অশনি সংকেত
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০১৯, ০৯:৪০ পিএম
এবারের জগন্নাথ মহাবিদ্যালয়ের বৈশাখী উৎসবের প্রধান আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল ভাবনা ছিল নদী বিষয়ক সচেতনতাকে বৃদ্ধি করা। দেশবাসীর কাছে এই বক্তব্যকে তুলে ধরা যে ‘বাঁচলে নদী, বাঁচবে দেশ।’ এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে নদীমাতৃক এই দেশটি বর্তমানে মুমূর্ষু অবস্থায় উপনীত হয়েছে। আমাদের দেশটির ভৌগোলিক কাঠামো হচ্ছে যে এটি গাঙ্গেয় অববাহিকার বৃহত্তম ব-দ্বীপ। গঙ্গা নদীর পানির সাথে ভেসে আসা পলিমাটি জমে জমে সৃষ্টি হয়েছে এই অপরূপ উর্বরা ভূমির দেশটি। বাংলাদেশের ভূতাত্তিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রবহমান নদী। নদী মেখলা বাংলাদেশ। নদী ও বাংলাদেশ যেন সমার্থক শব্দ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অস্তিত্বের সাথে নদীপ্রবাহ মিশে আছে ওতপ্রোতভাবে। নদীর পলল স্তরের কারণে সুফলা হয়েছে এই দেশ। এ দেশের স্বপ্ন ও কল্পনায় মিশে রয়েছে নদী। এ দেশের জলজ সংস্কৃতি এ দেশের মানুষের চিন্তা-চেতনার জগতকে সমৃদ্ধ করেছে। দিয়েছে নতুন মাত্রা। নদীকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঠিকানা বলেও আখ্যায়িত করা যেতে পারে। পাকিস্তানি আধা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভের জন্য যে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার প্রধান স্লোগান ছিল, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা, মেঘনা যমুনা।’ মুক্তির জন্য উত্তাল নদী স্রোতের মতো গর্জে উঠিছিল এ দেশের সংগ্রামী জনতা।
বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতির চেতনায় প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করেছে নদী।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেছিলেন মধুমতির তীরে। নদীপ্রবাহ তাকে সঞ্জীবিত করেছি। নদী তাকে নতুন বোধ দিয়েছিল। তার অঞ্চলের নদীগুলো কুমার, গড়াই, গাঙদিয়াদহ, মাথাভাঙ্গা, আমলাসদরপুর, ডাকোয়া, বারাসিয়া, মধুমতি, পালং, আড়িয়ল খাঁ, নবগঙ্গা, চন্দনা, ইছামতি।
১৯৪৯ সালে একবার নবীনগর থেকে নৌকায় আসছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার সঙ্গে ছিলেন ভাওয়াইয়া গানের সম্রাট বলে পরিচিত আব্বাস উদ্দিন। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণা প্রকাশিত হয়েছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে। সেখানে ১১১ পৃষ্ঠায় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বর্ণনা করেছেন, ‘নদীতে বসে আব্বাস উদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তার নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে।’
এ দেশের প্রবাহিত নদীসমূহের কথা বঙ্গবন্ধুও অনুধাবন করতে পারতেন। তিনি এ দেশের নদীকেন্দ্রিক জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাক্সক্ষা, আনন্দ-বেদনার স্রোতকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এ দেশের শোষিত কৃষককুলের অবস্থা তাকে ব্যথিত করেছিল। পূর্ব পুরুষদের করতলে ছিল পলিমাটির সৌরভ। আর পৃষ্ঠদেশে ছিল শাসক-শোষকের আঘাতের নির্মম ক্ষতচিহ্ন। যে ক্ষতকে রক্তজবার উপমায় অংকিত করে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লিখেছিলেন :
‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল।’
এভাবেই এ দেশের সৃষ্টিশীল লেখক-কবিদের মাধ্যমে নদীমাতৃক দেশটির গণমানুষের জীবন ফুটে উঠেছে। নদীধারা এই জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। সমাজের অভ্যন্তরীণ পালা-বদলকে নদী-অববাহিকার লোকায়ত জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করেছে। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ চিত্রিত করেছেন-
