×

মুক্তচিন্তা

ব্রেক্সিট সংকটে ব্রিটেন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০১৯, ০৯:২৫ পিএম

ব্রিটেনের সাধারণ মানুষ বিশেষত মধ্যবিত্ত এবং শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর একটা বিশাল অংশ বিদেশিদের হুট করে ব্রিটেনে আবাসন গড়াকে ব্রিটেনের জন্য এক বিশৃঙ্খল অবস্থা হিসেবেই বিবেচনা করেছে, যা তারা মেনে নিতে পারেনি। কারণ ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর কারণে স্কুলে আসন সংকট দেখা দেয়, আবাসন সংকট বৃদ্ধি পায়, কিছুটা হলেও অপরাধ প্রবণতা বাড়ে। একটা ধারণা তৈরি হয়েই যায়, এদের কারণেই দেশে বেকারত্বও বেড়েছে। সে জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের ব্রেক্সিট সমর্থন না করা সত্ত্বেও ব্রিটিশ জনগণের অধিকাংশ ভোটার বিচ্ছেদের পক্ষেই ভোট দেয়।

ব্রেক্সিট ইস্যু নিয়ে ব্রিটেন তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক কঠিন সময় পাড়ি দিচ্ছে এখন। গত দুই বছরেও ব্রিটেনের পার্লামেন্টে এ নিয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। পার্লামেন্টের সংসদ সদস্যদের একটা অংশ এখন এমনকি আবারো গণভোট চাইছে। বারবার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে তার বিল নিয়ে এসেছেন এবং এমপিদের ভোটে তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। অর্থাৎ ব্রিটেনের সংসদই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছে না গত দুই বছর থেকে। সিদ্ধান্তহীনতার কারণেই গত ১০ এপ্রিল আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে ব্রিটেনকে। এবং ব্রেক্সিটের সময় বাড়ানো হয়েছে আগামী ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত। এটি দ্বিতীয়বার সময় পেছানোর ঘটনা। প্রথম দফায় ২৯ মার্চ থেকে পিছিয়ে ১২ এপ্রিল করা হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এ রকম রাজনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েনি ব্রিটেন।

ব্রিটেনের এই ক্রান্তিকালে কীভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসবে দেশটি, চুক্তিগুলো কী হবে, ইউরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্রিটেন কি বাণিজ্যিক চুক্তি করতে গিয়ে হেরে যাবে। আসলেই কি হার্ড ব্রেক্সিটের মধ্য দিয়েই বেরিয়ে আসবে ব্রিটেন। অর্থাৎ ইউরোপের সঙ্গে কোনো যুক্তিসঙ্গত চুক্তি ছাড়া কিংবা কোনো প্রকার চুক্তি ছাড়াই কি বেরিয়ে আসতে হবে ব্রিটেনকে।

নাকি সফট ব্রেক্সিটের চুক্তিতে ব্রিটেন আবদ্ধ করতে পারবে ইউরোপের অন্য দেশগুলোকে। প্রধানত ইউরোপীয় অর্থনৈতিক জোন ও ইউরোপীয় ফ্রি ট্রেড এসোসিয়েশনের সদস্য দেশগুলো সিঙ্গল মার্কেট নীতির আওতাভুক্ত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশ হিসেবে বর্তমানে ইউরোপের ২৮টি দেশ এ সুবিধার মাঝেই চুক্তিবদ্ধ আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থেকে একমাত্র নরওয়ে সীমাবদ্ধ চুক্তির মাঝ দিয়ে হলেও এই সুবিধা নিচ্ছে। এই সুবিধায় পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও বাণিজ্যিক সুবিধা নিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। শুধু বাণিজ্যিক সুবিধা পেতেই ব্রিটেন চাইছে কাস্টম ইউনিয়নের নীতির সুবিধাটাও। গোটা বাণিজ্যিক আদান-প্রদান ব্যবসায়িক ট্যারিফ কিংবা নীতিমালা মূলত প্রণয়ন করে থাকে কাস্টমস ইউনিয়নই। সুতরাং বলতে গেলে, কাস্টমস ইউনিয়ন কিংবা সিঙ্গল মার্কেটই গোটা ব্রেক্সিটের মূল আলোচনার বিষয়। অথচ ব্রিটেনের পার্লামেন্ট এ নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারছে না। বারবার প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন, ব্রেক্সিট ডিল নিয়ে তিনি বিরোধী দল তো বটে, এমনকি তার দলের এমপিদের বিরোধিতার মুখে পড়েছেন, পার্লামেন্টে তার দলের এমপিরাই তার বিপরীতে ভোট দিচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবে তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নও এ সুযোগে ছাড় দিচ্ছে না ব্রিটেনকে। তারা চাইছে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ হোক হার্ড ব্রেক্সিটের মধ্য দিয়েই।

