×

মুক্তচিন্তা

তাঁর স্মৃতি চির অমলিন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ মে ২০১৯, ১০:০৩ পিএম

তাঁর স্মৃতি চির অমলিন
তাঁর স্মৃতি চির অমলিন

শহীদ জননীর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই নতুন প্রজন্মের মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উজ্জীবন ঘটেছে। এই ধারাবাহিকতায় আজ এটি প্রমাণিত সত্য যে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবিরকে দেশবাসী চিনেছে। এখন তাদের তোড়জোড় শুরু হয়েছে নাম বদলে সাদা মানুষ হিসেবে নিজেদের প্রমাণিত করার। কিন্তু তা হবে না। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের অনুসারীরা বেঁচে থাকতে এই স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীরা খোলস পাল্টাতে পারবে না। শহীদ জননীর কাছে এই আমাদের অঙ্গীকার।

নব্বইতম জন্মবার্ষিকীতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। আজ এ জন্মদিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হলেও আমাদের চিন্তা-চেতনায় তিনি অহরহ বিরাজ করেন একজন অতি প্রিয় মানুষ হিসেবে। তাঁর সঙ্গে এক অলিখিত নিবিড় বন্ধনে আজো আমরা জড়িয়ে আছি। আমাদের যে কোনো অর্জনে বঙ্গবন্ধুর মতো তিনিও থাকেন সামনে। থাকেন আরো অনেকে। তাঁদের দেখানো পথে দেশ চলছে বলেই আজ যা কিছু অর্জন, যা কিছু কল্যাণ। অবশ্যই এ কল্যাণের পথে নেতৃত্বের পতাকা বহন করে চলেছেন আরেক প্রিয়জন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আজ জাহানারা ইমামের জন্মদিনে তাঁর কথাই মূলত বলতে চাই।

আন্দোলনের নেতা হওয়ার বহু আগে থেকেই তাঁকে চিনি। কাছাকাছি থাকার খুব বেশি সুযোগ সৃষ্টি করতে পারিনি ঠিকই কিন্তু যখনই দেখা হয়েছে নিগূঢ় ভালোবাসায় কাছে টেনেছেন। কিছু একান্ত স্মৃতি আজো ভুলতে পারি না। ১৯৭৩-এর কোনো একদিন হবে। তখন থাকি ইস্কাটনের সরকারি বাসায়। শহীদ পরিবারের জন্য বরাদ্দ। হঠাৎ করে এক ছুটির দিনে জাহানারা আপা জামীকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। আমি আনন্দে আপ্লুত। বসে এ কথা সে কথা। অনেক আলাপ। উঠে গেছি একবার চা আনতে। এসে দেখি টেবিলে রাখা একটি বই এনে জামীকে দেখাচ্ছেন। বইটি ছিল সে সময়কার একটি প্রকাশনা।

ক্যাপশনসহ মুক্তিযুদ্ধের ছবি। কিছু কিছু ঘটনার বিবরণও। বইটিতে রায়েরবাজারের বধ্যভূমির ছবি ছিল। ওতে আলীমের ছবিটিই আপা বিশেষভাবে জামীকে চেনালেন আমার কথা বলে। অন্যদেরও চিনিয়ে দিলেন। বইয়ের প্রথম পাতায় খালি জায়গায় কেন বইটি দিয়েছি নীপা, শম্পাকে তা লিখেছিলাম। ওই অংশটুকু নিজে পড়ে জামীকে শোনালেন।

আমি তখনো সদ্যপ্রাপ্ত আঘাতটাকে আড়াল করতে সবসময় পারিনি। সহমর্মী কাউকে পেলে কথা বলার মধ্যে চোখ ভরে যেত জলে। না বলতে চাইলেও আলীমের কথা এসেই যেত। আপা অত্যন্ত কৌশলে ওসব কথা এড়িয়ে যেতেন যাতে আমরা চোখের জল না ফেলি। একবারও তিনি রুমী বা শরীফ ভাইয়ের কথা গল্প করেননি। যাওয়ার সময় বললেন, খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তোমাদের দেখি, বাচ্চাদের দেখি। আবার আসব। প্রকৃত অর্থেই তিনি আমাদের সান্ত¡নার একটি আশ্রয় ছিলেন। আমার সুনির্দিষ্টভাবে মনে হতো তিনি হারিয়েছেন দুজনকে। তিনি যদি তা সহ্য করতে পারেন তাহলে আমিও পারব একজনের শোক সহ্য করতে। আসলে এটা ছিল অক্ষমের এক অতি ব্যর্থ প্রচেষ্টা। আমরা আমাদের প্রচণ্ড শোককে কখনো ভুলতে পারিনি।

