×

জাতীয়

আগে কোনো ডরই ছিল না, এখন বৃষ্টিরে ডরাই!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ মে ২০১৯, ১১:৫৯ এএম

আগে কোনো ডরই ছিল না, এখন বৃষ্টিরে ডরাই!
রাঙ্গামাটির পাহাড়ের ঢালে ঠিক কবে থেকে বসতি গড়ে উঠেছে তা জানা নেই কারো। তবে সেখানকার স্থানীয়রা বলছেন, বংশপরম্পরায় তারা সেখানে বাস করছেন। সড়ক থেকে নিচের দিকে তাকালে পাহাড়ের সবুজ বন ভেদ করে চোখ ঝলসে ওঠে রুপালি ঝিলিকে। রোদ পড়ে নতুন টিনের ঘরের চালার ওপর। সেই রুপালি ঝিলিক যেন ঠিকরে পড়ে চারপাশে। শুধু টিনের ঘরই নয়, পাহাড়ের ঢালে এখন দোতলা বিল্ডিংও নির্মাণ করছেন বাসিন্দারা। প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাদের বসবাস তাদের কাছে বর্ষা ও বৃষ্টি হচ্ছে এক আতঙ্কের নাম। নতুন করে ঘর বানানোর পরও আতঙ্কে অনেকেই নিজের ঘর ছেড়ে থাকছেন অন্যত্র। রাঙ্গামাটির রূপনগর এলাকার বাসিন্দা ফিরোজ আমীন (৭৫)। তিনি বলেন, কবে থেকে এখানে আছি তা জানি না। এখানে আমার জন্ম। বড় হইছি এইখানেই। বাবার কাছে শুনছি আমার দাদাও এইখানে ছিল। আগে কোনো ডরই ছিল না। এখন বর্ষা আর বৃষ্টিরে ডরাই। ২০১৭ সালের তাণ্ডবের কথা মনে পড়লে আত্মায় আর পানি থাকে না। কিন্তু যাব কই? বেশি ঝড়-বৃষ্টি হলে রাস্তার উপরে উইঠা দাঁড়ায়ে থাকি। যাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নাই তারা শেষমেশ আশ্রয়কেন্দ্রে যায়।ভেদভেদি পশ্চিম মুসলিমপাড়ার বাসিন্দা সাজেদা বেগম (৪৫)। ২০১৭ সালে পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার বাড়ি। সাজেদা বেগম বলেন, মানুষ কয় আমরা বলে সাহসী। কিন্তু এই আমরাই এখন ঝড়-বৃষ্টিরে ভয় পাই। কিন্তু লাগলেওবা কী করব? যাব কই? একদিন না একদিন তো মরতে হবেই, তা যেখানেই থাকি না কেন। এই কথা মেনেই এখানে থাকি। রাঙ্গাপানির কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন আরিফ হোসেন (২৮)। তিনি বলেন, থাকতে থাকতে আমাদের কলিজা শক্ত হয়ে গেছে। প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, রাঙ্গামাটি জেলায় গত ১০ বছরে রাঙ্গামাটির বিভিন্ন উপজেলায় ২০টির মতো পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালে স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সালের ১০ জুন থেকে অব্যাহত বৃষ্টির ফলে ১২ জুন সন্ধ্যায় শহরের পুলিশ লাইন এলাকায় পাহাড় ধসে ১ শিশুর মৃত্যু হয়। ১২ জুন মধ্য রাত থেকে ১৩ জুন সকাল পর্যন্ত প্রচণ্ড বজ্রপাতে জেলা শহরের প্রত্যেকটি পাহাড়ের উপরিভাগের মাটি ধসে পড়ে। পাহাড় ধসের ফলে রাঙ্গামাটির সাপছড়িতে বিশাল রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় রাঙ্গামাটির সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল ৯ দিনের মতো। এই ঘটনায় পুরো রাঙ্গামাটি জেলায় সরকারি হিসাব মতে ১২০ জন নিহত হয়েছে। রাঙ্গামাটি শহরের মানিকছড়ি, ভেদভেদী, শিমুলতলী, রূপনগর, লোকনাথ মন্দির এলাকা, আউলিয়ানগর, চেঙ্গীমুখ, সাপছড়ি, মগবানসহ বেশ কিছু এলাকায় ৪ সেনাসদস্যসহ ৬৩ জন, কাউখালী উপজেলায় ২৭ জন, কাপ্তাই উপজেলায় ২০ জন, জুরাছড়ি উপজেলায় ৬ জন ও বিলাইছড়ি উপজেলায় ৪ জন মারা যায়। এর মধ্যে শিশু হচ্ছে ৩৪ জন, নারী ৩৭ জন ও পুরুষ ৪৯ জন। এর মধ্যে নিখোঁজ রয়েছে অন্তত ৮ জন। আহত হয়েছে ২০০ জনের বেশি। ২০১৮ সালের ১২ জুন রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় পাহাড় ধসে ১৩ জন নিহত হয়। তর মধ্যে একই পরিবারের সদস্য ছিল ৩ জন। আসন্ন বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধস প্রতিরোধে কী ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক এ. কে. এম মামুনুর রশিদ ভোরের কাগজকে বলেন, আসন্ন বর্ষা মৌসুমের আগেই পাহাড়ের আর একজনেরও যাতে মৃত্যু না হয় এর জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। রাঙ্গামাটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পাহাড় কাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কোথাও পাহাড় কাটা হলে সেসব স্থানে দ্রুত উপস্থিত হয়ে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। আশা করছি এ বছর আমাদের আর কোনো মৃত্যুর মিছিল দেখতে হবে না। দুর্যোগ মোকাবেলায় কী ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গত দুই বছর ধরে বিভিন্ন সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। রাঙ্গামাটি শহরসহ উপজেলার বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। রাঙ্গামাটিতে স্থায়ী কোনো আশ্রয়কেন্দ্র না থাকলেও বিভিন্ন স্কুল, মাদ্রাসা ও অফিস আদালতকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে। রাঙ্গামাটির সর্বত্র আমরা সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করেছি। বিভিন্ন ওয়ার্ড, এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করেছি যাতে যে কোনো দুর্যোগ আমরা মোকাবেলা করতে পারি। যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় রাঙ্গামাটি ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সও প্রস্তুত রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App