অথচ ব্রিটেন যখন বিচ্ছেদ নিয়ে জনগণের মুখোমুখি হয়েছিল ২০১৬ সালে, তখন জনসম্মুখে এ ইস্যুগুলো রাজনীতিবিদরা তুলে ধরতে পারেননি। কিংবা সচেতনভাবেই তুলে ধরেননি। ব্রেক্সিটপন্থিরা শুধুই জনগণকে দেখিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ব্রিটেনের একীভূত থাকায় ব্রিটেন বছর বছর মিলিয়ন-বিলিয়ন পাউন্ড গচ্ছা দিচ্ছে। কিন্তু বিনিময়ে কী নিয়ে আসছে, বাণিজ্য করতে গিয়ে রাষ্ট্র কতটুকু পাচ্ছে, তার বিস্তারিত তারা তুলে ধরেননি। তারা শুধুই বিচ্ছেদ চেয়েছেন। সামনে এনেছেন তখন কিছু সমসাময়িক ইস্যু, যা তারা জনসাধারণকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। মূলধারার রাজনীতিবিদদের অধিকাংশ নেতাই ব্রেক্সিট চাননি। তাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেবিড ক্যামেরুন, আজকের বিরোধীদলীয় নেতা জেরেমি করবিনসহ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতিবিদ ব্রেক্সিটের বিরোধিতা করেছেন। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষেই তাদের ক্যাম্পেইন চালিয়েছিলেন। কিন্তু তারা হেরেছেন।

ব্রিটেনের সাধারণ মানুষ বিশেষত মধ্যবিত্ত এবং শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর একটা বিশাল অংশ বিদেশিদের হুট করে ব্রিটেনে আবাসন গড়াকে ব্রিটেনের জন্য এক বিশৃঙ্খল অবস্থা হিসেবেই বিবেচনা করেছে, যা তারা মেনে নিতে পারেনি। কারণ ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর কারণে স্কুলে আসন সংকট দেখা দেয়, আবাসন সংকট বৃদ্ধি পায়, কিছুটা হলেও অপরাধ প্রবণতা বাড়ে। একটা ধারণা তৈরি হয়েই যায়, এদের কারণেই দেশে বেকারত্বও বেড়েছে। সে জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের ব্রেক্সিট সমর্থন না করা সত্ত্বেও ব্রিটিশ জনগণের অধিকাংশ ভোটার বিচ্ছেদের পক্ষেই ভোট দেয়। বিচ্ছেদের বিপরীতে অবস্থান নেয়া তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন তার হার মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং তার পার্টির নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। এমনকি রাজনীতি থেকেই বলতে গেলে তিনি অন্তর্হিত হয়ে আছেন।

কি হতে পারে ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ ব্রেক্সিট হওয়াটাই হয়তো যৌক্তিক, কারণ জনগণ তা-ই চেয়েছে। কিন্তু জনগণের সেই আস্থার জায়গাটা রাজনীতিবিদরা রক্ষা করতে পারছেন না। আর সেজন্যই ব্রেক্সিটের পক্ষে রাত-দিন নিরন্তর কাজ করা তেরেসা মের দলের জনপ্রিয়তা নেমে আসছে প্রতিনিয়ত। দেখা যাচ্ছে, আসন্ন ইইউ নির্বাচনে মাত্র ১৭ শতাংশ মানুষ কনজারভেটিভ প্রার্থীদের ভোট দেবে। লেবার দলকে দেবে ২৪ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে শুধু ব্রেক্সিট ইস্যু নিয়ে নবগঠিত দল নাইজেল ফারাজের ব্রেক্সিট পার্টি বিস্ময়করভাবে ১৪ শতাংশ ভোট পেয়েই যাবে।

গণতন্ত্রের পথচলায় যদি নাইজেল ফারাজের দল একটা প্রধান ফ্যাক্টর হয়ে বেরিয়ে আসে, তা হলে তা ব্রিটেনের রাজনীতির জন্য কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত নয়। কারণ নতুন দল গঠন করে ইউকিপ ত্যাগ করার সময় নাইজেল ফারাজের গড়া ইউকিপকে তিনি নিজেই বলেছেন, সেখানে ডানপন্থিরা ভর করেছে। আর সে জন্য ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে ধারণ করেই ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিকেও সেই ডানদের যে কোনো এগিয়ে যাওয়াকে রুখতে হবে।

২৩ থেকে ২৬ মে অনুষ্ঠিতব্য ইইউ নির্বাচনে ব্রিটেন যাতে অংশ না নিতে পারে, সে জন্য তেরেসা মে এর আগেই ব্রেক্সিট অর্থাৎ ব্রিটেনের বিচ্ছেদ ঘটাতে চান। আদৌ কি পারবেন? উত্তরটা ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের হাতেই। কারণ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদের মতৈক্যই ব্রিটেনের এই লেজেগোবরে অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে। এই দুঃসময় থেকে উত্তরণে সে জন্য তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App