×

মুক্তচিন্তা

লঙ্কার কলঙ্ক ঘুচাবে কে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০১৯, ০৮:৫৫ পিএম

শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডেতে গির্জায় হামলা আমাদের মনে করিয়ে দিল, একের ধর্ম বিশ্বাস অন্যের বিশ্বাসের সঙ্গে বিভেদ সৃষ্টি না করে পরস্পরে প্রীতি সঞ্চার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা আজ জরুরি। নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনে ব্যস্ত পৃথিবীর মানুষ অন্য ধর্মবিশ্বাসীর ধর্মীয় আচার-আচরণকে সম্মান করে নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্কের বিকাশ ত্বরান্বিত করবে, এটাই তো কাম্য। অনগ্রসর কিংবা নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকা এবং মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা মানব ধর্মের অন্যতম কাজ।

গত ২১ এপ্রিল যখন আমরা বাংলাদেশে ইস্টার সানডের প্রার্থনা শেষ করে ঘরে ফিরছি তখন শ্রীলঙ্কায় ঘটে গেছে ভয়াবহ জঙ্গিবাদী হামলা। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাতি জায়ান চৌধুরীসহ ৩৫৯ জনের মৃত্যুর খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। স্তম্ভিত মানুষ তার পর ধীরে ধীরে আরো অনেক সংবাদ জেনেছেন। বাংলাদেশের শিশু জায়ানের মতো শ্রীলঙ্কায় বেড়াতে গিয়ে সিরিজ বোমা হামলায় তিন সন্তানকে হারিয়েছেন ডেনমার্কের সবচেয়ে ধনী, বেস্টসেলার কোম্পানির মালিক আন্দ্রেস হোলচ পোভলেসেন। মৃত্যুবরণ করেছেন পরিবারসহ ছুটি কাটাতে যাওয়া আরো অনেকেই। ওই হামলায় আহত হয়েছেন ৫০০র বেশি মানুষ, যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হতে পারেন। ইস্টার সানডের প্রার্থনার মধ্যে গির্জা ও হোটেল মিলিয়ে আটটি স্থানে বোমা হামলায় রক্তাক্ত ভারত সাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্রের কলঙ্ক এখন কে ঘুচাবে? কেবল হতাহত মানুষের সংখ্যা বিবেচনায়ই নয়, বরং এর ব্যাপকতার বিচারেও এই হামলাকে গত এক দশকের এবং সম্ভবত গত কয়েক দশকের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলা বলা হচ্ছে। একসঙ্গে ছয়টি হামলা চালানোর ঘটনায় স্পষ্ট যে এটি একটি একক গোষ্ঠীর হামলা এবং অত্যন্ত পরিকল্পিত। হামলার অন্যতম লক্ষ্য ছিল খ্রিস্টধর্মাবলম্বী এবং বিদেশি পর্যটকরা। দিন হিসেবে এমন দিন বেছে নেয়া হয়েছে, যার ব্যাপক ধর্মীয় তাৎপর্য আছে। এমন সব হোটেলে হামলা হয়েছে, যাতে করে এর অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া হয় ব্যাপক। উল্লেখ্য, পর্যটন শিল্পে শ্রীলঙ্কা অগ্রগামী একটি দেশ। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হার এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিক থেকে এর অবস্থান অনেক উঁচুতে।