‘শ্রাবণে মেঘ ডাকলে আকাশ চমকে ওঠে
নদীতে বান ডাকে
বৃষ্টি ঘাঁই মারে
ছোট মাছেল বুক কাঁপে।’
নদীর বান এ দেশের গ্রামীণ জীবনধারাকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছে। সামাজিক ভাঙনকে চিহ্নিত করেছে। সামাজিক শ্রেণিকে বিভক্ত করেছে। জীবনবাদী কথাসাহিত্যিক আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী তার উপন্যাস ‘বান’-এ এই জীবনধারাকে প্রবাহিত করেছিলেন।
নদীরা ক্রমশ বিপন্ন হয়েছে মানুষের প্রকৃতি বৈরী আচরণে। নদীর সাথে সাথে নারীরাও হারিয়ে ফেলেছে তাদের সকল ¯িœগ্ধতা। আ. জা. ওবায়দুল্লাহর কবিতায় সেই মর্মান্তিক রূপরেখা :
‘রমণী এখন নদীরা শুকিয়ে গেছে
ক্ষত-বিক্ষত ধূ-ধূ রৌদ্রের চরে
হিজল গাছেল আত্মায় লাশ ঝুলছে
ভাড়াড়ের গাড়ি তারে এসে নিয়ে যাবে।’
তেরশত নদী বয়ে যাওয়া দেশটিতে মানুষ পেয়েছিল সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা জীবনের সন্ধান। নদীকে বিপন্ন করে মানুষ আসলে বিপন্ন করেছে নিজেদের জীবনকেই। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে রিক্ত, অনুর্বর করে তুলেছে জনপদকে।
কবির কণ্ঠে তাই আর্তনাদের মতো উচ্চারিত হয় :
‘এখানে সংসার ছিল
গাছ পাখি নদী
পচানো পাটের গোছা
সজিনার ডাঁটা
ধান কুড়ানিয়া পাখি
লাউয়ের মাচান।’
নদীর অবিরাম বয়ে চলা মানুষের মনে গতিবেগের সঞ্চার করে। নদীর কূলের ভাঙাগড়া মানুষকে বিবাগী করে তোলে। নদীর বিশালতা, উদারতা মানুষের মনে নানা ভাবের উন্মেষ ঘটায়।
মার্কিন কিশোর সাহিত্যের অসাধারণ জনপ্রিয় গ্রন্থ মার্ক টোয়েনের ‘টম সয়্যারের অভিযান’ আর ‘হাকলবেরি ফিনে’র দুঃসাহসিক অভিযান। দুটি রচনাই আমাজান আর মিসিসিপি নদীর পটভূমিতে রচিত। ভেলায় করে খরস্রোতা নদী মিসিসিপিতে দুরন্ত স্বভাবের কিশোর নায়কের ভেসে চলার কাহিনী পাঠকদের মাঝে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। যেন এভাবে নদী বেয়ে সমুখপানে এগিয়ে যাওয়ার মাঝেই নিহিত রয়েছে জীবনের সার্থকতা। সাবলীলতা।
আমাদের দেশের কবি আহসান হাবীবের ‘মেঘনা পারের ছেলে’ও তেমনি একটি অনবদ্য রচনা। দুঃসাহসী টম সয়্যার যেমন মার্কিন দেশে মিসিসিপি নদী পাড়ি দিয়ে নায়কের শিরোপা পায় তেমনি আমাদের দেশের উত্তাল মেঘনা নদী পাড়ি দেয়া কিশোর ছেলেটিও নিঃসন্দেহে নায়কের মর্যাদায় ভূষিত হতে পারে। নির্ভীকতার প্রতীক রূপে গণ্য হতে পারে। দ্বিধাহীন চিত্তে এগিয়ে যাওয়ার রূপকে চিহ্নিত হতে পারে। এই কবিতাটি স্কুল পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য তা ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থীর মনে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
‘মেঘনা পারের ছেলে
আমি মেঘনা পারের ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
মেঘনা নদীর ঢেউয়ের বুকে
তালের নৌকা বেয়ে
আমি বেড়াই হেসে খেলে।
ইচ্ছে হলেই এপার থেকে ওপারে দেই পাড়ি
তালে তালে তালের নৌকা দুহাতে যাই বেয়ে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
পাহাড় সমান ঢেউয়ের বুকে নৌকা আমার ভাসে
মেঘ-মুলুকের পাহাড় থেকে ঝড়ের ঝাপটা আসে
আমার মাথার উপর মুচকি হাসে বিজলি নামের মেয়ে।’
বাংলাদেশে মেঘনা নদীর বিশাল প্রভাব রয়েছে। ময়মনসিংহের পুব অংশ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকা জেলার কিছু অংশ ও চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে মেঘনা নদী তার উপনদী ও শাখা নদীসহ প্রবাহিত। গঠিত হয়েছে মেঘনা-অববাহিকা অঞ্চল। নদী তীরেই গড়ে উঠেছে কৃষি সভ্যতা। কৃষি উৎপাদনে মগ্ন হয়েছে মানুষ। সংঘশক্তিতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে।
আল মাহমুদ প্রশ্নতাড়িত হয়ে নদীকে আবিষ্কার করেন এভাবে :
‘তোমার গোসল আমি দেখিনি কি একদা তিতাশে?
