×

মুক্তচিন্তা

মুক্তির সওগাত শবেবরাত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০১৯, ০৯:০৩ পিএম

মহানস্রষ্টা আল্লাহপাকের দয়া ও অনুগ্রহসিক্ত হওয়ার মোক্ষম সুযোগ ফিরে এলো। বছর ঘুরে আমাদের দ্বারে এসেছে মুক্তির সওগাত নিয়ে পবিত্র শবেবরাত। আজকের দিনগত রাতটি অন্য রাতের চেয়ে ভিন্ন। শবেবরাতকে বলা হয় মুক্তির রজনী। মানবজীবন নানা পাপ-পঙ্কিলতার আবর্তে ঘেরা। মানুষের যেমন গুণ আছে, তেমনি দোষও কম নয়। ঈর্ষা, আত্মপ্রবঞ্চনা, অন্যের প্রতি অবিচার, সত্য পথ বিচ্যুত হয়ে লাগামহীন জীবনাচারে গা ভাসিয়ে দেয়া মানুষের সংখ্যা আমাদের চারপাশে নিতান্ত কম নয়। মনুষ্যত্ববোধ ও সুবিচার নীতি বিসর্জন দিয়ে অমানবিকতার পথে হাঁটা মানুষের সংখ্যাও অনেক।

অন্যদিকে মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টি জগতের সেরা অভিধায় ভূষিত। তবুও প্রবৃত্তির তাড়নায় আল্লাহর প্রতি কর্তব্য পালন তথা আবশ্যকীয় ইবাদত-বন্দেগিতে পুরোপুরি নিবেদিত হওয়া অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। একজন মুসলমানকে খাঁটি ইমানদার ও সাচ্চা ব্যক্তি হতে হলে মহান আল্লাহর হক যেমন- নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি আদায়ে মনোনিবেশ করতে হবে, ঠিক তেমনি মানুষের প্রতিও হতে হবে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যনিষ্ঠ। মানুষ কতটা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনে যত্নবান, আর কতটা মানুষের সেবায় অগ্রণী মাঝে মধ্যে নিজের ভেতর এই প্রশ্ন জাগ্রত হওয়া দরকার। পাপে-অন্যায়ে লাগামহীন জীবনাচারে অভ্যস্ত মানুষের জন্য সুসংবাদের বার্তাই নিয়ে আসে শবেবরাত। বছরে যে কয়টি দিন-রাত পুণ্যের ঝলকে উদ্ভাসিত এর অন্যতম শবেবরাত। আজকের রাতটি মুক্তির রাত, ক্ষমা ও অনুগ্রহের রাত। আল্লাহর রহমত ও করুণাধারায় সিক্ত হওয়ার অবারিত সুযোগ শবেবরাত। আল্লাহপাকের সঙ্গে বান্দার দূরত্ব ঘুচে যায় এ মহিমান্বিত রাতে।

মানবজীবন নানামুখী পঙ্কিলতায় ভরা। নানা অনাচারে নিমজ্জিত হয়ে মানুষের জীবন হয়ে ওঠে ক্লেদাক্ত। মানুষ পাপাচারে নিমগ্ন হবে, সত্যের ওপর অটল থাকা অনেকের জন্য দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে, আল্লাহর হক আদায়ে শৈথিল্য দেখাবে তা মহান আল্লাহপাক ভালোভাবেই জানেন। নিজের সেরা সৃষ্টি মানুষকে পাপের পাহাড় ও দগ্ধতা থেকে বাঁচানোর জন্যই আল্লাহপাক কিছু দিন ও রাতকে বিশিষ্টতর ও মহিমান্বিত করেছেন।

এর মধ্যে শবেবরাত অন্যতম। শবেবরাত ফার্সি শব্দ। যার আরবি হলো ‘লাইলাতুল বরাত’। এর মানে মুক্তি রজনী। নফল নামাজ আদায়, কুরআন মজিদ তেলাওয়াত, দুরুদ শরিফ পাঠ, মা-বাবা-আত্মীয়-স্বজনসহ ওলি-বুজুর্গের মাজার জিয়ারত ইত্যাদি পুণ্যময় আমলে শবেবরাত অতিবাহিত করা অতীব জরুরি। এই পুণ্যময় রজনীকে ঘিরে বিশেষ খানাপিনা আয়োজন করে ফাতেহা পাঠ করে গরিব-দুঃখী মানুষকে খাওয়ানো এবং দুহাতে গরিব-অসহায় মানুষকে দান-সদকাহ টাকা-পয়সা প্রদান ইত্যাদি শবেবরাতের মুখ্য করণীয়।