লেখা বাহুল্য, হামলার ঘটনাদৃষ্টে মনে হয়েছে এর সবটাই ছিল পরিকল্পিত; সফল হয়েছে সন্ত্রাসীরা। হামলায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৬ জন বিদেশি রয়েছেন। শ্রীলঙ্কার ‘ন্যাশনাল তওহিদ জামায়াত’ নামের একটি সন্ত্রাসী মতাদর্শ প্রচারক দলকে টার্গেট করে তদন্ত করা হচ্ছে। বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আইএস আত্মঘাতী বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করেছে। ২৬ বছর স্থায়ী গৃহযুদ্ধের বিভীষিকা কাটিয়ে দেশটিতে যখন এক দশকব্যাপী শান্তি ফিরেছে তখনই এ ঘটনা মানবতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ২০০৯ সালের পর শ্রীলঙ্কায় এত বড় রক্তপাত এটিই প্রথম। অবশ্য গৃহযুদ্ধের সময় ১৯৯৫ সালে একই রকম একটি হামলায় মারা গিয়েছিলেন ১৪৭ জন খ্রিস্টান নাগরিক। কিন্তু দেশটিতে যখন আপাত শান্তি বিরাজ করছে সেই সময় প্রায় ৩০০ নিরীহ নাগরিকের প্রাণহানি, তাও ধর্মীয় উপাসনালয়ে- হতবাক করেছে পুরো বিশ্বকে। মনে করিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী ঘটতে থাকা সন্ত্রাসী ঘটনাগুলোতে প্রাণ হারানো মানুষের করুণ মুখোচ্ছবি।

চলতি বছর ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে নামাজের সময় এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ৫১ জন নিরীহ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার মানুষগুলোর কোনো অপরাধ ছিল না। যেমন ২০১৬ সালে বাংলাদেশের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হত্যাকাণ্ডের শিকার নিরীহ বিদেশিরা নিরপরাধ ছিলেন। সারা পৃথিবীতে এই একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতির যুগে এসেও ধর্মের সংস্কার মানুষকে উৎকট ও বীভৎস পশুতে পরিণত করেছে। গত বছর জানুয়ারিতে নাইজেরিয়ার এক মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ১১ জনের মৃত্যু হয়। সেখানেও ফজরের নামাজের সময় ঘটনাটি ঘটে। হামলায় মসজিদটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ২০১৭ সালের নভেম্বরে ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী জঙ্গিরা মিসরের সিনাই প্রদেশে জুমার নামাজের সময় মসজিদে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ৩০৫ জনকে হত্যা করেছে। বর্বর ওই হামলায় আহত হন অন্তত ১৬০ মুসল্লি। সুফি সমর্থকরা নিয়মিত ওই মসজিদে প্রার্থনা করতে আসেন। জিহাদের নামে জঙ্গিবাদ দেশে দেশে সাধারণ মুসলমানদের হত্যা করাকে কর্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। ইসলামের নামে জঙ্গিবাদের বিকাশ ঘটিয়ে শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা সৃষ্টি করেছে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের পেশোয়ারে শিয়া মসজিদে তালেবান জঙ্গিদের হামলায় নিহত হন ১৯ জন। একই বছর দুই সপ্তাহ আগে সেই দেশের সিন্ধু প্রদেশের শিকারপুর জেলার একটি শিয়া মসজিদে হামলায় ৬১ জনের বেশি মানুষ নিহত হন। ২০১৬ সালের ৪ জুলাই জেদ্দায় আত্মঘাতী হামলা চালানোর পর সন্ধ্যায় মদিনায় পবিত্র মসজিদে নববীতে আত্মঘাতী হামলা চালানো হয়। এতে মসজিদে নববীর চারজন নিরাপত্তারক্ষী ও হামলাকারী নিহত হয়। একই সময়ে পূর্বাঞ্চলীয় কাতিফ শহরের একটি শিয়া মসজিদেও আত্মঘাতী হামলা চালানো হয়। এতে হামলাকারী মারা যায়। আফগানিস্তানের একাধিক মসজিদে গত এক দশকে শতাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০১০ সালে ১৫ ব্যক্তি থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের নভেম্বরে ২৩ জনের খুন ছাড়াও আরো অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনা আছে সেখানকার মসজিদ কেন্দ্রিক হামলা ও বিস্ফোরণে।