এরপর আর অনেকদিন জাহানারা আপার সঙ্গে দেখা হয়নি। যোগাযোগ হয়নি। একদিন ধানমন্ডির দোকান তিতাসে ঢুকেছি। কয়েকজন খদ্দের কেনাকাটায় ব্যস্ত। আমি দাঁড়াই এক মহিলার পেছনে। তিনি পেছন ফিরে দেখলেন। আমিও তাকে দেখলাম। মনটা ধক করে উঠল। কাকে দেখলাম? না তার মুখখানা তো এমন ছিল না। বাংলাদেশের সুচিত্রা সেন জাহানারা ইমামের অপূর্ব সুন্দর মুখশ্রী কারো ভোলার কথা নয়। তাহলে তিনি কে? আপার কেনাকাটা শেষ। টাকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, শ্যামলী, বুঝেছি তুমি আমাকে চিনতে পারোনি। আমি জাহানারা ইমাম। মুখে ক্যান্সার হয়েছে। অপারেশন করিয়েছি। অনেকখানি অংশ কেটে বাদ দিতে হয়েছে। মুখটা একেবারেই অন্যরকম হয়ে গেছে। এ জন্যই চিনতে পারনি। আমার বুকটা ভেঙে গেল দুঃখে। আপার হাত দুটো জড়িয়ে নিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আপা বুঝতে পেরেছিলেন হয়তো আমি কেঁদে ফেলব। চট করে বললেন, আজ চলি। পরে দেখা হবে। বলেই হন হন করে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন। আমার সবটাই দুঃস্বপ্ন মনে হলো।

ক্যান্সার নিয়েই আপার আন্দোলন, সভা। সব খবর রাখি কিন্তু সশরীরে উপস্থিত হওয়া হয় না। পূর্ণ সমর্থন থাকলেও পাশাপাশি থেকে কাজ করতে পারিনি। স্কুল আমাকে বড় বেশি ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। একদিন একজন এসে বললেন, আপনাকে জাহানারা ইমাম সময় করে একবার বাসায় যেতে বলেছেন। বললাম, অবশ্যই যাব। সেদিনই অনেক অপরাধবোধ নিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে যাই বাসায়। দোতলার শোবার ঘরে আপা দুপুরের খাবার সেরে বিছানায় শুয়েছেন মাত্র। আমাকে দেখে উঠে বসলেন। বিছানাতেই বসতে বললেন। খাটের মাথার কাছে রাখা একটি বই হাতে নিয়ে বললেন, “এটি আমার সর্বশেষ বই ‘ক্যান্সারের সাথে বসবাস’। তুমি একটি কেন। টাকার জন্য বলছি না। আমি চাই তুমি এ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকো।” আমি লজ্জায় মরে গেলাম। যা আমার অনেক আগে করা উচিত ছিল তা করতে পারিনি। বলি, ‘আপা আমি অবশ্যই আন্দোলনে থাকব। গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছিলাম। মনে মনে সবসময় থাকি আন্দোলনে।’ আপা আবার বললেন, ‘সেটা আমি জানি বলেই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি।’ সেদিন একটা নয় অনেক বই কিনেছিলাম। স্কুলের লাইব্রেরিতে দিয়েছি। শিক্ষকদেরও দিয়েছি। আপা খুব খুশি হয়েছিলেন। সেই আমার শেষ দেখা আপার সঙ্গে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন। লেখক, শিক্ষক, সমাজসেবক, সংগঠক এমনি অসংখ্য গুণের সমাবেশ ছিল তাঁর মধ্যে। সবশেষে হয়েছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা।

১৯৮১ সালের ৭ মে বাংলাদেশে পাকিস্তানি নাগরিক যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের অবৈধ অবস্থান, জামায়াতের পুনরুত্থান এবং সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের একনায়কত্বের বিরুদ্ধে একটি কমিটি হয়েছিল। ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী নাগরিক কমিটি’। এর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন জাহানারা ইমাম। এই কমিটি ২৫ মে, ১৯৮১-তে বায়তুল মোকাররমে একটি সভা করেছিল। অনেক লোক ছিল ওই সভায়। ওখানে তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সম্ভবত এটিই ছিল তাঁর বড় সমাবেশে দেয়া প্রথম বক্তৃতা। ওখানে স্লোগান উঠেছিল- ‘মাগো তোমায় কথা দিলাম, অস্ত্র আবার হাতে নেবো। মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার।’ তিনি সভায় সবাইকে সন্তান বলে সম্বোধন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে বলেছিলেন। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রকে প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

