×

মুক্তচিন্তা

খালেদা জিয়ার মুক্তি নাকি সংসদে যাওয়া

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০১৯, ০৯:৪২ পিএম

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নাকি মুক্তি- এটিও একটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেতাদের অনেকেই দাবি করছেন যে, খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে (বিএনপির নেতারা পিজি হাসপাতাল বলতেই অভ্যস্ত, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করতে অনভ্যস্ত) বেগম জিয়ার চিকিৎসা হচ্ছে না বলেও তারা দাবি করছেন। তাদের দাবি বিশেষায়িত হাসপাতাল, তাদের বিবেচনায় সেটি ইউনাইটেড হাসপাতাল! এই নিয়ে পানি কম ঘোলা করা হয়নি।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনীতি এখন বেশ জটিল আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রতিদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিএনপির নেতারা খালেদা জিয়ার মুক্তি ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের ভাবার কিছু নেই বলে দাবি করছে। অন্যদিকে আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে ৬ সাংসদ শপথ নেবেন নাকি নেবেন না সেটি নিয়েও ধূ¤্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন যে এই সংসদের প্রতি বিএনপির যেহেতু কোনো আস্থা নেই, তাই তাদের দল থেকে নির্বাচিত মহাসচিবসহ ৬ সদস্যের শপথ নেয়ার প্রতি দলের কোনো আগ্রহ নেই। সে কারণে দল তাদের শপথ নেয়ার ব্যাপারে নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। কোনো কোনো মহল থেকে বলার চেষ্টা করা হচ্ছে যে বিএনপির অভ্যন্তরে একটি গ্রুপ খালেদা জিয়ার জামিন অথবা প্যারোলে মুক্তির বিনিময়ে ৬ সাংসদ শপথগ্রহণ করতে পারেন। আবার কোনো কোনো মহল মনে করে বিএনপির অভ্যন্তরে এখন কেউ কারো ওপর আস্থা রাখছেন না, কারো ভালো কেউ দেখতে চান না। তাই পরাজিত সদস্যরা কিছুতেই মির্জা ফখরুলসহ ৬ বিজয়ী সদস্যের সংসদে যাওয়ার বিষয়টি মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে রাজি নন। সে কারণে তারা বর্তমান সংসদকেই যেখানে মানতে চান না সেখানে বিএনপির সদস্যদের যোগদানের বিষয়টিকে অনৈতিক মনে করছেন- এমন ভাবাবেগ তৈরি করে নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। এসব নানা যুক্তি ও দাবিকে কেন্দ্র করে বিএনপি সংসদ অধিবেশনে যোগদান না করার যেসব বক্তব্য দিচ্ছে সেটির ফলে বেশিরভাগ নেতাকর্মীই এখন বিভ্রান্তিতে রয়েছে। তাদের কাছে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই যে, সংসদে যোগদান না করার অবস্থানে অনড় থাকার ফলাফল কি খালেদা জিয়ার মুক্তি ত্বরান্বিত করবে নাকি ৬ জন সদস্যের সংসদে অংশগ্রহণ করার সুযোগ নস্যাৎ করবে- এর কোনো যথাযথ উত্তর বা যোগফল কেউ মিলিয়ে লাভের ব্যাপার নিশ্চিত হতে পারছে না। তবে এটি অধিকাংশ নেতাকর্মী বুঝতে পারছে যে খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে আইনি লড়াই কিংবা আন্দোলন, অথবা প্যারোলে যাওয়ার সঙ্গে সংসদে বিএনপির ৬ সাংসদ যোগদানের সম্পর্ক তেমন একটা নেই। সংসদে যোগদান করেও ৬ সদস্য বিএনপির দাবি জোরালোভাবে উত্থাপন করতে পারে। বিশেষত বিএনপির মহাসচিব যেখানে দলের সাংসদদের মধ্যে নেতৃত্ব দেয়ার মতো অবস্থানে রয়েছেন সেখানে সংসদে বিএনপির দাবিদাওয়া তুলে ধরার মতো অবস্থানে তিনি ভালো ভূমিকা পালন করতে পারবেন- এমন সুযোগ থাকার পরও দলের সিনিয়র নেতাদের অনেকেই সংকীর্ণতার অবস্থান থেকে সংসদে অংশগ্রহণ না করার যুক্তিকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরেই অনেকেই বুঝতে পারছেন যে ৬ সাংসদ শপথ নিতে পারা না পারাটি বিএনপির রাজনৈতিক বিবেচনার চাইতে দলীয় নেতাদের সংকীর্ণতার মারপ্যাঁচে পড়া বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নাকি মুক্তি- এটিও একটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেতাদের অনেকেই দাবি করছেন যে, খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে (বিএনপির নেতারা পিজি হাসপাতাল বলতেই