স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে ধর্মে ধর্মে কিংবা একই ধর্মের ভেতর মতাদর্শগত বিতর্কের কারণে মানব সমাজে সম্প্রীতি ও শোষণমুক্ত রাষ্ট্র কাঠোমো ভেঙে পড়ছে। বরং অসত্য, অমঙ্গল, অকল্যাণের রাহুগ্রাস ছেয়ে ফেলছে জীবনকে। ধর্মীয় উগ্রবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সর্বধর্ম সম্প্রদায়ের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে জাগ্রত করতে হলে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সৃষ্টির বিকল্প নেই। এশিয়ার মধ্যে ভারত, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার দুই বৃহৎ ধর্ম-সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমান পরস্পর বিভেদে জড়িয়ে পড়েছে বারবার। এর পশ্চাতে আছে কতিপয় রাজনৈতিক দলের ইন্ধন। এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ সচেতন মানুষকে ব্যথিত করে। প্রত্যেক ধর্মের বোধবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন মানুষ হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ সম্প্রীতি প্রত্যাশা করেন। একইভাবে ইউরোপ-আমেরিকায় যে মানবতাবাদের জয় ঘোষিত হয়েছিল তা কতিপয় জঙ্গিবাদী সংগঠনের তৎপরতায় বিনষ্ট হতে চলেছে। এজন্য মানব ধর্মের চর্চা আরো বেগবান করার সময় এসেছে। আসলে একবিংশ শতাব্দীতে মানবতা, বহুমাত্রিক ঐতিহ্য-পরম্পরা, বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ও সাম্যচিন্তা আমাদের সমাজব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এই বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার জন্য দরকার সামাজিক স্থিতিশীলতা। অসহিষ্ণু পৃথিবীর ধর্মীয় মৌলবাদিতা দূর করার জন্য মানুষে মানুষে মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় করা জরুরি। আর এর জন্যই দরকার বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ। যদিও বর্তমান বিশ্বে ধর্মের উদার বাণীগুলো পৃথিবীর সর্বত্রই বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।

শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডেতে গির্জায় হামলা আমাদের মনে করিয়ে দিল, একের ধর্ম বিশ্বাস অন্যের বিশ্বাসের সঙ্গে বিভেদ সৃষ্টি না করে পরস্পরে প্রীতি সঞ্চার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা আজ জরুরি। নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনে ব্যস্ত পৃথিবীর মানুষ অন্য ধর্মবিশ্বাসীর ধর্মীয় আচার-আচরণকে সম্মান করে নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্কের বিকাশ ত্বরান্বিত করবে, এটাই তো কাম্য। অনগ্রসর কিংবা নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকা এবং মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা মানব ধর্মের অন্যতম কাজ। দায়বদ্ধতা, সাহস ও উদারতা দিয়ে আমাদের নতুন বিশ্বসমাজ গড়ে তুলতে হবে। কারণ বিশ্বসমাজ পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা অনুভব করছে শ্রীলঙ্কায় সিরিজ বোমা হামলার পর। অর্থাৎ স্বতন্ত্র ও ভিন্নতা সত্ত্বেও মানুষ বহুত্ববাদে বিশ্বাসী; একত্রে থাকতে আগ্রহী। প্রকৃতপক্ষে অমানবিক সমাজ ও রাষ্ট্রে মানবতা দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। আজ বিশ্বজাগতিক ভ্রাতৃত্ব আমাদের ঐক্যসূত্রে বেঁধেছে। এজন্য সামাজিক জীবনে একে অপরের প্রতি প্রীতি-মমতা প্রদর্শন করতে হবে। ধর্মের ভিন্নতা ঈশ্বরেরই দান এবং সেই পরিচয় সবাই মেনে নিয়েই বেঁচে থাকি। ভিন্নতার মাঝে ঐক্যের সুর বাজে প্রাণে- এজন্য ধর্মীয় উগ্রবাদিতা তথা সন্ত্রাসী হামলার পরিসমাপ্তি চাই আমরা।

ড. মিল্টন বিশ্বাস : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App