মনে পড়ে? শশ্মানঘাটের সেই সিঁড়ি ছুঁয়ে নেমে যাওয়া জল
ডোবায় সে পাদপদ্ম। সফরী পুঁটির ঝাঁক আসে
আঙুল ঠুকরে খেতে। নদী যেন নদীতে পাগল।’
কবিরা নদীকেন্দ্রিক জীবনধারাকে মানুষের বহমান জীবনের সাথে মূল্যায়ন করেছেন। নদী তখন অনিবার্যভাবে হয়ে উঠেছে স্বপ্নের সানুবীজ। রুশ সাহিত্যিক মিখাইল শলোকভ ডন নদীর তীরে গড়ে ওঠা মানুষের সংগ্রামী জীবনকে অপরূপ ভাষায় বিধৃত করেছিলেন। ডন নদীটি কীভাবে তার প্রবহমানতাকে মানুষের সংগ্রামী চেতনার মাঝে সঞ্চারিত করতে পেরেছিল। কবি আ. জা. ওবায়দুল্লাহ নদীর ভাঙা-গড়ার খেলাকে মূল্যায়িত করার সময় সাধারণ মানুষ ও তার সন্তানকে বিধৃত করেছেন এ রকমভাবে :
‘আসলে নদী এবং স্থলের মধ্যে
অনেক পারস্পরিক অপরাধের স্মৃতি আছে।
নদী তাকে আঘাত করে নদী তাকে ভালবাসে
নদী তার ঘর ভাঙে নদী তাকে পলি দেয়।
অথচ এক ঝাঁক বালক
যাদের সঙ্গে নদীর রাত্রিদিন দাপাদাপি
তারা এখনো ক্ষুধার্ত।’
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ আমাদের এই বিশাল দেশের নদীর ভূমিকা বিশাল। নদী এখানে এসেছে মায়ের স্তনের মতো পুষ্টির ¯েœহধারা নিয়ে।
‘যেমন প্রপাত থেকে অবিরল জল পড়ে
হেমন্তে শিশিরের মত
যেমন পাহাড় কেটে নদী নামে সমতটে
জননীর স্তন্যের মত।’
হিমালয় পর্বতের এক নির্জন উপত্যকায় গোমুখে গঙ্গা নদীর উৎপত্তি। হিমবাহ থেকে গঙ্গার জন্ম। তার দুপাশ থেকে অনবরত ভেঙে পড়ছে তুষারের চাঁই। সেই তুষার গলতে গলতে হয়েছে স্রোতস্বিনী। পরিচিত হয়েছে গঙ্গা নদী নামে। পদ্মা নদীর প্রকৃত নাম গঙ্গা।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
‘আমার নৌকা বাঁধা ছিল পদ্মা নদীর পারে,
হাঁসের পাঁতি উড়ে যেত মেঘের ধারে ধারে-
বালির পরে বয়ে যেত স্বচ্ছ নদীর জল,
তেমনি বইত তীরে তীরে গাঁয়ের কোলাহল-
ঘাটের কাছে, মাঠের ধারে, আলো-ছায়াতে স্রোতে,
অলস দিনের উড়নিখানার পরশ আকাশ হতে
পুবে হাওয়ার এল ঋতু, আকাশ জোড়া মেঘ,
ঘরমুখো ওই নৌকোগুলোয় লাগল অধীর বেগ।
ইলিশ মাছ আর পাকা কাঁঠাল জমল পারের হাটে,
