×

মুক্তচিন্তা

অর্ধবিশ্বে মাটির উৎসব বৈশাখ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০১৯, ০৯:০৬ পিএম

পশ্চিমা বিশ্ব যখন শিল্পায়ন নিয়ে নিমগ্ন তখনো এ অঞ্চলের মানুষ মাটির গন্ধে উজ্জীবিত হয়। যান্ত্রিক জীবনের চাইতে প্রথাগত কৃষিযুগের জীবন তাকে অনেক বেশি আবদ্ধ করে রাখে। একদম স্পষ্ট করে এই কথাটি বলা দরকার যে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা শিখ কোনো ধর্মই এই উৎসবটিকে তার নিজস্বতা থেকে আলাদা করতে পারেনি। ভূপ্রকৃতি ও জীবনধারায় এর শেকড় থাকায় এই উৎসব ধর্মান্ধ হয়নি, হবেও না। বরং এর ডিজিটাল রূপান্তর হবে। আগামীতে সেই রূপান্তর নিয়েই কথা বলা যাবে।

প্রবল প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও বাঙালি এবারো তার বর্ষবরণ উৎসব উদযাপন করেছে। একদল ধর্মান্ধ, মূর্খ ও পাকিস্তানপন্থি লোকের প্রবল বিরোধিতা, ফতোয়া, হত্যার হুমকি থাকলেও খুন-হুমকি এবং বৈশাখের রৌদ্রতাপ থাকার পরও প্রতিবারই দেশের সব স্থানেই যুগ যুগ ধরে নতুন বাংলা সনকে আমরা বরণ করে আসছি। মঙ্গল শোভাযাত্রা, নাচ-গান-মেলা মিলিয়ে বাংলার ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে আমরা পালন করছি সার্বজনীন বর্ষবরণ।

২০১৬ সালে আমাদের দেশের একটি পত্রিকায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কিছু ছবি দেখেছি যাতে তারা নতুন বছর পালন করেছে বলে প্রতীকী দৃশ্য বলে মনে হয়েছিল। ২০১৮ সালেও মঙ্গল শোভাযাত্রা নামক একটি মিছিলের ছবি দেখেছি।

২০১৯ সালের কোনো ছবি চোখে পড়েনি। যা দেখেছি তাতে মনে হয়েছে তারা কেবল হালখাতা হারায়নি বাঙালির একমাত্র সার্বজনীন উৎসবটি হারাতে বসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা তাদের টিভি চ্যানেল বা মিডিয়া দেখে এটি বোঝার উপায় নেই যে, পহেলা বৈশাখ ভারতীয় বাঙালিদের সার্বজনীন উৎসবের মর্যাদা পায়। সম্ভবত এ জন্যই একজন ভারতীয় বাঙালি বাংলাদেশের এক টিভি চ্যানেলে যথার্থই বলেছেন, বৈশাখ দেখতে হলে বাঙালিকে বাংলাদেশেই আসতে হবে। কথাটি বর্ণে বর্ণে সত্য। যুগ যুগ ধরে প্রবল প্রতিরোধের মাঝেও আমরা আমাদের নিজেদের সালটিকে উৎসবে রাঙিয়ে রেখেছি। এমনকি কখনো এই উৎসবটি অধিকার আদায়ের হাতিয়ারও হয়েছে।

কিন্তু আমরা কি এটি জানি যে, এই সময়ে বছরের সূচনা কেবল বাংলাতেই হয় না। বরং বাংলার বর্ষবরণের দিগন্তটা অনেক বড়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক বিশাল ভূখ-ে নতুন বছর আসে এই সময়টাতে। কৃষিভিত্তিক এই অঞ্চলটার এই উৎসবটা এমনকি আজকের ডিজিটাল যুগেও এই অঞ্চলের মানুষের অজানাই থেকে গেছে।

আমরা যেমন জানি না যে, এই বৈশাখ থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া-লাওস ও মিয়ানমারের মতো পাঞ্জাবেও পালিত হয় তেমনি ওরাও হয়তো জানে না যে একই সময়ে বাঙালিরাও বৈশাখ উদযাপন করে। বাস্তবতা হচ্ছে দুনিয়ায় অনেক নতুন বছর উদযাপিত হয়। দুনিয়ার প্রায় সব প্রান্তেই প্রচলন আছে বর্ষবরণ উৎসবের। তবে সাধারণভাবে আমরা অন্তত চারটি বড় ধরনের নববর্ষকে জানি।

