই পরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। অভিযোগের তদন্ত ও প্রতিবেদন দাখিলে গড়িমসি এবং ব্যবস্থা নিতে কালক্ষেপণ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ ধামাচাপা দেয়াসহ অভিযোগকারীকে হেনস্তাও করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটিগুলোর কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চেয়ে গত বছরের ১১ মার্চ বিশ^বিদ্যালয়গুলোকে চিঠি পাঠায় ইউজিসি। কিন্তু বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় তাতে সাড়া দেয়নি। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের দুয়েকটি ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি স্কুল ও মাদ্রাসায় কোথাও কোনো কমিটি নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষকরাও এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। গত বছরে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থীই শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন রোধে কমিটি গঠনের কথা জানে না। আদালতের নির্দেশনার কথা জানেন না ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কিছুটা সচেতনতা দেখা গেলেও স্কুল বিশেষত মাদ্রাসা পর্যায়ের পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। মাধ্যমিকের বেশিরভাগ কর্তৃপক্ষই জানে না আদালতের নির্দেশনার কথা। সোনাগাজীর ঘটনায় উদ্বিগ্ন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর তাই গত ১৮ এপ্রিল দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি গঠন ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে। এ ব্যাপারে মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মান্নান ভোরের কাগজকে বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কমিটি গঠনে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। তবে এবার স্কুল পর্যায়ে কমিটি করার কথা বলা হয়েছে। একই ধরনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সফিউদ্দিন আহমদ জানালেন, মাদ্রাসাগুলোতে কমিটি গঠনের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তবে কমিটি গঠন করলেই যে সমস্যার সমাধান হচ্ছে, তা নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগ আমলে নিতে কালক্ষেপণ করছে কর্তৃপক্ষ। গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি থাকলেও তার কোনো কার্যকারিতাই নেই। দুই ছাত্রী তাদের কম্পিউটার বিভাগের প্রধানের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির যে অভিযোগ দেন, তা দুমাস ধরে ঝুলিয়ে রাখে কর্তৃপক্ষ। পরে পত্রিকায় খবর প্রকাশ ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কারণ উল্লেখ করে অভিযুক্ত শিক্ষককে সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হয়। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির প্রধান বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. মো. আব্দুুর রহিম খান ভোরের কাগজকে বলেন, আগে তো এমন অভিযোগ কেউ করেনি। তিনি জানান, ১৯ এপ্রিল প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর অভিযুক্তকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। একইভাবে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে গত অর্ধযুগেও ভিকারুননিসায় গঠিত হয়নি যৌন নিপীড়নের অভিযোগ কমিটি। বিষয়টি স্বীকার করে প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতি গোলাম আশরাফ তালুকদারের যুক্তি হচ্ছে, ছাত্রীদের সব রকম অভিযোগ শোনার জন্য আইন-শৃঙ্খলা কমিটি তো আছে। জানতে চাইলে বিএনডবিøউএলএর নির্বাহী পরিচালক এডভোকেট সালমা আলী ভোরের কাগজকে বলেন, টিএসসিতে বাঁধন নামের তরুণী লাঞ্ছিত হওয়ার পর উচ্চ আদালত থেকে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২৪ ঘণ্টার হটলাইন নম্বর চালু ও পুলিশি টহলের নির্দেশনা আসে। পরে যৌন হয়রানি ভয়াবহ আকার ধারণ করলে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই অভিযোগ কমিটি গঠনের আদেশ চাওয়া হয়। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই উচ্চ আদালত ২০০৯ সালে নীতিমালা জারি করেন এবং প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও থানায় যৌন নিপীড়ন সেল গঠনের নির্দেশনা দেন। কিন্তু সে নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে হ্রাস পায়নি যৌন নির্যাতন, বরং দিন দিন তা মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এর কারণ হিসেবে সালমা আলী বলেন, প্রবল পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি আর প্রশাসনিক অস্বচ্ছতার কারণে যৌন হয়রানি বন্ধ করা যাচ্ছে না। যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে আইন প্রয়োগে আরো কঠোর হতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App