×

সাময়িকী

আমাদের হুমায়ুন আজাদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০১৯, ০৭:৩৩ পিএম

আমাদের হুমায়ুন আজাদ

বহুমাত্রিক ও প্রথাবিরোধী লেখক, গবেষক ও ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ষাটের বেশি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। মূলত গবেষক ও প্রাবন্ধিক হলেও হুমায়ুন আজাদ নব্বইয়ের দশকে একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রবন্ধের বই ‘নারী’। বইটি প্রকাশের পর তিনি মৌলবাদীদের তীব্র রোষানলে পড়েন। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির গ্রন্থমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে সন্ত্রাসীর চাপাতির আঘাতে তিনি গুরুতর আহত হন। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে সুস্থ হয়ে ওঠেন। ওই বছর ১২ আগস্ট জার্মানির মিউনিখে নিজ ফ্ল্যাটে রহস্যজনকভাবে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ২৮ এপ্রিল হুমায়ুন আজাদের জন্মদিন। তাঁকে স্মরণ করে আমাদের সংখ্যা নিবেদন।

হুমায়ুন আজাদ তখনো বিখ্যাত ‘হুমায়ুন আজাদ’ হয়ে উঠেননি। বাহাত্তর সালের দিকে, আমাদের প্রধান আড্ডাস্থান ছিল নিউমার্কেটের বইপাড়া। সুতোছেঁড়া ঘুড়ির মতো আকাশ শহরের সারাদিন যেখানে ঘুরি না কেন, সন্ধ্যায় জমে যাই সেই আড্ডায়। লেখক শ্রেণির অনেকেই আসেন, নতুন বইয়ের খোঁজে, মূলত আড্ডার টানটাই বেশি। যারা ইতোমধ্যে বাগ্দেবীর ছিটেফোঁটা আশীর্বাদ পেয়ে গেছেন, তারা তো আছেনই, তাদের সঙ্গে মিশেছেন আমাদের মতো তরুণ কবিযশঃপ্রার্থীরাও। নতুন দেশ, নতুন কবিতার উন্মাদনা। ষাটের কবি বলে যারা চিহ্নিত, তখন তারাও ছিলেন তারুণ্যের জোয়ারে ভেসে চলা প্রজন্ম। হুমায়ুন আজাদ সেই প্রজন্মেরই একজন। ১৯৭৩-এ তার প্রথম কাব্য ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ বেরোয়। ষাটের কবিদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ বেরিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের এক বছর আগে। ’৭২-এ বেরোয় আবুল হাসানের ‘রাজা যায় রাজা আসে’। মহাদেব সাহার ‘এই গৃহ এই সন্ন্যাস’ও বোধকরি ’৭২-এ বেরিয়েছিল। তখনো সারা বছরে দু’চারটা কবিতার বই বেরোতো। একটা বই বের হলে কবি লেককদের মধ্যে সাড়া পড়ে যেত। হুমায়ুন আজাদের অলৌকিক ইস্টিমারের বেলায় তাই ঘটল। বলাবলি হতে থাকল, প্রথম গ্রন্থেই তিনি নিজস্বতার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন। পরবর্তীতে বিচিত্র লেখালেখিতে হুমায়ুন আজাদ ‘নিজস্বতা’র বিষয়টি প্রমাণ করতে পেরেছেন। যদিও বলা হয়ে থাকে, হুমায়ুন আজাদ বুদ্ধদেব বসুর রচনাশৈলী দ্বারা প্রভাবিত। এমনটা হতেই পারে, এতে দোষের কিছু নেই। তবে একটা কথা সত্য, বুদ্ধদেব বসুর লেখালেখির বহুমুখিতা হুমায়ুন আজাদ ধারণ করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর, বলা হয়ে থাকে বুদ্ধদেব বসুর রচনা সমগ্রেই বহুমুখিতা লক্ষ করা যায়। সমকালীন বাংলাদেশের সাহিত্যে স্বচ্ছ বহুমাত্রিকতা সৈয়দ শামসুল হক এবং হুমায়ুন আজাদের রচনাতেই মেলে। কবিতা দিয়ে হুমায়ুন আজাদের লেখালেখির যাত্রা শুরু হলেও তিনি উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি ছিলেন গবেষক, অনুবাদক, সাহিত্য সমালোচক, ভাষাবিজ্ঞানী। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ সম্পাদনা করে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সাহিত্য ¯্রষ্টা হিসেবে তার প্রতিভা ও মননের অসাধারণ দিক উন্মোচিত হয়েছে শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা গ্রন্থে। নিউমার্কেটের বইপাড়ার সেই আড্ডার মুখর সদস্য ছিলেন হুমায়ুন আজাদ। ‘মুখর’ শব্দটি বললাম এই জন্য যে, আড্ডার যে কোনো মোড় ঘুরিয়ে নিজের যুক্তির পথে নিয়ে যাওয়ার অসামান্য দক্ষতা ছিল হুমায়ুন আজাদের। প্রথাগত যুক্তিকে তিনি নতুন অন্বেষণের কাছে দাঁড় করিয়ে দিবেন। অবশ্য তখন কেউ আন্দাজ করতে হয়তো পারেননি যে, এই হুমায়ুন আজাদ আগামী দিনে আবির্ভূত হবেন প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে। তিনি যথার্থই ছিলেন প্রথাবিরোধী লেখক। নতুন চিন্তার সন্নিবেশ, বক্তব্যের ঋজুতা, বিষয়ের অভিনবত্ব তাকে প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তার স্পষ্টবাদিতা আমরা সেই সময়ই লক্ষ করেছি। প্রখর যুক্তি আর বক্তব্যের ঋজুতার জন্য, আমরা অনুজরা তো বটেই, তার বন্ধুরাও তাকে সমঝে চলতেন। হুমায়ুন আজাদ পেশায় ছিলেন অধ্যাপক। সেখানেও আলোচনার শীর্ষপাশে তাকে রাখতে হতো। আসলে সব ধরনের গতানুগতিকতাই তিনি সচেতনভাবে এড়িয়ে চলতেন। লেখক জীবনে বই লিখেছেন ৬০ এর অধিক। বিষয়, বিন্যাস, বিশ্লেষণ ইত্যাদির গুরুত্বও গভীর নান্দনিক মননশীলতার কারণে অধিকাংশ বই-ই গ্রাহ্য করার মতো। একেকটি বই বেরিয়েছে, পাঠকপ্রিয়তা পৌঁছেছে নতুন মাত্রায়। তার লেখালেখির কিছু অংশ নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। প্রশংসা আর নিন্দামন্দকে হুমায়ুন আজাদ একই চোখে দেখতেন। বই নিষিদ্ধ হয়েছে, বিরূপ সমালোচনা হয়েছে, কিন্তু হুমায়ুন আজাদ তার অবস্থান থেকে একচুলও নড়েননি। বিশ্বাস থেকে যা বলেছেন, শেষ পর্যন্ত তাই বলেছেন। হুমায়ুন আজাদের লেখলেখির আমি একজন অনুরক্ত পাঠক। তার কোনো কোনো মতামতের সঙ্গে ভিন্ন মত থাকলেও কোনো লেখাই অগ্রাহ্য করার মতো নয়। নানা আড্ডার ঘনিষ্ঠতা ছাড়া। তার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক আমার ছিল না। তবে একটি দুঃখজনক ঘটার সূত্রে তার উদার সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আমাদের জানা আছে, ২০০৪ সালে তাকে হত্যার একটা অপচেষ্টা হয়েছি। সেটা ছিল একুশের বইমেলার শেষ প্রান্তের ঘটনা। হুমায়ুন আজাদের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। প্রতিদিন