×

জাতীয়

শ্রবণশক্তির মৃত্যুদূত!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০১৯, ১০:২৬ এএম

শ্রবণশক্তির মৃত্যুদূত!
সহনীয় মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ তীব্রতার শব্দে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রাজধানী ঢাকার অর্ধকোটির বেশি মানুষ। প্রতিদিনই নাগরিকদের বিরক্তিবোধ, মাথাধরা, মেজাজ খারাপ, ঘুমের ব্যাঘাতসহ নানা মনোদৈহিক সমস্যা সৃষ্টি করছে এই শব্দদূষণ। নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এমনকি ব্যক্তি আচরণে। ঝুঁকি বাড়াচ্ছে হৃদরোগের। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে নানামুখী আইন আর উচ্চ আদালতের দুদফায় নির্দেশনা জারির পরও প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না নীরব এই ঘাতককে। বরং উচ্চ শব্দে মাইক বাজানোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে হামলার শিকার, এমনকি প্রাণ হারাতেও হচ্ছে কাউকে কাউকে। এভাবে শব্দদূষণের তীব্রতা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০২১ সালের মধ্যে রাজধানীর মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগই কানে কম শুনবেন। যাদের একটি অংশ পুরোপুরিই বধির হয়ে যাবেন বলে আশঙ্কা চিকিৎসকদের। এ পরিস্থিতিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের একমাত্র ভরসা জনগণের সচেতনতা আর অভ্যাসের বদল। এই প্রেক্ষাপটে আজ বুধবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শব্দ সচেনতা দিবস। এবারের শব্দ সচেতনতা দিবসের প্রতিপাদ্য : ‘শ্রবণযন্ত্রের সুরক্ষা, স্বাস্থ্যের সুরক্ষা’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংকের একাধিক গবেষণায় সারা বিশ্বের মানুষের ৩০টি কঠিন রোগের অন্যতম কারণ হিসেবে শব্দদূষণকে চিহ্নিত করা হয়েছে। উচ্চমাত্রার শব্দে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাসসহ শিক্ষার্থীদের নিবিষ্টচিত্তে বুদ্ধিদীপ্ত কাজ করার ক্ষেত্রে ভয়াবহ সমস্যা দেখা দেয়ায় মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্কস ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট (ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট) পরিচালিত এক গবেষণা মতে, রাজধানীতে শতকরা ৯৭ শিক্ষার্থীর পড়াশোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে গাড়ির হর্ন। অন্যদিকে শব্দদূষণকে বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন শতকরা ৮৬ ভাগ মানুষ। গেল বছরে প্রকাশিত পরিবেশ অধিদপ্তরের সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদনে ঢাকাসহ দেশের আট বিভাগের শব্দদূষণের ভয়াবহ চিত্রে গাড়ির হর্নকে শ্রবণশক্তির ভয়াবহ ঘাতক হিসেবে দেখানো হয়েছে। প্রতিবেদনে রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় হর্ন বাজানোর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে প্রতি ১০ মিনিটে যে ৫৯৮টি হর্ন বাজানো হয় তার মধ্যে হাইড্রোলিক হর্ন ১৫৮টি এবং সাধারণ ৪৪০টি। তবে এ চিত্র শুধু শ্যামলীতেই নয়, গোটা রাজধানীসহ আটটি বিভাগীয় শহরেই দেখা গেছে। তীব্র মাত্রার এ হর্ন বাজানো থেকে ক্ষতির শিকার হয়ে চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হচ্ছেন রাজধানীর ৯ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র এলাকাভেদে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত শব্দের সহনীয় মাত্রা ৫০-৭০ ডেসিবেল হলেও ঢাকার সর্বত্র তা ১৩৫ ডেসিবেল ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষত নীরব হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় শব্দের তীব্রতা সহনীয় মাত্রার দ্বিগুণ, তিনগুণ পর্যন্ত দেখা গেছে। অতিরিক্ত মাত্রার এ শব্দে বধিরতা, মেজাজ খিটমিটে, উগ্রতা, হৃদরোগসহ মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়ায় এ সংক্রান্ত রোগী দিন দিন বাড়ছে। রাজধানীর ভয়াবহ শব্দদূষণ এলাকা শাহবাগে দেশের বৃহৎ দুটি চিকিৎসাকেন্দ্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল (পিজি) ও বারডেম হাসপাতালে রোগীদের অভিযোগ, মারাত্মক শব্দের কারণে তারা শান্তিতে ঘুমাতে পারেন না। শব্দের প্রচণ্ডতায় হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠেন। জানতে চাইলে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু ভোরের কাগজকে বলেন, শব্দদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত রোগীর সংখ্যা মারাত্মকভাবে বাড়ছে। একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি জানান, দূষণের এ মাত্রা অব্যাহত থাকলে আগামী দুই বছরের মধ্যে রাজধানীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যাদের একটি বড় অংশ বধির হয়ে যেতে পারে। শব্দদূষণের প্রাকৃতিক উৎস যেমন বাজ পড়া বা মেঘের গর্জন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলেও মনুষ্যসৃষ্ট শব্দদূষণ পুরিপুরিই আয়ত্তে আনা সম্ভব। নিয়ন্ত্রণযোগ্য এসব শব্দদূষণের প্রধান কারণ হচ্ছে গাড়ির হর্ন। পাশাপাশি ইটভাঙার মেশিন, জেনারেটরসহ কলকারখানা, বিমান উড়া, ট্রেনের হুইসেল, মিউজিক বা মাইক, আতশবাজি থেকে শব্দদূষণ ঘটছে। তবে রাজধানীতে শব্দদূষণের ভয়াবহতার জন্য দায়ী যানবাহন ও এর হর্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, শব্দদূষণের কারণে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থী, শিশু, হাসপাতালের রোগী, ট্রাফিক পুলিশ, পথচারী ও গাড়িচালকরা। