×

সাময়িকী

তিনি জেগে আছেন তাঁর কথায় ও কবিতায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০১৯, ০৭:৪৬ পিএম

তিনি জেগে আছেন তাঁর কথায় ও কবিতায়
আপ্লুত বোধ করি তাঁর কবিতার অভাবিত শব্দপ্রয়োগের দ্যোতনায় ও অভিনতুন চিত্রকল্পের অভিব্যঞ্জনায়; মগ্ন হয়ে থাকি তাঁর মননশীল গদ্যের গভীরতায়; বিভোর হয়ে রই শিশুসাহিত্যের অন্তরময়তায়।
হুমায়ুন আজাদ আমার শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে বিগত শতকের আশির দশকে আমি তাঁর কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছি ভাষা ও সাহিত্যের, বিভাব নিয়েছি জীবন ও জগতের, উদ্বোধিত হয়েছি জীবনবোধে। সে ছিল এমন এক সময় যখন প্রাণঘাতী স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল ছিল আমাদের প্রাণের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গোটা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জোড়া প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ। শিক্ষকের সামাজিক দায়িত্ব পালনে তিনি তখনো এবং কখনো উটপাখিসুলভ আচরণ করেননি। বরং তাঁর ছিল অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস। শিক্ষক কাকে বলে? শ্রেণিকক্ষে পড়ালেই কি শিক্ষক হয়ে ওঠেন কেউ? নাকি দিতে হয় শিক্ষা? শিক্ষিত করে তুলতে হয় ছাত্রকে? বলতে চাই, যিনি তাঁর ছাত্রকে শিক্ষিত হয়ে উঠতে বাধ্য করতে পারেন, ধমকে কিংবা চাবকে নয়, মনের কোণে আলো ফেলে, চেতনার অলিন্দে নিলয়ে লাল-নীল দীপাবলি জ্বেলে, তিনিই তো শিক্ষক। সেই শিক্ষক ছিলেন তিনি আমার এবং আরো অনেকের। একদিকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন জাগিয়েছেন অন্তরে, অন্যদিকে দিয়েছেন উত্তরের দিকনির্দেশনা; নিত্যনতুন জ্ঞানের আর ভাবনার ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে আমার কৌতূহলের আর তৃষ্ণার তটে। কী ছিল তাঁর শিক্ষার মূলমন্ত্র? ছোটদের জন্য লেখা ছোট্ট একটা কবিতার বিন্দুতে দেখতে পাই সেই সিন্ধু : ‘যে-বই জুড়ে সূর্য ওঠে পাতায় পাতায় গোলাপ ফোটে সে-বই তুমি পড়বে। যে-বই জ্বালে ভিন্ন আলো তোমাকে শেখায় বাসতে ভালো সে-বই তুমি পড়বে। যে-বই তোমায় দেখায় ভয় সেগুলো কোনো বই-ই নয় সে-বই তুমি পড়বে না। যে-বই তোমায় অন্ধ করে যে-বই তোমায় বন্ধ করে সে-বই তুমি ধরবে না।’ আর কী ছিল তাঁর শিক্ষকসত্তায়? ছিল এই জলমাটির পৃথিবী, মাটির মানুষ এবং মৃত্তিকাসংলগ্ন জীবনের প্রতি অকৃত্রিম প্রেম, যার হৃদয়স্পর্শী অভিব্যক্তি পাই এই কবিতায় : ‘ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো। ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো। ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা। ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা। ভালো থেকো। ভালো থেকো চর, ছোট কুঁড়েঘর, ভালো থেকো। ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো। ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির। ভালো থেকো জল, নদীটির তীর। ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো। ভালো থেকো কাক, কুহুকের ডাক, ভালো থেকো। ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাঁশি। ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি। ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো। ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো। ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল, ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল, ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও, ভালো থেকো। ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো। ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।’ বিচিত্র মানুষ ছিলেন তিনি, ছিলেন শিক্ষাবিদ-গবেষক-লেখক, বৈচিত্র্যপিয়াসী দ্রষ্টা এবং ¯্রষ্টা, বৈদগ্ধ্যে ও বৈভবে। কবিতা লিখেছেন ব্যক্তি থেকে সমষ্টি অবধি অনুভবে; প্রবন্ধ ও গবেষণার প্রধান অধিক্ষেত্র ছিল ভাষা-সাহিত্য-শিক্ষা; নিবন্ধ ও স্তম্ভের জন্য বেছে নিয়েছেন স্বকাল-সমাজ-রাজনীতি; সমকালীন প্রেক্ষাপটে করেছেন রচনা একের পর এক উপন্যাস; শিশুকিশোরদের জন্য রেখে গেছেন সাহিত্যের জ্বলজ্বলে নক্ষত্রমণ্ডল; সম্পাদনায় বেঁধেছেন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থরাজি; জীবনবীক্ষায় বুনেছেন প্রবচনগুচ্ছ; এমনকি অনুবাদের কাজটিকেও রাখেননি কর্মযজ্ঞের আওতাবহির্ভূত। হুমায়ুন আজাদের অনেক অভিমতের সঙ্গেই অনেকে একমত হতে পারেন না, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমিও পারি না। তাঁর নানা কাজ ও নানা কথা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সরলরৈখিক লেখকজীবন তাঁর ছিল না। সেটা তাঁর আরাধ্যও ছিল না। কঠিন-জটিল বন্ধুর পথেই পরিভ্রমণ করেছেন তিনি প্রথমাবধি। পণ্ডিত ছিলেন তিনি, তাঁর অভিসন্দর্ভ-প্রবন্ধগুচ্ছ এই সাক্ষ্য দেয়; অন্তর্দৃষ্টি ও শৈল্পিক অভিজ্ঞান তাঁর কবিতাকে করেছে বিশিষ্ট; গভীর মমত্ববোধ ও জীবনের অন্তর্গত সরলতার প্রতি আত্মনিবেদন তাঁর কিশোরসাহিত্যকে করেছে মানবিক ও নান্দনিক আবেদনে মূল্যবান; সমাজচেতনা তাঁর সৃষ্টিশীল রচনাবলির ভাঁজে ভাঁজে বাক্সময়। মানবজীবনের গহিনে ডুব দিয়ে তিনি তুলে আনতে পারেন উপলব্ধির এ রকম মুক্তোদানা : ‘গরিবদের চোখের চাউনিতে কোনো সৌন্দর্য নেই, চোখ ঢ্যাবঢ্যাব ক’রে তারা চারদিকে তাকায়। মেয়েদের স্তন খুব বিখ্যাত, কিন্তু গরিব মেয়েদের স্তন শুকিয়ে শুকিয়ে বুকের দু-পাশে দুটি ফোড়ার মতো দেখায়। অর্থাৎ জীবনযাপনের কোনো মুহূর্তেই গরিবদের সুন্দর দেখায় না। শুধু যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায়।’ মাত্র ৫৭ বছর বয়সে আকস্মিক মৃত্যু ঘটে হুমায়ুন আজাদের। কবিতায় লিখেছিলেন : ‘আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো ছোট ঘাসফুলের জন্যে একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে উড়ে যাওয়া একটি পাপড়ির জন্যে এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্যে। আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো দোয়েলের শিসের জন্যে শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে আমি হয়তো মারা যাবো কারো চোখের মণিতে গেঁথে থাকা একবিন্দু অশ্রুর জন্যে এক ফোঁটা রৌদ্রের জন্যে। আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো এক কণা জ্যোৎস্নার জন্যে এক টুকরো মেঘের জন্যে আমি হয়তো মারা যাবো টাওয়ারের একুশ তলায় হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে এক ফোঁটা সবুজের জন্যে। আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে খুব ছোট দুঃখের জন্যে আমি হয়তো মারা যাবো কারো ঘুমের ভেতরে একটি ছোটো দীর্ঘশ্বাসের জন্যে এক ফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে।’ কিন্তু প্রতিকূল প্রতিবেশে অমন কাব্যিক মৃত্যু হয়নি কবির, যে মৃত্যু টেনেছে তাঁর জীবনের যবনিকা তা বরং এক দুর্ঘটনা, যে কোনো বিবেচনায়, যে কোনো মাত্রায়। কী বিপুল রচনাসম্ভার (কবিতা কথাসাহিত্য প্রবন্ধ নিবন্ধ গবেষণা সমালোচনা স্তম্ভ প্রবচন শিশুকিশোরসাহিত্য অনুবাদ সম্পাদনা সংকলন সাক্ষাৎকার মিলে গ্রন্থসংখ্যা ৬০-এর অধিক) তিনি যোগ করে গেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রত্ন ভাণ্ডারে! কত নদী সরোবরে পূর্ণতর করেছেন ধনধান্যপুষ্পভরা সোনার বাংলার ভূগোল। স্বল্পায়ু ছিলেন তিনি বটে, কিন্তু স্বল্পপ্রজ ছিলেন না মোটেও। আমৃত্যু সক্রিয় ছিলেন মনে ও মননে, কালি ও কলমে; গতিরহিত হয়ে সৃজনকর্মে টানেননি যতি আচম্বিতে থেমে যাওয়া পর্যন্ত; ফলে তাঁর অকালমৃত্যু যে আমাদের শিক্ষায় সাহিত্যে সমাজচিন্তনে এক অপূরণীয় ক্ষতির নামান্তর তাতে তিলমাত্র সন্দেহের অবকাশটুকুও অনুপস্থিত। আজো আমরা আমাদের সম্পদে ও সংকটে উচ্চারণ করি তাঁর আলোকোজ্জ্বল পঙ্ক্তিমালা; আপ্লুত বোধ করি তাঁর কবিতার অভাবিত শব্দপ্রয়োগের দ্যোতনায় ও অভিনতুন চিত্রকল্পের অভিব্যঞ্জনায়; মগ্ন হয়ে থাকি তাঁর মননশীল গদ্যের গভীরতায়; বিভোর হয়ে রই শিশুসাহিত্যের অন্তরময়তায়। আর বিরূপ বিশ্বে সমুদয় ঘাতক ও সকল অপমৃত্যুকে পুরোপুরি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রচণ্ড দার্ঢ্যে উচ্চশির হুমায়ুন আজাদ বেঁচে থাকেন, জেগে থাকেন তাঁর কথায় ও কবিতায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App