অভ্যস্ত, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করতে অনভ্যস্ত) বেগম জিয়ার চিকিৎসা হচ্ছে না বলেও তারা দাবি করছেন। তাদের দাবি বিশেষায়িত হাসপাতাল, তাদের বিবেচনায় সেটি ইউনাইটেড হাসপাতাল! এই নিয়ে পানি কম ঘোলা করা হয়নি। মিডিয়াগুলোতে যথেষ্ট বলা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে খালেদা জিয়াকে আনা হয়েছে। সেখানকার কর্তৃপক্ষ বলছেন যে বেগম জিয়া প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছেন, নিচ্ছেন এবং আগের তুলনায় ভালো আছেন। সে কারণে এ মুহূর্তে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বাইরে বড় ধরনের কোনো উত্তেজনা তৈরি করার মতো পরিস্থিতি নেই। জেল কর্তৃপক্ষ আদালতের নির্দেশ মোতাবেক তার চিকিৎসার জন্য যা করছেন তাতে যদি তিনি মোটামুটি সুস্থ থাকেন তাহলে তার শরীর নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার প্রচার-প্রচারণা খুব বেশি কাজে লাগবে না। ফলে আদালতে জামিন পাওয়ার বিষয়টি কতটা আইনসম্মতভাবে হবে সেটি আইনজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে বিএনপির আইনজীবীরাই বলছেন যে আইনি লড়াই করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা যাবে না। বিএনপির বিজ্ঞ আইনজীবীরা যখন এমন কথা বলেন তখন বেগম জিয়ার জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা নিশ্চয় অনেক বেশি বিবেচ্য বিষয়। বিশেষত দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ক্ষেত্রে এটি অনেক বেশি প্রযোজ্য নিম্ন আদালত নিয়ে না হয় অনেকে অনেক কথা বলেন জামিনের বিষয়টি অনেক বেশি রাজনৈতিক বলে দাবি করা হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতের রায়ে দ-িত মামলার জামিনের বিষয়টি উচ্চ আদালতেরই আইনি লড়াইয়ের বিষয়। সে কারণেই বিএনপির বড় বড় আইনজীবীরা বেগম জিয়ার জামিনের লড়াই নিয়ে উচ্চ আদালত থেকে সফল হওয়ার কোনো আশার বাণী শোনাতে পারছেন না। এটি সরকারেরও কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়। দেশে সর্বোচ্চ আদালতের আইনি ব্যবস্থার বিষয়। বিএনপি নেতারা বিষয়গুলো সম্পর্কে ভালো জানেন। খালেদা জিয়ার এ মামলাটি কোনো ঠুনকো রাজনৈতিক মামলা ছিল না। এটি রাষ্ট্রীয় অর্থ কেলেঙ্কারির মামলা ছিল, যা দশ বছর আইনি লড়াই ধাপে ধাপে শেষ করে উচ্চ আদালতেও মামলার রায় খালেদা জিয়ার বিপক্ষেই গেছে। যদিও মামলা চলাকালে বিএনপির আইনজীবীরা মিডিয়ার সম্মুখে এমন সব কথা বলতেন যা শুনে মনে হতো এটি একটি রাজনৈতিক মামলা। সুতরাং আদালত এ মামলায় ন্যায়বিচার করলে খালেদা জিয়া সুবিচার পাবেনই। কিন্তু আদালতের রায় কোনো অবস্থাতেই অন্যায়ভাবে হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাহলে বেগম জিয়ার আইনজীবীরা আদালতের ভিতরে প্রমাণ করতে পারেননি যে, রাষ্ট্রপক্ষ যেসব অভিযোগ করেছে সেগুলো সত্য নয়। সে কারণেই প্রশ্ন উঠেছে আদালতের ভিতরে আইনজীবীরা কী করেন বা কী না বলেন, কীভাবে লড়াই করেন বা না করেন বা করতে ব্যর্থ সেটি আদালতের ভিতরে যারা দেখেন তারাই জানেন, কিন্তু বাইরে এসে আইনজীবীরা আইনের বিষয়-আশয় বাদ দিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের মতো বক্তৃতা করেন, আদালতকে তারা সেভাবেও উপস্থাপন করতে চান- বাস্তবে বোধহয় সেটি ঠিক নয়। সেটি প্রমাণিত হয়েছে বেগম জিয়ার জন্য আইনি লড়াইয়ে যারা দশ বছর নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত অংশ নিয়েছিলেন তাদের বাইরের বক্তব্য শুনে। এখনো তারা আদালত সম্পর্কে মিডিয়ার সম্মুখে যা বলেন তা কতটা আদালতকে সম্মান করে বলেন- জানি না। তবে খালেদা জিয়ার জামিন নিয়ে এখন তাদের যে বক্তব্য তা দলীয় নেতাকর্মীদের খুব একটা আশ্বস্ত করছে না। তারা বিষয়টি বুঝতে পেরেই বলছেন যে বেগম জিয়াকে দুর্বার গণআন্দোলনের মাধ্যমে মুক্ত করে আনতে হবে। সে জন্য নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য তারা উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছেন। উপস্থিত নেতাকর্মীরা হয়তো সেসব আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন।

