×

মুক্তচিন্তা

শ্রীলঙ্কা : রক্তের প্লাবনে ভয়ঙ্কর বর্বরতার মুখচ্ছবি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০১৯, ০৯:৩৭ পিএম

হায় রক্ত, সেই শুধু বিভেদ মানে না। শিশু জায়ানের লাল রক্ত খ্রিস্টান বা শ্রীলঙ্কান কারো রক্তের সঙ্গে একাকার হয়ে গড়িয়ে যেতে যেতে রেখে গেছে বিস্ময় মাখানো বিষাদময় অভিশাপ। হয়তো বলেছে, এ কোন সভ্যতা? ধর্মের এ কোন বর্বর মুখচ্ছবি? যা শিশু-নারী-বৃদ্ধ কাউকেই বাঁচতে দেয় না। যারা মানুষ তাদের মন আজ পাষাণের মতো ভারী হয়ে আছে।

দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় রবিবার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ইস্টার সানডে চলাকালে গির্জা এবং বিলাসবহুল হোটেল ও অন্যান্য স্থাপনায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় নিহতের সংখ্যা কততে গিয়ে দাঁড়াবে বলা মুশকিল। তবে তা পাঁচশ হলেও অবাক হব না। অর্ধহাজার মানুষের জান নেয়া কাণ্ডটি কি শুধু সন্ত্রাস? কেবলই প্রতিশোধ? দুটি বিষয় ভেবে দেখা দরকার। প্রথমত, এটি কেবল কোনো নির্মম প্রতিশোধ বা সন্ত্রাস বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। অতঃপর এ ঘটনা প্রমাণ করল উপমহাদেশ ও পুরো দুনিয়ায় মানুষ এখন ধর্মের নামে মূলত মানুষহীন-জীবনহীন এক পৃথিবীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে ধীরে ধীরে। এবারের ঘটনায় বিদেশি চক্র বা তাদের মদদ ছিল কিনা তা এখনো বের হয়ে না এলেও যেটা জানা গেছে সেটা ভয়ঙ্কর। নিজ দেশের মানুষের প্রতি এত ঘৃণা আর এতটা নির্মম বৈরিতা বলে দেয় ধর্মান্ধতাই আজ দুনিয়ার বড় হুমকি।

হামলায় জড়িত সন্দেহে আটক আটজনের সবাই শ্রীলঙ্কান নাগরিক বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে বলছেন, তার দেশে যে বোমা হামলায় ২৯০ জন নিহত হয়েছেন, তার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিশ আট ব্যক্তিকে আটক করেছে। তিনি বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত আটক আট ব্যক্তির পরিচয় থেকে জানা গেছে তারা সবাই শ্রীলঙ্কান নাগরিক।’ তবে তাদের সঙ্গে বিদেশের কারো যোগাযোগ আছে কিনা এখন সেটি যাচাই করে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি। রবিবার সকাল পৌনে ৯টার দিকে শ্রীলঙ্কার ছয়টি স্থানে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। তাতে নিহত হয়েছে দুই শতাধিক মানুষ। এ ছাড়া এই ছয় হামলার তিন থেকে চার ঘণ্টা পর আরো দুটি স্থানে হামলার ঘটনা ঘটে।

ইস্টার সান ডে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জন্য খুব শুভ একটি দিন। তারা বিশ্বাস করেন ঈশ্বরপুত্র যিশু ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর আবার তার পুনর্জাগরণ হয় সে দিনটিতে। এমন একটা দিনে যারা গির্জায় যান তারা সকালে স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে পবিত্র হয়ে সেখানে যান। এদের মনে আশা থাকে ভগবান যিশু তাদের কথা শুনবেন। তাদের গ্লানি-পাপ মাফ করে নতুনভাবে চলার সুযোগ দেবেন। সে ধারণা কি আজ আসলেই আর রাখা সম্ভব? মন্দির, মসজিদ, প্যাগোডা কিংবা গির্জা কোথাও কোনো ঈশ্বর কাউকে বাঁচাতে পারছেন না। সেটা ভারতের মন্দির, রামুর বৌদ্ধ মঠ, নিউজিল্যান্ডের মসজিদ কিংবা শ্রীলঙ্কার গির্জা যাই হোক না কেন মানুষ মরছে। ঈশ্বরের প্রতি এমন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া অপবিত্র কতগুলো পশুর চেয়ে অধম নাকি নেমেছে ধর্ম পালনে। ধর্মের নামে তাদের এমন হত্যাকাণ্ড সভ্যতাকে কোনো জায়গায় নিয়ে দাঁড় করাবে, সেটা জানার পরও আমাদের ভ্রান্তি যায় না।