১৯৮৭ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে এবং জামায়াতের সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গঠিত হয়েছিল ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’। এ কমিটির সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।

বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশাকারী গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বঙ্গবন্ধু বাতিল করেছিলেন। সে পাকিস্তানে থাকত। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই সে এ দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গিয়ে সেখানকার নাগরিকত্ব নিয়েছিল। ১৯৭৮ সালে এই আলবদর নেতা গোলাম আযম অসুস্থ মাকে দেখার নাম করে বাংলাদেশে এসে থেকে গেল। আর পাকিস্তানে ফেরার নামটিও নেয়নি। উপরন্তু সে প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে বলেছে- ১৯৭১ সালে আমরা যা করেছি ঠিকই করেছি। সেই লোককে জামায়াতে ইসলামী দলের আমির ঘোষণা করে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সাল থেকেই শহীদ পরিবার ও বুদ্ধিজীবী মহল দাবি করে আসছিলেন। গোলাম আযমের আমির হওয়ার ঘোষণায় এ আন্দোলনের দাবি সংগঠিতভাবে উত্থাপনের জন্য ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি গঠন করা হয় ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। ১০১ সদস্যের কমিটি শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক নির্বাচিত করেন। এই কমিটি কর্মসূচি ঘোষণা করেন যে আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ২১তম বার্ষিকীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশিষ্ট নাগরিক ও আইনজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত প্রকাশ্য গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার হবে। যেহেতু গোলাম আযম অপরাধ করেছে এ দেশের সমগ্র জনগণের কাছে, সেহেতু গণআদালতই হবে এই ঘৃণিত ব্যক্তির বিচারের উপযুক্ত স্থান। একই সঙ্গে আমরা দাবি জানাচ্ছি একাত্তরের ঘাতকের দল, যারা এখনো স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণবিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে, সেই জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্ম ব্যবসায়ীদের সব রাজনৈতিক দল অবিলম্বে নিষিদ্ধ করতে হবে।

কয়েকবার অপারেশন করেও জাহানারা ইমাম সেরে ওঠেননি। মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন কিন্তু এই শরীর নিয়ে আন্দোলন করার জন্য তার দলকে সঙ্গে করে ছুটে বেরিয়েছেন তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ। বাংলার ছাত্র-শিক্ষক, সাধারণ মানুষসহ সবাই জাহানারা ইমামের আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়েছে। তিনি একটি মানববন্ধনের ডাক দিয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। দেশজুড়ে অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে গিয়েছিল।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াত-শিবিরের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গণস্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করেছিল। ৭২টি সংগঠন নিয়ে ১৯৯২-এর ১১ ফেব্রুয়ারি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়। জাহানারা ইমামকে এই কমিটিরও আহ্বায়ক নির্বাচন করা হয়। এই সমন্বয় কমিটির উদ্যোগেই ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার।

সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রায় ৫ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল। গণআদালত যেন বসতে না পারে সে জন্য ঢাকা শহরের সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। মানুষকে মাঠে আসতে বাধা দেয়া হয়। সব মাইক কেড়ে নিয়ে নেয়া হয় কিন্তু জাহানারা ইমাম ও অন্য নেতারা ছিলেন অবিচল। বিশাল জনসমুদ্রের সামনে একটি ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে জাহানারা ইমাম ঘোষণা করেছিলেন গণআদালতের ঐতিহাসিক বিচারের রায়।

খালেদা জিয়ার সরকার জাহানারা ইমামসহ ২৪ জন নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা মামলা দেয়। এই মিথ্যা অভিযোগ মাথায় নিয়েই শহীদ জননীকে ইহলোক ত্যাগ করতে হয়। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার দাবিটিও তিনি বেঁচে থাকতেই শুরু করেছিলেন। সারাদেশ একাট্টা হয়েছিল এই দাবিতে। শহীদ জননীর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই নতুন প্রজন্মের মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উজ্জীবন ঘটেছে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানে।

এই ধারাবাহিকতায় আজ এটি প্রমাণিত সত্য যে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবিরকে দেশবাসী চিনেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরা শতভাগ প্রত্যাখ্যান পেয়েছে জনগণের কাছ থেকে। এখন তাদের তোড়জোড় শুরু হয়েছে নাম বদলে সাদা মানুষ হিসেবে নিজেদের প্রমাণিত করার। কিন্তু তা হবে না। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের অনুসারীরা বেঁচে থাকতে এই স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীরা খোলস পাল্টাতে পারবে না। শহীদ জননীর কাছে এই আমাদের অঙ্গীকার।

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী : শহীদজায়া ও শিক্ষাবিদ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App