মেলায় যান। যতক্ষণ না মেলা শেষ হয়, নির্দিষ্ট স্টলে তাকে বসতে হয়। ভক্ত-পাঠকরা তার বই কিনছেন, অটোগ্রাফ নিচ্ছেন। তিনিও বেশ স্বতঃস্ফূর্ত। সেদিন মেলার সময় শেষ করে তিনি বেরুচ্ছেন। তখনো আমাদের আড্ডা চলছে ‘লেখককুঞ্জে’। তিনিও ভিড়ে গেলেন সেই আড্ডায়। বরাবরের মতো আড্ডা ঘুঁটি চলে গেল তার হাতে। এক সময় আড্ডা শেষ করে যে যার মতো বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম। সবে শাহবাগের কাছাকাছি এসেছি, শোনা গেল হুমায়ুন আজাদকে হত্যার অপচেষ্টার ভয়াবহ খবর। ছুটলাম টিএসসির দিকে, রক্তচিহ্ন, কি মর্মান্তিক। ওখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে। দেখলাম, মেডিকেল থেকে অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে সিএমএইচএ। এই হত্যাচেষ্টার ঘটনায় যথারীতি মামলা হলো। মামলার সাক্ষী করা হলো সেদিন যারা লেখককুঞ্জের আড্ডায় ছিলেন সবাইকে। থাইল্যান্ডের দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে হুমায়ুন আজাদ দেশে ফিরলেন। আমরা যারা তাকে হত্যাচেষ্টা মামলার সাক্ষী, এক সন্ধ্যায় গেলাম তার সঙ্গে দেখা করতে। বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। ভিজে একাকার, বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে পড়লাম নিরাপত্তা রক্ষীদের বাধায়। খবর পাঠালে হুমায়ুন আজাদ নিজে এসে আমাদের উদ্ধার করলেন। স্বভাবসুলভ তীক্ষè পরিহাসের ভাষায় নিরাপত্তা রক্ষীদের বললেন তোমরা কিসের গোয়েন্দা পুলিশ। আমার বন্ধুদের আটকিয়েছ। অপরাধী আর ভালো মানুষ চেন না। তোমাদের উচিত কাজী আনোয়ার হোসেনের গোয়েন্দা সিরিজ পড়া। অনেকক্ষণ আড্ডা হলো। আমাদের দলনেতা ছিলেন কবি রফিক আজাদ। বিদায়ের আগে হুমায়ুন আজাদ তার পড়ার ঘর খুলে দিলেন, বললেন, আমার লেখা বই থেকে যার যেটা ইচ্ছা নিতে পারেন। তবে দুটোর বেশি নয়। মনে আছে, আমি নিয়েছিলাম ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ আর ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’। আধুনিক বাংলা কবিতা প্রসঙ্গে একটি স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এটি হুমায়ুন আজাদের সম্পাদিত গ্রন্থ। এতে সমকালীন বিশিষ্ট কবিদের কবিতা আছে। তবে দু’একজনের কবিতা তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই বাদ দিয়েছেন। এর পেছনে তার নিজস্ব যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ওই যে বলেছি, হুমায়ুন আজাদ নিজের সিদ্ধান্তে সব সময়ই অটল। এ ক্ষেত্রেও তাই। কবিতা ছাপা নিয়ে সিকদার আমিনুল হক এবং হুমায়ুন আজাদের মধ্যকার টেলিফোন ঝগড়া দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আমি তখন সিকদার আমিনুল হকের বাসায়। এই প্রান্তে সিকদার আমিনুল হক আর (বুঝলাম) অন্যপ্রান্তে হুমায়ুন আজাদ। উত্তেজিত কণ্ঠে সিকদার ভাই অন্য প্রান্তকে দোষরোপ করছেন। বলছেন আপনি