এসব পুণ্যময় আমলের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ দিকনির্দেশনা রয়েছে পবিত্র কুরআন-হাদিসে। ইসলামী মনীষীদের জীবনাচারেও আমরা দেখি শবেবরাত তারা অতিবাহিত করেছেন ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে এবং মানবকল্যাণের দ্বারা। শবেবরাতে যত ধরনের পুণ্যময় কাজ রয়েছে সবই অসংকোচে করা যাবে। এ রাতে পুণ্য কাজের তালিকা আরো অনেক দীর্ঘ হতে পারে। ইবাদত-বন্দেগিতে কাটিয়ে এবং মানবসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে পুণ্যময় জীবন গঠনের বড় সুযোগ শবেবরাত।

পবিত্র কুরআন-হাদিস শরিফে শবেবরাতের ফজিলত ও মাহাত্ম্যের কথা বর্ণনা রয়েছে। কুরআন মজিদের সুরা দুখানের ৩-৪ নম্বর আয়াতে শবেবরাতের উল্লেখ পাওয়া যায়। আল্লাহপাক বলছেন, ‘ইন্না আঞ্জালনা হু ফি লাইলাতিম মুবারাকাতিন ইন্না কুন্না মুঞ্জিরিন, ফি হা ইউফরাকু কুল্লু আমরিন হাকিম’ অর্থাৎ আমি এই কল্যাণময় রজনীতে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছি। আমিই সতর্ককারী।

এতে আমার আদেশে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ও বিষয়াদি মীমাংসিত হয়। অলি, বুজুর্গ ও মুফাসসিররা এ আয়াতের ব্যাখ্যায় শবেবরাত বা শবেকদরকেই বুঝিয়েছেন। ১৪ শাবান দিবাগত রাতই হচ্ছে শবেবরাত। খাঁটি অন্তরে অনুশোচনার মাধ্যমে অতীতের পাপাচারের নিষ্কৃতির জন্য এই পুণ্যময় রজনীতে ফরিয়াদ জানালে আল্লাহপাক কবুল করবেন এ আশা করা যায়। এ রাতে বান্দার রিজিক, জীবন মৃত্যু ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয় বলে শবেবরাতের তাৎপর্য অনেক গভীর।

তবে এখানে একটি প্রসঙ্গ বিশেষভাবে বলা জরুরি। শবেবরাতে গরিব-দুঃখী, অভাবী, নিরন্ন মানুষকে দান-সদকাহ করা অতীব পুণ্যময় কাজ সন্দেহ নেই। যারা সারা বছর সুন্দরভাবে খেতে পারে না, মাছ-মাংসসহ নানা সুস্বাদু খাবার যাদের কপালে জুটে না, এই গরিব-ক্ষুধার্ত মানুষকে নিজ ঘরে বা আঙিনায় ডেকে নিয়ে ভালো-উন্নতমানের খানাপিনা পরিবেশন করা সবচেয়ে উত্তম কাজ। কিন্তু আমরা ভেবে দেখি না যারা গরিব-অসহায় মানুষ আমাদের চারপাশে অবস্থান করে থাকে, তাদের শুধু বছরের এই কয়েকটি দিন দান-সদকাহ বা আদর-আপ্যায়নের ব্যবস্থা করাই যথেষ্ট নয়। এই অসহায়, নিরন্ন, অধিকার বঞ্চিত মানুষের জীবন বদলানোর প্রয়াসে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যনিষ্ঠ হতে হবে।

শুধু দান-সদকাহ দিয়ে গরিবদের শবেবরাত, শবেকদর বা ঈদের দিনে হাসি-খুশিতে রাখা যথেষ্ট ভাবলে হবে না। এই অসহায় মানুষগুলো যাতে সারা বছর অভাবমুক্ত সচ্ছল জীবনের দিশা খুঁজে পায় তার ব্যবস্থাও আপনাকে করতে হবে, যদি আপনার সেই সক্ষমতা ও সুযোগ থাকে। গরিবদের বছরের মাত্র কয়েকটি দিন খুশিতে রেখে দায়িত্ব সারলে হবে না। ধনী, বিত্তবান ও সরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশ ও সমাজ থেকে দারিদ্র্য হটাতে হবে।

