×

মুক্তচিন্তা

শক্তিশালী বিরোধী দলের অপেক্ষায়...

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ মে ২০১৯, ০৯:২৯ পিএম

সরকারের আনুকূল্য বা বদান্যতায় কোনো দেশেই বিরোধী দল তৈরি বা প্রতিষ্ঠিত হয় না। বিরোধী দলকে নিজের জোরেই পায়ের নিচে মাটি জোগাড় করতে হবে। পৃথিবীর কোনো দেশেই কি সরকার বিরোধী দলকে কোল পেতে দেয়? ভুল রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল গ্রহণ করে বিএনপি গত কয়েক বছরে নাজুক অবস্থায় চলে এসেছে। দেশে সত্যি সত্যি শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাব তীব্র হয়ে উঠছে। কিন্তু সে অভাব দূর হবে কীভাবে তা বোঝা যাচ্ছে না। সরকারি দলের একচ্ছত্র দাপট গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়েই থাকছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন লন্ডনে আছেন। তিনি এক ‘সরকারি’ সফরে লন্ডনে গিয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। লন্ডনে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে বলেছেন, আমরা সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল দেখতে চেয়েছিলাম। গণতন্ত্রের মজবুত ভিতের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দলের প্রয়োজন। কিন্তু বিএনপির হঠকারিতা ও নেতৃত্বের দেউলিয়াত্বের কারণে আজ তাদের এই পরিণতি। গত নির্বাচনে বিএনপির পরিণতির জন্য তারাই দায়ী। প্রথমে তারা ৩০০ আসনে ৬০০-এর বেশি দলীয় প্রার্থী বানিয়ে মনোনয়ন বাণিজ্য করেছে। লন্ডনে এবং দুবাইতে তারা মনোনয়নের টাকা লেনদেন করেছে। বাংলাদেশে তাদের নেতারা লাখ লাখ টাকা মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। প্রথমত, বিরোধী দলের দুর্বল অবস্থান ভালো গণতন্ত্রের জন্য কাক্সিক্ষত নয়। শক্তিশালী বিরোধী দল গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করে বলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি চেয়েছিলেন। কিন্তু দেশে যে শক্তিশালী বিরোধী দল নেই তার জন্যও বিএনপিকেই দায়ী করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বিএনপির হঠকারিতা এবং নেতৃত্বের দেউলিয়াপনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, নির্বাচনে ব্যাপক মনোনয়ন বাণিজ্য করে বিএনপি নিজের কবর নিজেই খুঁড়েছে। বিএনপি এখন দেশে প্রায় অস্তিত্বহীন পার্টিতে পরিণত হয়ে পড়েছে। সরকারকে ‘ছলে-বলে-কৌশলে’ চাপে ফেলতে গিয়ে বিএনপি এখন নিজেই বড় রকম চাপের মুখে আছে। দেশের রাজনীতিতে এক জটিল অবস্থা তৈরি হয়েছে। সরকার আছে চাপমুক্ত ও সুবিধাজনক অবস্থায়, অন্যদিকে বিরোধী মহলে চলছে নানাবিধ সংকট। অবশ্য ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর’- নীতি অনুযায়ী রাজনীতির চলমান অস্থিরতার জন্যও সরকারকেই দায়ী করা হচ্ছে। রাজনীতিতে যা কিছু ঘটছে, সব কিছুর পেছনেই খোঁজা হচ্ছে সরকারের হাত। সরকারবিরোধী ২০-দলীয় জোট নিষ্ক্রিয়। এর জন্য দায়ী কে? জবাব : সরকার। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অভ্যন্তরে সমস্যা বাড়ছে। কেন? সরকার কলকাঠি নাড়ছে। গণফোরামের দুই এমপি দলীয় সিদ্ধান্ত না মেনে শপথগ্রহণ করল কেন? সরকারের চাপে। বিএনপির এক এমপি বাদে বাকি পাঁচ এমপি শপথ নিলেন, কারণ কী? সরকারি চাপ। জামায়াতের সংস্কারপন্থি বলে পরিচিতরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার পেছনেও আছে সরকারের হাত।

