×

জাতীয়

তিন কারণে মামলাজট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০১৯, ১১:০৩ এএম

তিন কারণে মামলাজট
বর্তমানে দেশে ৩৫ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এ সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। তৈরি হচ্ছে মামলাজট। বিচারক স্বল্পতা, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও ব্যবস্থাপনা ত্রু টি এই তিন কারণে সৃষ্টি হচ্ছে মামলাজট। এই জট নিরসনে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তবে তা কোনো কাজে আসছে না। এ নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও হতাশা। এতে সাধারণ নাগরিকদের মতো হতাশ স্বয়ং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। মামলাজটে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, এসব সমস্যা নিরসনে বিচারপতিদের সঙ্গে বসবেন তিনি। সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ আদালতে (আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট) বিচারাধীন মামলা পাঁচ লাখ ৩৭ হাজার ৯৪টি। এর মধ্যে আপিল বিভাগে ২০৪৪২টি এবং হাইকোর্টে পাঁচ লাখ ১৬ হাজার ৬৫২টি। হাইকোর্টে বিচারপতি রয়েছেন ৯২ জন। ৩৫টি দ্বৈত ও ১৯টি একক বেঞ্চে গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে বিভিন্ন শ্রেণির (ফৌজদারি, দেওয়ানি ও রিট) মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ১৬ হাজার ৩০৬টি। এ সময় বিচারাধীন মামলা ছিল ৫ লাখ ৩২ হাজার ৯৫৮টি। আর বিশেষ উদ্যোগের ফলে মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। শুধু গত জানুয়ারিতেই মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ১৬ হাজার ৫২৩টি। দেশের নিম্ন আদালতে (জেলা ও দায়রা জজসহ সব ধরনের ট্রাইব্যুনাল) বিচারাধীন মামলা ৩০ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৬টি। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা ১৩ লাখ ২১ হাজার ৩৮টি ও ফৌজদারি ১৭ লাখ ১১ হাজার ৬১৮টি। গত বছর দেশের আদালতগুলোতে মামলা দায়ের হয়েছে চার লাখ ৪৭ হাজার ৮৫৪টি। আর নিষ্পত্তি হয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ১৩১টি মামলা। নিম্ন আদালতে গত বছরই মামলা বেড়েছে এক লাখ ৭১ হাজার ৪৭১টি। সুপ্রিম কোর্টের জুডিশিয়াল রিফর্ম কমিটি ও জার্মান ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন বাংলাদেশ (জিআইজেড) গত শনিবার সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে ‘মামলাজট নিরসন ও বিচার প্রার্থীদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি, বিচার বিভাগের কাঠামোগত উন্নয়ন সংক্রান্ত’ বিষয়ে একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। ওই প্রতিবেদনে বিব্রত হয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের মামলার নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেখে আমি প্রায় বিব্রত। এত মামলা! এভাবে চলতে পারে না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারপতিকে নিয়ে বসব। সবাইকে বলব, এ অবস্থায় কী করবেন আপনারা দেখেন। গত শনিবার নীরিক্ষা প্রতিবেদন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় বিচারক কম। কিন্তু শুধু বিচারক বাড়ালেই মামলাজট কমবে না। মামলাজট নিরসন ও বিচার প্রার্থীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো ও কাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ উন্নত অনেক দেশে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে অধিকাংশ মামলা নিষ্পত্তির উদাহরণ দিয়ে বাংলাদেশেও সেই প্রক্রিয়া অনুসরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, বিচারক সঙ্কট, অবকাঠামোগত অপ্রতুলতাকে মামলাজটের অন্যতম কারণ মনে হলেও শুধু বিচারক বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন দিয়ে এ অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। এর থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সঠিক মামলা ব্যবস্থাপনা। দুটি ধাপে এ কাজ করতে হবে। প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থায় মামলা দায়েরের হার কমানো এবং দ্বিতীয়ত, মামলা দায়েরের পর প্রতিটি পর্যায়ে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দ্রæত সময়ে মামলা নিষ্পত্তি করা। বিচারাধীন মামলার তুলনায় বিচারকের অপর্যাপ্ততার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রতি দশ লাখ লোককে মাত্র ১০ জন বিচারক বিচারিক সেবা দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা ১০৭, কানাডায় ৭৫, ব্রিটেনে ৫১, অস্ট্রেলিয়ায় ৪১, ভারতে ১৮ জন। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ মামলা পারস্পরিক বোঝাপড়া বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। বড় জোর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হয় আদালতে। অন্যদিকে বাংলাদেশে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মামলার নিষ্পত্তি হয়। আর ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ মামলার নিষ্পত্তি হয় আদালতে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক না থাকা এবং নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক না করায় আদালতগুলোয় মামলাজট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এতে ন্যায়বিচারের পথ সংকুচিত হয়ে আসছে। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় জরুরি। মামলাজটে ন্যায়বিচার ব্যাহত হচ্ছে। তবে আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলাজট কমিয়ে আনা সম্ভব। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সরকারের শাসন ব্যবস্থায় মিথ্যা মামলা দায়েরের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু বিচারকের সংখ্যা বাড়ছে না। ভুয়া মামলা করার প্রবণতা বন্ধ করলে মামলাজট কমবে। পর্যাপ্ত বিচারক ও প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগের তাগিদ দিয়ে হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট এডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, মামলাজটের অন্যতম কারণ বিচার ব্যবস্থায় লজিস্ট্রিক সাপোর্টের ঘাটতি। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে মামলার দায়ের সংখ্যা কমে যেত। আইন অনুযায়ী সবকিছু চললে বিষয়টি আদালতে আসবে না, মামলাও হবে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App