×

জাতীয়

বহিরাগতদের দখলে শেবাচিম হাসপাতাল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০১৯, ১২:২৩ পিএম

বহিরাগতদের দখলে শেবাচিম হাসপাতাল
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের উন্নত চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে গত বছর ২২৬ জন নতুন জনবল নিয়োগ দেয়া সত্ত্বেও প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না আগত রোগীরা। বরং নিত্যনতুন অনিয়মের খবর বের হচ্ছে সর্ববৃহৎ চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র এই হাসপাতালটিতে। একের পর এক অনিয়মতান্ত্রিক ঘটনায় মানুষ আস্থা হারাচ্ছেন এ চিকিৎসাকেন্দ্রটির ওপর। চিকিৎসকদের অবহেলা, কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারিতা, ওষুধ ও খাবার চুরি এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী রোগী ও তাদের স্বজনরা অভিযোগ জানালেও আজ পর্যন্ত কোনো অভিযোগেরই প্রতিকার মেলেনি। সরকারিভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ সরবরাহ করা হলেও তা জুটছে না রোগীদের ভাগ্যে। এসব ওষুধ বাইরে বিক্রি করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন কতিপয় কর্মচারী ও শেবাচিমের সামনের একশ্রেণির ওষুধ ব্যবসায়ী। অভিযোগ রয়েছে, অপারেশন থিয়েটার থেকে একশ্রেণির অসাধু চিকিৎসকের সহযোগিতায় কতিপয় ব্রাদারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ওষুধ পাচার হচ্ছে বাইরে। বিশেষ করে হাসপাতালের ৫ তলার সার্জারি অপারেশন থিয়েটারের কয়েকজন ব্রাদার, অর্থপেডিক্স ওটির এমএলএসএস এবং সুমন নামে এক বহিরাগত ব্যক্তি রয়েছেন ওষুধ চুরির শীর্ষে। এ ছাড়া বেশ কিছু চিকিৎসকও রয়েছেন তাদের সহযোগী হিসেবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোগীর এক স্বজন বলেন, অপারেশন থিয়েটারে যেসব ওষুধ বাইরে থেকে কেনা হয় তার বেশির ভাগই থিয়েটারের মধ্য থেকে গায়েব করে দেন কতিপয় ব্রাদার। আর এ কর্মকাণ্ডগুলো ওটিতে থাকা কয়েকজন ডাক্তারের সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সূত্রমতে, অপারেশনের রোগীদের জন্য বর্তমানে প্রায় সব ওষুধ সরকারিভাবে সরবরাহ করা হলেও ছোট-খাটো অপারেশনের জন্য রোগীর স্বজনদের হাতে তুলে দেয়া হয় লম্বা একটা স্লিপ। অতি সম্প্রতি হাসপাতালে রোগীদের ওষুধ ও খাবার চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় দুই কর্মচারীকে হাতেনাতে আটক করে হাসপাতালের নিরাপত্তা কর্মী ও পুলিশ। হাসপাতালের প্রধান ফটকের সিঁড়ির নিচ থেকে কর্মচারী বহিরাগত সালমা বেগম ও বাহাদুর হোসেন নামে ২ জনকে আটক করা হয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে লোকবল সংকটের নামে কতিপয় চিকিৎসক অনিয়মকেই নিয়মে পরিণত করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আটককৃত ওই দুই ব্যক্তি হাসপাতালের কোনো স্টাফ না হলেও তারা নিয়মিতই ডাক্তারদের বিশেষ কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। ডাক্তাররা ছোট-খাটো কাজ এদের দিয়েই করাতেন। এর বিনিময়ে তারা ডাক্তারদের মাধ্যমে হাসপাতাল থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতেন। এদের বড় একটি চক্র গড়ে উঠেছে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে। ডাক্তারদের কাছ থেকে রোগীদের ওষুধের স্লিপে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ লিখে বাইরে থেকে কিনে আনতে বলতেন বাহাদুর। রোগীর স্বজনরা ওষুধ বাইরে থেকে কিনে দিলেও তা রোগীর শরীরে ব্যবহার করা হতো না। প্রতিদিনই হাজার হাজার টাকার ওষুধ ও খাবার বাইরে বিক্রি করত ওই চক্রটি। দুজনকে আটক করা হলেও এ চক্রের মূল হোতারা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সূত্রমতে, ৫ তলা থেকে প্রথমে সিঁড়ি দিয়ে একটি বাজারের ব্যাগ নিয়ে নামতে থাকেন চিকিৎসকদের দালাল বাহাদুর। ব্যাগটি দেখে নিরাপত্তা কর্মীদের সন্দেহ হওয়ায় কর্তব্যরত কর্মচারীরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। একপর্যায়ে বাহাদুর নামে ওই সন্দেহভাজন ব্যক্তির ব্যাগ তল্লাশি করে হাসপাতালের বিপুল পরিমাণ ওষুধ পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসাবাদে বাহাদুর বলেন, হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে ওষুধগুলো বাইরে বিক্রির জন্য দিয়েছেন। তবে কোন চিকিৎসকরা দিয়েছেন তার নাম বলেননি বাহাদুর। এর কিছুক্ষণ পরেই সালমা বেগম নামে এক বৃদ্ধ নারী হাতে করে দুটি বাজারে ব্যাগ নিয়ে সিঁড়ি থেকে নেমে যাওয়ার সময় তাকেও সন্দেহ হলে ডেকে ব্যাগ তল্লাশি করে দেখা যায়, রোগীদের দেয়ার জন্য ডিম, মাংস, মাছ, ডাল, আলুসহ বিভিন্ন খাবার রয়েছে। পরে তাকেও আটক করে মেডিকেলে দায়িত্বে থাকা এসআই নাজমুলের সহযোগিতায় কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। সূত্রে আরো জানা গেছে, মাত্র একদিনের মধ্যেই অদৃশ্য কারণে আটককৃতরা মুক্তি পেয়ে যান। হাসপাতালের কর্মচারী শাকিল ইসলাম বলেন, শুধু এই দুই ব্যক্তিই নন, হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে শুরু করে ৫ তলায় অপারেশন থিয়েটারে রয়েছে বহিরাগত দালালের ছড়াছড়ি। এগুলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেখে না ভান করছে। এ ব্যাপারে হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাকির হোসেন বলেন, হাসপাতাল থেকে ওষুধ ও খাবার পাচারের সময় আটককৃত দুজনকেই পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আটককৃতরা কেউ আমাদের হাসপাতালের কর্মচারী নন। এ ধরনের আরো কেউ থাকলে বা হাসপাতালের কেউ তাদের প্রশ্রয় দিলে তাদের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন বিভাগের ইনচার্জের কক্ষে মজুদ করা বিপুল পরিমাণ সরকারি ওষুধ জব্দ করেছে মেডিকেল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ। ওই সময় ওয়ার্ডের ইনচার্জ ও সিনিয়র স্টাফ নার্স বিলকিস বেগমকে আটক করা হয়েছিল। এ ছাড়া হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির স্টাফ কোয়ার্টারের ৩ নম্বর পুকুর থেকেও রোগীদের জন্য বিনামূল্যে বিতরণের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দ করা বিভিন্ন ধরনের বিপুল পরিমাণ সরকারি ওষুধ উদ্ধার করা হয়। এসব সরকারি ওষুধ রোগীদের মধ্যে বিতরণ না করে আত্মসাতের জন্য মজুদ করেছিলেন ওয়ার্ডের দায়িত্বরতরা। জব্দ করা ওষুধের বাজারমূল্য প্রায় ৫ লাখ টাকা। সূত্রমতে, প্রতি বছর রোগীদের জন্য সরকারিভাবে কোটি কোটি টাকার ওষুধ বরাদ্দ দেয়া হলেও এসব ওষুধ পাচ্ছেন না রোগীরা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App