আমাদের জানা মতে, ১ জানুয়ারি ইংরেজি নববর্ষ, ২১ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারির মাঝে যে চাঁদ উঠে তার প্রথম দিনে চীনা নববর্ষ, ১ মহরম আরবি নববর্ষ এবং পহেলা বৈশাখ বাঙালির নববর্ষ।

আমরা জানি চীনা জনগোষ্ঠী চীনা নববর্ষ পালন করে। ওরা বিশাল জনগোষ্ঠী। তবে দুনিয়ার আর কোনো জাতি-গোষ্ঠী চীনা নতুন বছর পালন করে না। ইংরেজি নববর্ষ প্রায় সারা দুনিয়াতেই পালিত হয়। কারণ এটি সারা দুনিয়ার সবার পঞ্জিকা। ফলে উৎসব পালনকারীর সংখ্যার দিক থেকে ইংরেজি নতুন বছরই সবার ওপরে আছে। সারা দুনিয়াতেই এই নতুন বছরের প্রভাব পড়ে। আরবি বর্ষ আরব দেশ ও দুনিয়ার সব দেশের মুসলমানরা ধর্মীয়ভাবে পালন করে থাকে। এটি সার্বজনীন উৎসব নয়, বস্তুত ধর্মীয় উৎসব। তবে বাংলা নববর্ষ বাঙালিরা উদযাপন করে। বাংলা একাডেমির পঞ্জিকা সংস্কারের ফলে একই দিনে এই দিনটি সর্বত্র পালিত হয় না। বাংলাদেশের মানুষও কেউ সনাতন পঞ্জিকা মানেন, কেউ একাডেমির পঞ্জিকা মানেন। সরকারি ছুটিটা একাডেমির পঞ্জিকা অনুসারে হয় বলেই সেটি আমাদের নতুন বছরের প্রথম দিন। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় বৈশাখের প্রথম দিনটি সনাতনী পঞ্জিকা অনুসারে হয়ে থাকে। তবে এপ্রিলের মাঝখানের ১৩ থেকে ১৫ তারিখের মাঝে কেবল বাঙালিরাই নতুন বছরকে স্বাগত জানায় না, বিশাল এশীয় জনগোষ্ঠী এই সময়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়।

এককভাবে বাঙালিরাই ৩৫ কোটির বেশি মানুষ দুনিয়াতে রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে ভারতের অন্য ভাষাভাষী বিশাল অংশ। প্রকৃতপক্ষে সেই পাঞ্জাব থেকে আসাম অবধি ভারতের প্রায় পুরোটাই এই সময়ে নতুন বছর উদযাপন করে। এই সময়ে নতুন বছর উদযাপন করে পাকিস্তানের পাঞ্জাবি ও বেলুচরাও। এর সঙ্গে আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাতিগুলো।

আমাদের অবশ্য দোষ নেই যে, এসব খবর আমরা জানি না। কারণ এই যে, ইংরেজি নতুন বছর মাতাল হওয়ার তালে বাংলাদেশে পালিত হয় তারা কি সেই নতুন বছরটির ইতিহাস জানে। স্মার্ট ফোন বা ট্যাবে যদি কোনোভাবে উইকিপিডিয়ায় যাওয়া যায় তবেই হাতের কাছে ইতিহাসটা চলে আসে। কিন্তু ফেসবুকে আমরা যত সময় দিই জ্ঞান খুঁজতে আমরা তত সময় দিই না বলে বিদেশিদেরটা তো দূরের কথা নিজেরটারও খবর রাখি না। আমি বরাবরই লেখালেখির জন্য গুগলকে ভালো বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করি। যখনই কোনো তথ্যের দরকার হয় তখন আমি গুগলের দুয়ারে হাজির হই। সুযোগটা আরো বেশি পাই উইকিপিডিয়া থেকে। ওখানে পাওয়া যায় না এমন তথ্য প্রায় বিরল। তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতেই থাইল্যান্ড, লাওস ও ভারতে বর্ষবরণের খবরগুলো আমাকে সচেতন করেছে। আমাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোও এই সময়টাতে বর্ষবরণের উৎসব পালন করে।