শ্রীলঙ্কার এত বড় ঘটনার পরও আমাদের দেশের আমাদের জাতির সুশীল-কুশীল কবি-লেখক লেখাপড়া জানা মানুষের ভ্রান্তি যায় না। তারা এখনো বলছে, রক্তপিপাসুরা নাকি ধার্মিক নয়। তাদের খোঁড়া অজুহাত, এরা কোনো ধর্মের না। তাদের কথা যদি সত্য হয় তো প্রশ্ন করি কারা করছে এসব? তারা কি রেড ক্রস বা রেড ক্রিসেন্টের নামে এগুলো করে? নাকি তাদের সংগঠনের নাম লায়ন বা সামাজিক কিছু? এটা তো পানির মতো পরিষ্কার এদের পরিচয় আর মদদদাতাই ধর্মীয় সংগঠন। যারা মানবিকতার নামে মধ্যপ্রাচ্য বা বিভিন্ন দেশে অনুদান কিংবা সাহায্য পাঠাই আমরা কি জানি এগুলো কোথায় কীভাবে খরচ করা হয়? আদৌ কাদের পকেটে যায় এসব? কোনো যুক্তি-তর্ক ছাড়া যারা এখনো কথিত সংবেদনশীলতার নামে পাপের ভয়ে এদের সমর্থন করেন তাদের জন্য এখন আর করুণাও হয় না। কারণ তারা জেনে-বুঝে মানুষ মারাকেই সমর্থন করে চলেছে। আসল জায়গায় তারা হাত দিতে চায় না। কারণ পাপ বোধ। যে কারণে এসব সমস্যার সমাধানও হবে বলে মনে হয় না। আর হলেও তা করবে এসব হত্যার ভেতর দিয়ে বড় হয়ে ওঠা কোনো প্রজন্ম। যারা শৈশবেই জেনে যাচ্ছে ধর্ম আসলে এখন আর সভ্যতার হাতিয়ার নয়। বরং যেভাবেই হোক তার ব্যবহার হচ্ছে মানুষের বিরুদ্ধে।

কথিত ধার্মিকরা এক সময় মার্কসবাদ-লেনিনবাদের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠেকানোর জন্য আমেরিকাকে দেবতা জ্ঞান করত। তখন আমেরিকাই ছিল তাদের প্রভু। কী হলো শেষে? সোভিয়েত পতনের পর সে আমেরিকা বেরিয়ে এল তার আসল চেহারায়। তাদের সব সময় এক বা একাধিক দুশমনের প্রয়োজন হয়। অস্ত্র ব্যবসাসহ নানাভাবে মানুষ মারার কাজে ব্যস্ত না থাকলে মোড়লের যে প্রভুত্ব থাকে না। সে আমেরিকা যখন ধর্ম-অধর্ম ভুলে মধ্যপ্রাচ্যে আফগানিস্তানে ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন থেকে কান্নাকাটির শুরু। অথচ রাশিয়া বদলে যাক আর যাই করুক তার গায়ে আঁচড় কাটার সাহস নেই কোনো সন্ত্রাসীর। সাহস নেই চীনে গিয়ে করার। সেসব দেশে ধর্মের বালাই নেই। ধর্মের নাম বলাও নিষেধ। ধার্মিক হলে জানে মারার দেশ চীনে কিন্তু শান্তির কমতি নেই। কেন? তাদের নেতা মাও দেজ দং আগেই বুঝে গেছিলেন ধর্ম এক বিষয় আর কথিত ধর্ম ব্যবসা আরেক। ফলে তারা তখন থেকেই ধর্মের নামে সবকিছু বন্ধ করে রেখেছে। আর মার্কস তো সে কবেই বলেছিলেন ধর্ম কোনো সময় আফিমের কাজও করে। সে কথাই কি আজ সত্য মনে হচ্ছে না?