সরকার এখন সর্বশক্তির অধিকারী। অবস্থা দেখে মনে হয়, বিরোধী দলগুলোও চলছে সরকারের অঙ্গুলি হেলনে। আসলে কি তাই? সরকার কি বিরোধী দলে গৃহদাহ উসকে দিতে কোনো ভূমিকা পালন করছে? সরকার বা আওয়ামী লীগ কি তাদের বিরোধী শক্তিকে দুর্বল করার জন্য নেপথ্যে সত্যি কোনো কলকাঠি নাড়ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। তবে রাজনীতি যেহেতু প্রধানত একটি কৌশলের খেলা সেহেতু সরকার যদি তার প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার কোনো কৌশলের সফল প্রয়োগ করে থাকে তা হলে তো সরকারকে দোষ দেয়া যাবে না। সরকারের আনুকূল্য বা বদান্যতায় কোনো দেশেই বিরোধী দল তৈরি বা প্রতিষ্ঠিত হয় না। বাংলাদেশেও সেটা হয়নি, হবেও না। বিরোধী দলকে নিজের জোরেই পায়ের নিচে মাটি জোগাড় করতে হবে। মাটি কামড়ে পড়ে থাকার নীতি নিতে হবে। আমাদের দেশে বিরোধী দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত অভিযোগ করে চলেছে যে, সরকারের দমন-পীড়নের জন্য তারা কাজ করতে পারছে না, মাঠে নামতে পারছে না। পৃথিবীর কোনো দেশেই কি সরকার বিরোধী দলকে কোল পেতে দেয়?

বিএনপি নেতারা ইদানীং বলতে শুরু করেছেন, সরকার নাকি বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমি কোনো দল ভাঙার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। কোনো দল ভাঙা বা অন্য কিছু করার নীতিতে যাব কেন? যার যার দল সেই করুক। আওয়ামী লীগে অনেক লোকবল ও জনসমর্থন রয়েছে। অন্যের ভার নিতে যাব কেন?’

প্রধানমন্ত্রী দল ভাঙার রাজনীতি না করার কথা বললেও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সাম্প্রতিক সময়ে নানা ধরনের গৃহবিবাদ মাথাচাড়া দিতে দেখা যাচ্ছে তাতে সরকারের কোনো ইন্ধন একেবারেই নেই তা হয়তো বলা যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে সংকট, টানাপড়েন এখন কিছুটা বেশি। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও আস্থা-বিশ্বাসের সংকট অতীতের যে কোনো সময় থেকে এখন বেশি।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতিতে পাল্লা দেয়ার মতো দল হলো বিএনপি। কিন্তু ভুল রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল গ্রহণ করে বিএনপি গত কয়েক বছরে নাজুক অবস্থায় চলে এসেছে। বিএনপি ক্ষমতায় থেকে জন্ম নেয়া দল। মাছ যেমন পানি ছাড়া বাঁচে না, বিএনপিও তেমনি ক্ষমতা ছাড়া টিকতে পারে না। অথচ গত প্রায় এক যুগ ধরে দলটি আছে ক্ষমতা থেকে দূরে, এমনকি সংসদেরও বাইরে। বিএনপির কার্যক্রম দিন দিন সীমিত হয়ে পড়ছে। দলের প্রধান দুই স্তম্ভ খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের দীর্ঘ টানা অনুপস্থিতি বিএনপিকে কাহিল করে ফেলছে। দল কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। দলের সিনিয়র নেতারাও নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারেন না। তাদের মতামতের তেমন গুরুত্ব নেই। ভোটের রাজনীতি, জোটের রাজনীতি কোনোটাতেই জোরালো অবস্থান রাখার সুযোগ এখন বিএনপির নেই। বর্তমান সংসদ নিয়ে বিএনপির অবস্থান ও মূল্যায়ন দলটির জনবিচ্ছিন্নতাই কেবল বাড়াচ্ছে। নির্বাচিত এমপিদের বেশিরভাগ যদি সংসদে যোগ দেন এবং দল তাদের বহিষ্কার করে, তা হলে বিএনপির সংকট আরো বাড়বে। সামগ্রিক বিশ্লেষণে এটা বলা যায় যে, বিএনপিকে বাইরের কারো ভাঙার প্রয়োজন নেই। দলটি এমনিতেই নিঃশেষ হতে বসেছে। সর্বশেষ সংসদে যাওয়া না-যাওয়া নিয়ে বিএনপিতে যে নাটকীয়তা ও সংকট তৈরি হয়েছে তা দলটিকে কোন পরিণতির দিকে নিয়ে যায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