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে প্রণীত ‘শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬’-এর আওতায় রাজধানীতে নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ ও অপরাধে শাস্তির বিধান রাখা হলেও তার প্রয়োগ নেই। আইনে পরিবেশ অধিদপ্তরের বাইরে প্রত্যেক থানার ওসিকে আইন প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়া হলেও তা জানেন না অনেকেই। তা ছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) শব্দদূষণ বন্ধে ২০১৭ সালে উচ্চ স্বরে গানবাজনা বা জনসভার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার বিধান করলেও তার প্রয়োগ নেই। ঢাকার নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ বসবাস নিশ্চিত করতে মহানগরী অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর ২৭ ও ৩১ ধারায় অনুমোদন ছাড়া জনসভা, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিধিনিষেধ থাকলেও তা মানা হয় না। ১৯৯৭ সালের পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকার নির্ধারিত প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত নীরব হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় মোটরগাড়ির হর্ন বাজানো বা মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলেও তার কোনো প্রয়োগ নেই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সর্বশেষ হিসাব মতে, রাজধানীতে নিবন্ধিত যন্ত্রচালিত যানবাহনের সংখ্যা বর্তমানে ১৪ লাখের মতো। যার মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যাই প্রায় পাঁচ লাখ। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখের মতো। নিবন্ধিত বাসের সংখ্যা প্রায় ত্রিশ হাজার। তবে প্রতি মাসেই ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দেড় হাজার করে বাড়ছে। এর পাশাপাশি সারা দেশে নিবন্ধিত ট্রাক, কার্গো ও কাভার্ড ভ্যান আছে প্রায় দুই লাখের মতো। যাদের প্রায়গুলোতেই ব্যবহার করা হয় উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টিকারী হাইড্রোলিক হর্ন। চালকদের অসচেতনতায় রাস্তায় চলতে গিয়ে কারণে-অকারণে এসব হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতা চলে। ভয়াবহ শব্দদূষণ সৃষ্টিকারী এসব হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে নির্দেশনা চেয়ে ২০১৭ সালে রিট করা হলে হাইকোর্ট রাজধানীতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তা বন্ধের নির্দেশনা দেন। আদেশে হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া বাজারে যেসব হর্ন আছে সেগুলো সাতদিনের মধ্যে জব্দের নির্দেশ দেয়া হয়। ওই ঘটনার কয়েক মাস পর হাইড্রোলিক হর্ন উৎপাদন বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা চেয়ে রিট করা হয়। সে সময় হাইকোর্ট রাজধানীর আবাসিক ও ভিআইপি এলাকায় রাত ১০টার পর সব হর্ন বাজানো বন্ধ ও ২০ কিলোমিটার বেশি গতিতে গাড়ি চালানোতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সড়কে তদারকি টিম গঠনের নির্দেশনা দেয়া হয়। এরপর কয়েক দফায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শব্দদূষণ সৃষ্টিকারী হর্ন জব্দ করা হয়। তবে গত দুবছরে হাইড্রোলিক হর্নের লাগামছাড়া ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল এমনকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়িগুলোতে অবাধে লাগানো হয়েছে নিষিদ্ধ হাইড্রোলিক হর্ন। শব্দদূষণকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে এসব হর্ন। যানবাহনে নিষিদ্ধ হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের বিষয়টি জানতে চাইলে বিআরটিএর রোড সেফটি শাখার পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধ করে দিয়েছি। এটি বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে শব্দদূষণ প্রতিরোধে আপাতত জনসচেতনতা ও সংশ্লিষ্টদের অভ্যাস বদলের ওপরই নির্ভর করছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। জানতে চাইলে অধিদপ্তরের পরিচালক (আইটি) ফরিদ আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিতভাবে কাজ করার একটা প্রস্তাবনা আছে। এটা বাস্তবায়ন হলে জনসচেতনা যেমন বাড়বে তেমনি শব্দদূষণ সৃষ্টির অভ্যাসের বদল ঘটবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App