আমার অনুমতি ছাড়া কবিতা ছেপেছেন। ইচ্ছাকৃত আমার তিনটি কবিতা দুর্বল নিয়েছেন, নিজের কবিতা ছেপেছেন পাঁচটি... ইত্যাদি ইত্যাদি। অপর প্রান্তের কী জবাব আমার জানা হয়নি। এরপর দুজনের সম্পর্ক যে খুব ভালো ছিল না, তা অনুমান করা যায়। কিন্তু আমার এ অনুমান এক সময় মিথ্যা প্রমাণিত হলো। সিকদার আমিনুল হকের আকস্মিক মৃত্যুর পর নাগরিক শোকসভায় প্রকাশিত হয়েছিল একটি পুস্তিকা। এতে ছিল অনেক কবি-লেখকের শোককথা। হুমায়ুন আজাদের কাছেও লেখা চাইলাম। ভেবেছিলাম তিনি হয়তো লিখবেন না। দুই ঘণ্টা সময় নিলেন। সহযাত্রীর প্রয়াণে লিখলেন হৃদয়জাত উচ্চারণগুচ্ছ- যখন আমরা ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছি নিজেদের থেকে, সে সময় কেউ কেউ পৌঁছে যাচ্ছি গন্তব্যে,- যেমন পৌঁছে গেছেন সিকদার আমিনুল হক, কবি, শুধু কবি। এখানে কিছুই ধরে রাখতে পারে না আমাদের- প্রেম, কাম, এই সব শব্দপুঞ্জ, পুত্র, প্রেমিকা, কন্যা, বন্ধু কেউ ধরে রাখতে পারে না। হৃদয় দুরন্ত শত্রু, যৌবনে শুধুই কাঁপে, একদিন সে-ই করে প্রতারণা। সিকদার ঘুমিয়ে আছেন, তাকে আমরা কিছুই পারি না দিতে, এমনকি প্রেমিকেরাও তাকে আর হৃদয় বা দেহ, একটি কবিতার পঙ্ক্তিও পারবে না দিতে। কবি, গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন, দুর্বোধ্য পুষ্পের মতো রেখে গেছেন কোমল কবিতাগুচ্ছ, আজ থেকে শুধু তিনিই উড়োতে পারেন মেঘ, পুষ্প এবং কবিতা আমাদের দিকে। লেখাটি যখন আমার হাতে তুলে দিচ্ছেন, দেখলাম হুমায়ুন আজাদের চোখ দুটো ভিজে আসছে। বিচিত্র লেখায় সিদ্ধ হলেও কবিতা ছিল হুমায়ুন আজাদের প্রথম এবং শেষ প্রেম। এখানেও বিষয় বৈচিত্র্য। প্রেম, কাম, ক্রোধ, দর্শন, সংকেত, ইঙ্গিত, বাস্তবতা, দৃশ্য-অদৃশ্য কত বিষয়! সময়, সমাজ সংঘ- সব দেখার চোখটি ছিল স্বচ্ছ এবং বহুরৈখিক। অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধি কতটা গভীর হলে লিখতে পারেন- ‘আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে/নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক/সব সংঘ পরিষদ; চলে যাবে অত্যন্ত উল্লাসে/চলে যাবে এই সমাজ-সভ্যতার সমস্ত দলিল’। শুধু নেতিবাচকতা বা আশঙ্কার কথা নয়, সম্ভাবনার কথাও বলেছেন। ‘ভালো থেকো হুমায়ুন আজাদের একটি দীর্ঘ কবিতা, যেখানে তিনি বারবার শুভ কামনাই উচ্চারণ করেছেন। সংবেদনশীলতার মুগ্ধ উচ্চারণের পর বহু কবিতা আছে, সেগুলো আমাদের সমকালীন কবিতা সরণিকে বর্ণময় করেছে। তার প্রেমের কবিতাংশ এবং প্রবচনগুলো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। হুমায়ুন আজাদ পাঠে আমরা মনন চর্চা, সমাজ রাজনীতি ও সংস্কৃতির হাজারো বিষয় উপলব্ধি করার সুযোগ লাভ করছি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পাঠক হুমায়ুন আজাদকে গভীর অন্বেষণে দীর্ঘদিন মনে রাখবেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App