আমি এটিও লক্ষ করেছি যে, কোনো কোনো দেশে এই বর্ষবরণকে ট্যুরিজমের একটি বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সম্ভবত থাইল্যান্ড এর শীর্ষে আছে। লাওস, কম্বোডিয়াও পিছিয়ে নেই।

আগেই বলেছি চীনারা জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝে চাঁদের হিসাবে নতুন বছর উদযাপন করে। কোরীয় ও ভিয়েতনামিরাও চাঁদের হিসাবে নতুন বছর সেই সময়টাতেই পালন করে। তিব্বতিরা নতুন বছর পালন করে মার্চে। চীনা নতুন বছরের হিসাবটা আমাদের দেশের সেই ব্যবসায়ীরা খুব ভালো মনে রাখেন- কারণ তখন বেশ বড় সময়জুড়ে চীনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকে।

পূর্ব ভারতের মিজোরা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে নতুন বছর উদযাপন করে। ইরানি নওরোজ পালিত হয় মার্চে। এই মাসে ভারতের অনেক জাতি নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, কর্নাটক, কাশ্মির, মহারাষ্ট্রের মাঝে রয়েছে। তবে এসব রাষ্ট্রের অনেকে আমাদের নববর্ষ উদযাপনের সঙ্গে সময় মিলিয়ে নতুন বছর উদযাপন করে। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে পাকিস্তান ও ভারতের বালুচ হিন্দুরা বাংলা নববর্ষের সময়কালেই বেগে রোচ নামক তাদের বর্ষবরণ উৎসব পালন করে। তামিলদের পুথান্ডু উৎসব পালিত হয় এই সময়ে। শ্রীলঙ্কাতেও তামিলরা এই উৎসব পালন করে। পাঞ্জাবিরা বৈশাখী উৎসবই পালন করে এবং সেটি তারা পালন করে ১৪ এপ্রিল। নেপালিদের বৈশাখ ১২ থেকে ১৫ এপ্রিলের মাঝে পালিত হয়। হিমাচল প্রদেশের ডগ্রিরা চৈতী উৎসব নামে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। মৈথিলীদের বৈশা ১২ থেকে ১৫ এপ্রিলের মাঝে পালিত হয়। আসামের রঙালি বিহু পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। উদিয়া নামক নববর্ষ অনুষ্ঠান উড়িয়রা পালন করে ১৪ এপ্রিল। মনিপুরীরা ছিরোবা উৎসব পালন করে ১৪ এপ্রিল। কেরালায় বিষু নামক বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালিত হয় এই সময়ে। কর্নাটকের যে অংশে তুলু ভাষাভাষীরা থাকে সেখানে এই সময়ে নতুন বছর পালিত হয়। মহারাষ্ট্রেও অনেকে এই সময়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানান।

আমরা বাঙালিরা নিজেদের মাঝে এতই মগ্ন থাকি যে আমাদের দেশেরই পাহাড়িরা নতুন বছরের উদযাপন করতে গিয়ে যেসব অনুষ্ঠান করে তারও তেমন কোনো খবর রাখি না। সম্প্রতি একটি প্রবণতা দেখা যায় যে বাঙালিরা ঘুরে বেড়াতে এই সময়ে পাহাড়ে যায় এবং পাহাড়িদের উৎসব দেখে মুগ্ধ হয়। কোনো কোনো বছর ঢাকায় সরকারিভাবে ওদের একটি অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়। ঠিক একইভাবে সারা দুনিয়াতে পানি উৎসব নামে নতুন বছরকে বরণ করা হয় দেশে দেশে। ১৩-১৫ এপ্রিল সময়কালে পানি খেলায় নতুন বছর উদযাপন করা হয় থাইল্যান্ডে। এর নাম সঙ্গক্রান। মিয়ানমারে এর নাম থিনগিয়ান। লাওসে এর নাম পি মাই লাও। কম্বোডিয়ায় চাও চাম মে নামে এই উৎসবটি পালিত হয়।

