×

মুক্তচিন্তা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসাম্প্রদায়িক চেতনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ মে ২০১৯, ০৮:২৩ পিএম

রবীন্দ্রনাথ ‘মানুষ’ বলতে মানুষই বুঝেছেন, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান বোঝেননি। এ কারণেই তার কবিতায় বারবার ‘মানুষ’ শব্দটি ঘুরে ঘুরে এসেছে। রবীন্দ্রনাথের অসাম্প্রদায়িক চেতনার পেছনে আরেকটি মতবাদ কাজ করেছে যার নাম ‘সর্বপ্রাণবাদ’। পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাখো কোটি প্রাণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রাণের যোগ অনুভব করতেন।

বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শব্দশিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী ও বিরাগী- সবাই এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, রবি প্রতিভার চোখ ধাঁধানো দীপ্তির কাছে বাংলার অন্য কথাশিল্পীরা অনেকটাই স্বল্পালোক। বিশেষ করে গীতিকার ও সুরস্রষ্টা হিসেবে তার তুলনা তিনি নিজেই। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষরা ব্রাহ্মণ হলেও রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম ছিলেন। রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ‘ব্রাহ্মধর্ম’ উদার এবং মানবিকবোধ সম্পন্ন ছিল। সুতরাং ধর্মীয়ভাবে একেশ্বরবাদী রবীন্দ্রনাথ অনেকটাই ইসলাম ধর্মের কাছাকাছি ছিলেন। যার ফলে রবীন্দ্রচিন্তা ও সৃজনকর্ম হিন্দু-ব্রাহ্ম-মুসলিমদের তো আকৃষ্ট করেছেই বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরাও তার সাহিত্যপ্রসাদ অবলীলায় হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেন। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন গ্রন্থ ‘চর্যাপদ’- যেটি আবিষ্কার করেছিলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। সেই গ্রন্থেও আমরা অসাম্প্রদায়িক সমাজের ছবি পাই। চর্যাপদের রহস্যময় ভাষার পরতে পরতে ২৩ জন চর্যাকার অসাম্প্রদায়িক চেতনার বীজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছেন।

চর্যাপদের পরে যদি আমরা মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যে প্রবেশ করি, তাহলে দেখবো- মধ্যযুগের ছয়শ বছর শুধু হিন্দু দেবদেবীর মাহাত্ম্য কীর্তনই হয়নি- সেখানে বৈষ্ণব কবিকুল কী বিস্ময়কর ভাষায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার পাশাপাশি মানুষের মহিমা ঘোষণা করেছেন। চণ্ডীদাসের : ‘শুনহ মানুষ ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই’- এই অসামান্য পঙ্ক্তির ভেতরে মানবমহিমা পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে ধরা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তার অনন্যসাধারণ অসাম্প্রদায়িক চৈতন্যের জন্য প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগের কবিদের কাছে বিপুলভাবে ঋণী। রবীন্দ্রনাথের অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্বরূপ বুঝতে গেলে এ বিষয় দুটি আমাদের মাথায় রাখতেই হবে।

রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন উনিশ শতকের ষাটের দশকের শুরুতে। উনিশ শতক বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কালের সূচনাবিন্দু। সেই হিসেবে রবীন্দ্রনাথ আধুনিককালের কবি বটে, তবে মানসিকভাবে তিনি ছিলেন অসম্ভব রোম্যান্টিক। তিনি রোম্যান্টিক কবি হিসেবেই বাংলা সাহিত্যে স্বীকৃত। তাঁর আগে মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) যদিও আধুনিকতার সব লক্ষণ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু তিনি মাইকেলের দেখানো পথে এক কদমও হাঁটেননি। রবীন্দ্রনাথ মাইকেলের কঠিন সমালোচক ছিলেন এ কথা সত্য, কিন্তু মাইকেলের প্রতিভাকে তিনি চিরদিনই যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে মধ্যবিন্দুতে রেখে যদি আমরা তার দুই পাশে মাইকেল ও কাজী নজরুল ইসলামকে (১৮৯৯-১৯৭৬) রাখি তাহলে রবীন্দ্রনাথের অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটা তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সিদ্ধান্ত হবে এরকম- মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে অর্থে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সেই অর্থে অসাম্প্রদায়িক নন- তার অসাম্প্রদায়িকতা একটু ভিন্নরকম, সেটাকে আমরা এক কথায় উপনিবেশদের অসাম্প্রদায়িকতা বলতে পারি। আবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যদি আমরা রবীন্দ্র সমসাময়িক কবি কাজী নজরুল ইসলামের অসাম্প্রদায়িকতার তুলনাচিত্র আঁকি, তাহলে দেখব- নজরুল অনেক বেশি উচ্চকণ্ঠ এবং স্পষ্টভাষী। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা কড়া, ঝাঁঝালো, তীব্রতম। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ফারাক আপাতদৃষ্টিতে আকাশ-পাতাল হলেও মূল জায়গায় দুজনেই এক ও অভিন্ন।