কিন্তু সরকারকে খালেদা জিয়ার মুক্তিদানে বাধ্য করার মতো আন্দোলন করার সক্ষমতা দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এই মুহূর্তে রয়েছে কিনা কিংবা তারা সেরকম কোনো আন্দোলন করার জন্য রাস্তায় নামতে রাজি আছেন কিনা সেটি দেখা যাচ্ছে না। বিএনপির নেতাকর্মীদের অনেকেই গত ১২ বছর ধরে অনেক গরম গরম বক্তৃতা শুনেছেন, বেশকিছু কর্মসূচিও ২০১৫ সাল পর্যন্ত তারা দেখেছিলেন, অংশগ্রহণও করেছিলেন। কিন্তু সেগুলোর পরিণতি খুব একটা ভালো হয়নি। ফলে নেতাকর্মীরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করার কর্মসূচি না দেখে তাতে অংশগ্রহণ করবেন এমনটি বোধহয় এখন অনেকের বিবেচনাতেই নেই। ফলে দুর্বার কোনো আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়টি ৩০ এপ্রিলের মধ্যে হওয়ার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। আর তেমন কোনো আন্দোলন না হলে খালেদা জিয়ার মুক্তি এ সময়ে আশা করাও সম্ভব হবে না। আবার খালেদা জিয়ার মুক্তিও নেই, সংসদে ৬ আসন ধরে রাখার অবস্থানেও নেই- এমনটি দলের জন্য লাভজনক বিবেচনা করারও সুযোগ কতখানি সেটি নিয়ে প্রশ্ন আছেই। সুতরাং সবকিছু নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে বিএনপি নেতারা, খাওয়ানো হচ্ছে নিচের নেতাকর্মীদের। দেশের সাধারণ মানুষ এসব নিয়ে মনে হয় খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করছে না। ফলে বিএনপির রাজনীতি, বেগম জিয়ার মুক্তি, ৬ সাংসদের অংশগ্রহণ করা না করা ইত্যাদি নিয়ে চলছে বিএনপির অভ্যন্তরেই নানা অস্পষ্টতা। ৩০ তারিখের মধ্যে আসন ধরে না রাখা হলে ওই ৬টি আসনও হারাতে হবে বিএনপিকে, সেখানে উপনির্বাচনের ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী করবেই। সেসব কিছুকে কি বিএনপি প্রতিহত করতে পারবে? খালেদা জিয়ার জন্য গণআন্দোলন দাঁড় করাতে পারবে? সব প্রশ্নেরই কিন্তু কোনো উত্তর কারোই জানা নেই।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App