কেউ কেউ এটা জানেন যে, এটি আসলে ফসলি সন। ফসল কাটার উৎসবকে কেন্দ্র করে আফগান সীমান্ত থেকে থাইল্যান্ড অবধি বিস্তীর্ণ জনপদের মানুষ আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে তার কৃষিনির্ভর জীবনকে রাঙিয়ে তুলে আসছে। দিনে দিনে এর রূপান্তরও হচ্ছে।

আমরা যারা সম্রাট আকবর কর্তৃক বাংলা সনের প্রবর্তনের গল্পটা বিশ্বাস করি এবং হিজরি সাল থেকে বাংলার সূচনা হিসাব করি তাদের কাছে এ বিষয়গুলো স্পষ্ট করতে হবে যে, মিয়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া বা থাইল্যান্ডে বৈশাখী নতুন বছরও কি সম্রাট আকবরই প্রচলন করেছিলেন? এসব দেশ তো আকবরের শাসনে ছিল না- তাহলে তারা এই সময়টাকে নতুন বছর হিসেবে বেছে নিল কেন? আমাদের পণ্ডিতদের একটি বড় প্রবণতা হচ্ছে পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলোকে গভীরভাবে তলিয়ে না দেখা। ফলে কোনো একটি ইতিহাসকেই আমরা নির্ভরযোগ্য করতে পারি না।

বাংলা সনের কাহিনী নিয়ে আমার জ্ঞানের পরিধি সীমিত। সেই বিষয় নিয়ে তেমন আলোচনাও আমি করতে চাই না। তবে বাংলা সন আর দক্ষিণ-দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় নববর্ষ সম্রাট আকবরের হাত ধরে জন্ম নিয়েছে সেটি মেলাতে পারছি না। আমি জানি না বিষয়টি কাকতালীয় নাকি সম্রাট আকবর দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় নতুন বছরকেই তার আমলের নববর্ষ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

আমরাও সম্ভবত দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংস্কৃতির অংশকে স্বীকার করার চাইতে মুসলমান সম্রাট আকবর এবং মুসলমানদের হিজরি সনকে মাহাত্ম দিতেই পছন্দ করেছি। কিন্তু আমার নিজের ধারণা কৃষিনির্ভর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি সমন্বিত সংস্কৃতির নামই বৈশাখ, যা কোথাও কোথাও অন্য নামেও আখ্যায়িত হয়। আমার নিজের ধারণা বৈশাখের এই সময়টি কৃষিপ্রধান এই অঞ্চলের নতুন বছর কৃষির সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত হয়ে থাকবে। দুনিয়ার অন্য অঞ্চলের কৃষিপণ্য আর এ অঞ্চলের কৃষিপণ্য এক নয়।

অন্যদিকে আবহাওয়ার বিষয়টির গুরুত্বও থাকতে পারে। যে ভৌগোলিক সীমানার কথা আমরা উল্লেখ করেছি তার ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির কথাও মনে রাখা যেতে পারে। এই কথাটি ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে নববর্ষ যে অঞ্চলে পালিত হয় তার সঙ্গে দুনিয়ার আর কোনো অঞ্চলের জীবনধারা, প্রকৃতি, শিল্পায়ন ইত্যাদি মেলে না। পশ্চিমা বিশ্ব যখন শিল্পায়ন নিয়ে নিমগ্ন তখনো এ অঞ্চলের মানুষ মাটির গন্ধে উজ্জীবিত হয়। যান্ত্রিক জীবনের চাইতে প্রথাগত কৃষিযুগের জীবন তাকে অনেক বেশি আবদ্ধ করে রাখে। একদম স্পষ্ট করে এই কথাটি বলা দরকার যে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা শিখ কোনো ধর্মই এই উৎসবটিকে তার নিজস্বতা থেকে আলাদা করতে পারেনি। ভূপ্রকৃতি ও জীবনধারায় এর শেকড় থাকায় এই উৎসব ধর্মান্ধ হয়নি, হবেও না। বরং এর ডিজিটাল রূপান্তর হবে। আগামীতে সেই রূপান্তর নিয়েই কথা বলা যাবে।

মোস্তাফা জব্বার: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App