সর্বহারা নজরুল যেভাবে খোলাখুলি ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন- রবীন্দ্রনাথ সেক্ষেত্রে যথেষ্ট সংযমী ছিলেন। অবশ্য রবীন্দ্র সাহিত্যের সৌন্দর্যের যে জায়গা, সেটা মূলত সংযমই। সংযমই সুন্দর। সংযমই স্থায়ী। সমগ্র রবীন্দ্র-সাহিত্য পাঠ করলে এ কথাটাই ঘুরেফিরে আমাদের সামনে হাজির হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন/সকল মন্দিরের বাহিরে/আমার পূজা আজ সমাপ্ত হল/দেবলোক থেকে/ মানবলোকে’- এই যে হরিজন বা প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে নিজেকে এক করে মেলাবার প্রয়াস এটা কি সামান্য কথা? রবীন্দ্রনাথ ‘মানুষ’ বলতে মানুষই বুঝেছেন, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান বোঝেননি। এ কারণেই তার কবিতায় বারবার ‘মানুষ’ শব্দটি ঘুরে ঘুরে এসেছে। তিনি যখন বলেন- ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’- এখানেও গোত্রবর্ণহীন মানুষের কথাই তিনি বলেছেন। কোনো কোনো রবীন্দ্র-গবেষক অবশ্য বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের ‘মানুষ তত্ত্ব’ বাউলের কাছ থেকে পাওয়া। এমনটা হতেই পারে। এতে রবীন্দ্রনাথের মর্যাদা কমে না বরং তিনি সম্মানিত হন। রবীন্দ্রনাথ বাংলার বাউলের কাছে ঋণী বটে, কিন্তু বাংলার বাউল ও বাউল দর্শনকে কি তিনি কম ঋণ দিয়েছেন? বিশ্বের মাঝে বাংলার বাউলকে পৌঁছে দেয়ার গুরুদায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। সুতরাং ঐতিহ্যগত সূত্রে প্রাপ্ত কোনো দর্শনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সবার জন্য সম্ভব হয় না- রবীন্দ্রনাথ সেটা পেরেছিলেন। নজরুল সমর্পিত ছিলেন মার্কসবাদের পতাকাতলে। ভারতের অনেক বিপ্লবী, কমরেড তার সুহৃদ ছিলেন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো- ‘অসাম্প্রদায়িকতা’। নজরুল রাজনৈতিকভাবে সমাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন বলেই তার অসাম্প্রদায়িক চেতনা দুন্দুভির শব্দের মতোই কর্ণভেদী। রবীন্দ্রনাথ মার্কসবাদী ছিলেন না। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী না হয়েও তিনি হৃদয়বৃত্তির তাগিদে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন।

অনেকেই বলার চেষ্টা করেন- রবীন্দ্রনাথ মুসলমান বিরাগী ছিলেন। প্রমাণ হিসেবে তারা উত্থাপন করতে চান রবীন্দ্র-রচনায় মুসলমান সমাজের ও মুসলমান চরিত্রের অপ্রতুলতা। অনেকে এমনও বলতে চান- রবীন্দ্রনাথ অনেকটা ইচ্ছে করেই মুসলমানদের এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু যদি আমরা একটু পিছন ফিরে তাকাই তাহলে দেখবো, রাজা রামমোহন রায় ভারতবর্ষের মুসলিমদের পক্ষে তেমন কোনো কাজই করেননি। যদিও রামমোহনের ‘রাজা’ উপাধি মুসলিম স¤্রাট কর্তৃক প্রদত্ত। রাজা রামমোহনের পরেই শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয় ‘দয়ার সাগর’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও কিন্তু মুসলিম সমাজের পক্ষে কখনো কলম ধরেননি, তার লেখায় মুসলিমরা হাজির না থাকলেও মহাজাতি ভারতবাসীর জন্য তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক মন্ত্র উচ্চারণের সংগ্রামী ঋত্বিক। সুতরাং এ কথা আমরা বলতেই পারি- চরিত্র হাজির না করেও যে চরিত্রের প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতা পোষণ করা যায়, রামমোহন, বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথ তার ঝলমলে উদাহরণ।

রবীন্দ্রনাথের অসাম্প্রদায়িক চেতনার পেছনে আরেকটি মতবাদ কাজ করেছে যার নাম ‘সর্বপ্রাণবাদ’। সবখানেই প্রাণ আছে, সব প্রাণেই সুখ-দুঃখের অনুভূতি আছে। পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাখো কোটি প্রাণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রাণের যোগ অনুভব করতেন। কিন্তু ধর্মের মোহ এসে সাধারণ মানুষকে এই সত্যটুকু উপলব্ধি করতে দেয় না, তাই তিনি কড়া ভাষায় ধর্ম ও ধার্মিকের বিরুদ্ধে বলেন- ‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে। অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।/নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর,/ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।/শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো/শাস্ত্রে মানে না, মানে মানুষের ভালো।’ রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন ‘বিধর্ম’ বলে এক ধর্মের লোক যখন আরেক ধর্মের মানুষকে হত্যা করে সে তখন আপন ধর্মেরই অপমান করে। পূজাগৃহে যারা রক্তমাখানো ধ্বজা তুলে ধরে- তারা মূলত দেবতার নামে শয়তানেরই পূজা করে।

১৩৭৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের একটি লেখায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘আমি হিন্দু’ ‘আমি মুসলমান’ এ কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। কিন্তু ‘আমি মানুষ’ এ কথা কাহাকেও বলতে শুনি না। যারা মানুষ নয়, তারা হিন্দু হোক আর মুসলমান হোক, তাদের দিয়ে জগতের কোনো লাভ নেই।’ মানুষ যতক্ষণ না জাত-গোত্র বিসর্জন দিয়ে মানুষ পরিচয়ে পরিচিত হবে ততক্ষণ পৃথিবীর মঙ্গলসাধন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের অসাম্প্রদায়িকতার মূল দর্শন এটাই। সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে ভ্রাতৃত্ববোধে বিশ্বকে আলিঙ্গন করার আহ্বানের ভেতরেই রবীন্দ্রনাথের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বীজ প্রোথিত। কবিগুরুর ১৮৫তম জন্মদিনে তাকে বিনম্রচিত্তে শ্রদ্ধা জানাই।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App