কেনাবেচার ভিড় লাগল নৌকো-বাঁধা ঘাটে।
ডিঙি বয়ে পাটের আঁটি আনছে ভারে, ভারে,
মহাজনের দাঁড়িপাল্লা উঠল নদীর ধারে।
মেঘ ডাকছে গুরু গুরু থেমেছে দাঁড় বাওয়া
ছুটছে ঘোলা জলের ধারা, বইছে বাদল হাওয়া।’
রবীন্দ্রনাথ তার অপূর্ব চিত্রময় ভাষায় পদ্মা নদীর ছবি এঁকেছিলেন। আর নদীটি সেই বর্ণনাশৈলীর ভেতরে তরঙ্গায়িত হয়ে উঠেছিল। সেই নদী শুকিয়ে মৃতপ্রায় হয়েছে। নদীর শুকনো বুকে গরুর গাড়ি চলে। কবির উপমায় একদা যে নদী ছিল চিতলের পেটের মতো চিকচিকে। নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে বিনষ্ট হয়েছে আমাদের শস্যের দানা। বিস্তীর্ণ প্রান্তর হয়েছে বৃক্ষহীন। শস্যবীজ বোনা গেছে বিফলে।
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ নদীকিন্দ্রেক বাংলার লোকায়ত জীবনের স্বপ্ন দেখেছেন। সে স্বপ্নজুড়ে থাকে নদী।
‘হাওয়ায় মাটির গন্ধ শিকড়ের জটিল সুবাস
শিকড় নদীর মত বৃক্ষ লালন করে
যেমন মাছের শিশু জলাশয়ে বর্ধিত হয়
যেমন নদীর চিল ঢেউয়ের চূড়ার নাচে
মেঘের নদীরা ওড়ে মরালীর শুভ্র গ্রীবায়
শৈশব দুলে ওঠে বাওয়ালির নৌকার মত।’
বাংলাদেশের লোকায়ত জীবনের চিত্র তুলে ধরতে কবিরা বারবার নদী থেকে উপমা সংগ্রহ করেছেন। সৈয়দ শামসুল হক নদীর তরঙ্গের শব্দের মাঝে নিজের অস্তিত্বের উন্মোচন পর্বকে উপলব্ধি করে উচ্চারণ করেন- অথচ নদীর শব্দ নয়, গ্রাম থেকে উৎসবের ডাক নয়, নাকি দমকানো বাতাসে দরোজা? -তাহলে কি সে খুললো চোখ?
নদী এবং নৌকো কবিকে যেন নতুন চিত্রকল্প দেয়। বিশ্বাস দেয়। বোধশক্তি দেয়। তার কাছে স্বপ্নগুলো নদীকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে বলে উচ্চারণ করেন, ‘মাঝে মাঝে মনে হয় স্বপ্নগুলো আসলে নৌকা/এই দুঃখ দরিদ্র দিঘিতে অন্যপারে/ শৈশবের বাড়িতে ফিরে যাবার যান, আর কিছু নয়।’ যেনবা নৌযানই তাকে অনায়াসে নিয়ে যেতে পারে সোনালি শৈশবে।
আল মাহমুদের নগরীতে এসে প্রবল জিজ্ঞাসা হয়, ‘বত্রিশ সায়েদাবাদ, ঢাকা। তেমন নদী কই, যেটা মার বক্ষের উপমা?’
পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্বৈরশাসনের দরুণ নিজের মাতৃভূমিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হতে দেখেছিলেন। আবার এও দেখেছিলেন যে বাঙালি জাতি আত্মজাগরণের জন্য একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়নি। সৈয়দ শামসুল হক তখন স্বদেশকে তুলে আনেন নৌকোর প্রতীকে।
‘একটা নৌকো তার ভুলপিঠে,
কোটি স্বর্ণসত্তা নিয়ে সে যাচ্ছিল গোরস্তান দ্বীপে
কিন্তু পৌঁছায়নি।’
বাঙালির আশার আনন্দকে কবি রুপোলি মাছের প্রতীকে উদ্ভাসিত হতে দেখেন। বাঙালির সংগ্রামের সফল গন্তব্যকে চিহ্নিত করেন লোকায়ত ছড়ার আঙ্গিকে ‘ত্রিপূর্ণির ঘাটে।’ নদী থেকে চিত্রকল্প সংগ্রহ করেন। ‘আমাদের যারা বন্দি করে রাখে/তাদের ঘুমের খণ্ড খণ্ড চকিত সুযোগে গত রাতে বানানো নৌকো/পৌঁছে গেছে ত্রিপূর্ণির ঘাটে/জেগে উঠছে আশার জ¦লন্ত রোদ/বিহ্বল মাঝির জালে বিরাট রুপোলি মাছ ধরা পড়ে আচমকা লাফাচ্ছে।’
বিশাল রুপোলি মাছ এখানে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নের প্রতীক হয়ে উদ্ভাসিত হয়। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে যেমন তাঁর বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’তে কুব্যান সাগরের বিশাল মার্লিন মাছটিকে বৃদ্ধ মৎস্য শিকারির স্বপ্নের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছিলেন।
কবির বিবরণে :
‘আকাশের এক প্রান্ত থেকে উড়ে গেল চিল,
বিন্দু বিন্দু শব্দহীন চিল,
ভাঙনের জোছনায় নেমে এলো অপরাহ্ন এবং স্বপ্নগুলো
স্তম্ভিত নৌকোর মতো আছড়াতে লাগল তার নিচে,
যেন দাঁড়ানো যাবে না।’
সৈয়দ শামসুল হক লেখেন, ‘বাংলার যুবক ঘুমে/জননী ও কবি, রামসাগরের জলে/ছলছল ঘুম একা দাঁড় বেয়ে যায়- পদ্মার ইলিশ ঘুমে।
নদী মাতৃক এ দেশের লোক পুরাণ কাহিনী মনসা মঙ্গল নদী প্লাবিত অঞ্চলের আখ্যানভাগকে তুলে ধরে। বিদ্রোহী চাঁদ সওদাগরের সাহস আমাদের চমকিত এবং উদ্দীপিত করে। চাঁদ সওদাগর দেবতার বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই করে যান। মৃত পতির লাশ নিয়ে বেহুলার কলার মান্দাসে চড়ে গাঙুরের পথে যাত্রা যেন রহস্যলোকের প্রতি যাত্রা। সৈয়দ শামসুল হক সেই পুরাণ কাহিনীতে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখেন :
‘আমি জানি/মনসার ক্রোধ মানে মানুষের জয়/চাঁদ রাজা হার মানে/লৌহ বাসরের কালছিদ্রে চোখ রেখে আমি কাল রাতে/পূর্ণিমা ধবল দেহে আজো জেগে থাকি/
...কালীদহে ডুবে মরেছে যে বধূ তার গলায় দেখেছি/জলের মুক্তার হার, আমি তার স্বামী। আজীবন বসে আছি পাষাণ পৈঠায়।’
নদীর বুকে চরের জেগে ওঠাকে কবির কাছে বিশ্বাসের মতো প্রতীয়মান হয়। সামাজিক অবক্ষয় জনমানসে হতাশার গভীর আবর্ত সৃষ্টি করে। সংগ্রামের তীব্র ঢেউয়ের অভিঘাতে জীবন জেগে ওঠে হতাশার গর্ভ থেকে। এই বিশ্বাসকে কবি সৈয়দ শামসুল হক প্রকাশ করেন এভাবে :
‘আবার উঠব জেগে খরচৈত্রে চর
হয়ে তোমার পদ্মায়। পিঙ্গল জটায়
স্রোতের প্রপাত নিয়ে হেঁটে যাবো আমি
স্মৃতির সাগরে। জন্মে জন্মে বারবার
কবি হয়ে ফিরে আসব আমি বাংলায়।’
নদীমাতৃক দেশের পটভূমিকায় কবি নিজেকে শনাক্ত করেন নির্ভুলভাবে। দূরগামী পদ্মার মতোই ধীর। আত্মায় সঞ্চিত হয় পলিমাটি। বর্ষায় কোমল কাদা তাকে ভূমির পরিবেশ জানিয়ে দেয়।
বাংলার নদী, নৌকো তাকে শিল্প রূপময় করে তোলে। তার শোকের সমস্ত শিলা পরিণত হয় পদ্মার নৌকায়। তিনি যখন বাংলাদেশের নদীর কল্লোলিত রূপ অবলোকন করেন তখন আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে বলেন :
‘দিগন্তহীন ব্রহ্মপুত্রের মাঝখানে আমি,
চারদিকে তোমাদের জলের কল্লোল।
আমি কখনো দেখি, কেউ নৌকো নিয়ে চলে যায়
আমার পাড় ঘেঁষে।’
আর এভাবেই নানা বিচিত্র আঙ্গিকে নদী আমাদের সাহিত্যকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। সংযোজন করেছে নতুন ধারা।