বিএনপির ঘনিষ্ঠ মিত্র জামায়াতে ইসলামীও রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা অবস্থায় আছে। জামায়াতের একটি সংস্কারকামী অংশ নতুন নামে রাজনীতিতে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করছে। জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত, সাবেক শিবির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু ‘জনআকাক্সক্ষার বাংলাদেশ’ নামের একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। জামায়াতের একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে দলের মধ্যে কিছু ভিন্নমত থাকলেও তা খুব প্রবল নয়। যারা নতুন দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন তারা তাদের পক্ষে মূল জামায়াতের কতটুকু সমর্থন আদায় করতে পারবেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। তারা কোন জনআকাক্সক্ষা পূরণ করতে চান তাও দেখার বিষয়। জামায়াতের যে বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য সেটা যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে তাদেরই চালকের আসনে থাকার কথা। নব্য জামায়াতিদের ব্যাপারে গণমাধ্যম যতটা আগ্রহ দেখাচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও আছে বলে মনে হয় না।

ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের মধ্যেও চলছে অস্থিরতা। নির্বাচনের আগে বিএনপিকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে রাজনীতির ব্যাপক প্রচার পেয়েছেন ড. কামাল হোসেন। বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করলে ক্ষমতায় যাওয়া সহজ হবে বলে হয়তো কোনো মহল থেকে কামাল হোসেনদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতি কোনো সময় সহজ-সরল পথ ধরে অগ্রসর হয় না। নানা জটিল সমীকরণে কামাল হোসেন এবং বিএনপির সাধ পূরণ হয়নি। উল্টো কামাল হোসেনের দল গণফোরাম এখন গভীর সংকটের মুখে। কামাল হোসেনের নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ। গণফোরামের দুই এমপি দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নিয়েছেন। আট বছর পর গত ২৬ এপ্রিল দলের কাউন্সিল অধিবেশন করা হলেও দলের নেতৃত্ব নির্বাচনে ব্যর্থ হয়েছেন কামাল হোসেন। নতুন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন ড. কামাল হোসেন। গণফোরামের মতো একটি নেতাসর্বস্ব দলেও আবার ভাঙনের আলামত লক্ষ করা যাচ্ছে। দলের কাউন্সিল হলো আট বছর পর। অথচ সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু কাউন্সিলে অনুপস্থিত থাকলেন। সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন মুখ আনার কথা নাকি ভাবছিলেন ড. কামাল হোসেন। তাতেই বিপত্তি। ফলে নতুন কমিটি ছাড়াই শেষ হয়েছে গণফোরামের কাউন্সিল। দেশে সত্যি সত্যি শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাব তীব্র হয়ে উঠছে। কিন্তু সে অভাব দূর হবে কীভাবে তা বোঝা যাচ্ছে না। সরকারি দলের একচ্ছত্র দাপট গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়েই থাকছে।

বিভুরঞ্জন সরকার : কলাম লেখক ও সাংবাদিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App