আমি এ কথা বলি না ধার্মিকরা এসব করেন। তারা এসব করেন না। নিরীহ সাধারণ ধার্মিকরা তাদের মনোজগতে যে ঈশ্বরের কল্পনা করেন তার ভেতর হিংসা নেই। প্রতিশোধও নেই। আছে শান্তি আর ভালো থাকার তাগিদ। কিন্তু তারা তো এখন সংখ্যালঘু। তাদের নেতারা ধর্মকে সে জায়গায় রাখেনি। তারা একে পুঁজি করে এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছে যেখানে প্রকৃত ধার্মিকের বুকও কেঁপে উঠেছে। এখন আমরা জানতে চাইব কারা এমন কাণ্ড ঘটাল। আজকাল দুনিয়ায় কিছু হলেই মুসলমানদের দিকে আঙুল তোলা হয়। এবারও হয়তো তাই হবে। কিন্তু আসল ঘটনা কি সেটা জানা না গেলে এর প্রকৃত রহস্য কোনোদিন জানা যাবে না। সে দেশের সরকার ইতোমধ্যে সামাজিক মিডিয়া বন্ধ করে দিয়েছে। একদিকে তারা এটা করে ভালোই করেছে। হয়তো তা না হলে আরো মারামারি হতে পারত। কিন্তু সেসব মিডিয়ায় এমন খবরও আছে যে সংখ্যাগুরুরাই নাকি এমন কাজ করাতে পারে। কারণ তারাও সংখ্যালঘু খ্রিস্টানবিরোধী। তারপরও প্রশ্ন আছে। তাহলে বড় বড় পাঁচতারা, তিনতারা হোটেলগুলোতে আক্রমণ কেন? এর কারণ কি প্রচার পাওয়া? নাকি বিদেশিরা টার্গেট? বিদেশিরা মরলে কাদের লাভ বা কারা তা চায় সেটা দুনিয়া ভালো বোঝে। তবে এটা আমরা মানি যে কোনো ধর্মের মানুষই সন্ত্রাস চায় না। তারা জান নিয়ে বাঁচতে চায় বলেই ধর্মের অনুগত। ফলে জটিল সমীকরণ যে কে মেলাবে কীভাবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

এ ঘটনায় আমরাও বাদ পড়িনি। আমাদের দেশেও এই হত্যা তার কালো থাবা মেলেছে। খবরে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাতিও প্রাণ হারিয়েছে কলম্বোয়। ধার্মিক দুনিয়ার উৎপীড়ন আর বিশ্বাসের ঠেলায় মুসলিম শিশুও বাঁচতে পারল না। জীবনের আলো ভালো করে না ফোটার আগেই বাবার হাত থেকে শিশু জায়ানকে ছিনিয়ে নেয়া বোমা যদি ধর্মের রক্ষক হয় তো দুনিয়ায় সে ধর্মের দরকার নেই আর। জানতে চাই, নিউজিল্যান্ডের মহানুভবতা ও শোকের প্রতীকগুলো গ্রহণ করে আমরা কি একদিনের জন্য সবাই বদলে যেতে পারব? পারব তাদের সরকারপ্রধান, সংসদ ও নারীরা যা করেছিল তা করতে? পারব কি যিশুর জন্য বিনত হতে? যাজক-ফাদারদের পোশাক পরে বলতে, আমরাও আছি?

হায় রক্ত, সেই শুধু বিভেদ মানে না। শিশু জায়ানের লাল রক্ত খ্রিস্টান বা শ্রীলঙ্কান কারো রক্তের সঙ্গে একাকার হয়ে গড়িয়ে যেতে যেতে রেখে গেছে বিস্ময় মাখানো বিষাদময় অভিশাপ। হয়তো বলেছে, এ কোন সভ্যতা? ধর্মের এ কোন বর্বর মুখচ্ছবি? যা শিশু-নারী-বৃদ্ধ কাউকেই বাঁচতে দেয় না। যারা মানুষ তাদের মন আজ পাষাণের মতো ভারী হয়ে আছে।

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App