বিক্ষিপ্তভাবে দান-সদকা করলে গরিবদের স্থায়ী কোনো ফায়দা হয় না। বরং এতে গরিবি জিইয়ে থাকে মাত্র। কেবল শবেবরাত, শবেকদর ইত্যাদি বিশেষ দিনগুলোতে গরিব-দুঃখীদের সামান্য দান-সদকা না করে তাদের স্থায়ীভাবে সচ্ছল করে দিতে হবে। অসহায় গরিবদের স্থায়ী পুনর্বাসনের কথা সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে, দান-সদকাহ, জাকাত, ফিতরা ইত্যাদি ইসলাম নির্দেশিত ইবাদত হলেও অপরিকল্পিতভাবে মাঝে মধ্যে গরিবদের ২০-৪০ টাকা করে গছিয়ে দিয়ে চিরকালের জন্য তাদের গরিব করে রাখা ইসলামের শিক্ষা নয়। দান-সদকাহ, জাকাত, ফিতরা এমনভাবে দিতে হবে যাতে সমাজ থেকে দারিদ্র্য চিরতরে নির্মূল হয়। সামান্য দান-সদকা দিয়ে গরিবদের দারিদ্র্য জিইয়ে রাখা ইসলামের উদ্দেশ্য নয়, এই উপলব্ধি সবার মাঝে থাকা উচিত। বরং গরিবদের স্থায়ীভাবে সচ্ছল করার মানবিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসাই ইসলামের শাশ্বত নির্দেশনা এবং মহানবীর (সা.) শিক্ষা।

সামনে আসছে রমজান মাস। রমজান মাসের শেষ দিকে পালিত হয় শবেকদর। তারপর আসে ঈদুল ফিতর। রমজান মাসে সাধারণত আমাদের দেশের কিছু ধনী গরিবদের দান-সদকাহ, জাকাত, ফিতরা প্রদানে মনোযোগী হন। এটি ইতিবাচক দিক হলেও একে আবার পরিকল্পিত পন্থাও বলা যায় না। অতি অল্প টাকা গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে ধনীরা আত্মতুষ্টিতে ভুগলেও এতে গরিবদের স্থায়ী কোনো কল্যাণ হয় না।

অন্যদিকে প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের সময় গরিব নারী-পুরুষরা প্রতিটি মসজিদের আঙিনায় সামান্য টাকা-পয়সার আশায় জড়ো হয়। অথচ দুর্ভাগ্যজনক যে, একটি মসজিদ থেকে যদি ৫০০ জন মুসল্লি নামাজ শেষে বের হন, দেখা যায় মাত্র ১৫-২০ জন মুসল্লি ছাড়া আর কেউ গরিবদের ৫টি টাকা দেয়ার মতো গরজবোধও করেন না। মসজিদের বাইরে মাত্র ১৫-২০ জন গরিব মানুষ সাহায্যের অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন। জুমার নামাজের সময় মুসল্লি কর্তৃক আর্থিক সাহায্যের আশায় গরিবরা সমবেত হয়, অথচ শত শত মুসল্লির ওদের দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মুসল্লিদের পকেটে অনেক টাকা থাকলেও গরিবের জন্য এক টাকাও বের হয় না। ধরুন, ৫০০ মুসল্লির মধ্যে যদি অন্তত ৩০০ মুসল্লি প্রতিটি জুমার দিনে বা শবেবরাতের মতো বিশেষ দিনগুলোতে গরিব-ভিক্ষুকদের জনপ্রতি ৫-১০ টাকা করে দেন, তা হলে এই গরিব মানুষগুলো অন্তত এক সপ্তাহ সুখে-শান্তিতে সচ্ছলতার সঙ্গে দিন কাটাতে পারবেন।

কিন্তু না, লাখো-কোটি টাকার মালিক অনেক বিত্তবান মুসল্লি গরিবদের ‘উৎপাত’ ও ‘ঝামেলা’ মনে করে দ্রুত নামাজ শেষে বেরিয়ে যান। এমনকি শবেবরাত, শবেকদর এবং দুই ঈদেও অনেক মুসল্লি গরিবদের দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকান না। তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন না। এটি অমানবিক। এটি গরিবদের প্রতি চরম নিষ্ঠুরতার শামিল।

আজকের মহিমান্বিত রাতটি ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করে আল্লাহপাকের সান্নিধ্য ও নৈকট্য অর্জন করুন। আমাদের মাতৃভূমি স্বদেশবাসীর শান্তি, কল্যাণ এবং বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের পরিত্রাণের জন্য আজকের শবেবরাতে সবাই আল্লাহর দরবারে অশ্রুসিক্ত ফরিয়াদ পেশ করুন। এভাবে মুক্তির রজনীটি অতিবাহিত করতে আল্লাহপাক আমাদের তৌফিক দিন। আমিন।

আ ব ম খোরশিদ আলম খান: কলাম লেখক, ইসলামী চিন্তাবিদ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App