×

জাতীয়

অগ্নিগর্ভ সোনাগাজী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০১৯, ১১:৫১ এএম

ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার ঘটনায় বিচার চেয়ে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ধিক্কারের শব্দ শোনা যাচ্ছে সোনাগাজীর প্রতিটি বাড়ি ও পাড়া-মহল্লায়। সোনাগাজীতে এমন নৃশংস বর্বরতা আগে কেউ দেখেনি। নির্মমতা ও লজ্জার এ গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছেন এখানকার সাধারণ মানুষ। রাফির করুণ আর্তনাদ এখনো ভুলতে পারছেন না তার বন্ধু ও সহপাঠীরা। দ্রুত বিচার শেষে শাস্তি কার্যকর চান সর্বস্তরের আমজনতা। এমনকি স্থানীয় আওয়ামী লীগও নুসরাত হত্যার বিচারে তৎপর রয়েছে। এর মধ্য দিয়েই নৃশংসতার এ কলঙ্ক মুছতে চান এখানকার অধিবাসীরা। সামাজিক সংগঠনগুলো সোচ্চার : রাফির শ্লীলতাহানির পর থেকেই বিচারের দাবিতে সোনাগাজীর বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো সংগঠন মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, সভা-সমাবেশ ও স্মারকলিপি দিচ্ছে। এর মধ্যে খেলাঘর সোনাগাজী আসর, বাংলার দর্পণ খেলাঘর আসর, সমৃদ্ধ সোনাগাজী উন্নয়ন ফোরাম, শেখ পাড়া যুব সংঘ, উপজেলা সাহিত্য ফোরাম, নজরুল একাডেমি, সেলিম আল দ্বীন একাডেমি, বাংলাদেশ মানবাধিকার সম্মিলন, সোনাগাজী উন্নয়ন ফোরাম, সোনাগাজী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও উত্তর চরচান্দিয়া চট্টগ্রাম সমাজসহ আরো বহু সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে। গতকাল শুক্রবারও চট্টগ্রামের গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আহমেদ আল মামুন নামের এক যুবক নুসরাত হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে স্থানীয়দের জড়ো করে প্রতিবাদ করেন। ‘নুসরাত হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই, অন্যায় সইব না-অন্যায় করব না’ স্লোগান নিয়ে প্রতিবাদ করা যুবক বলেন, ১০ এপ্রিল থেকে তিনি নুসরাত হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। হত্যাকারীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের প্রতিবাদ তিনি চালিয়ে যাবেন। মানবাধিকার সম্মিলনের চেয়ারম্যান এডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম নান্টু বলেন, নুসরাত হত্যায় জড়িতদের দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আতঙ্কে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা : রাফি হত্যাকাণ্ডের পর থেকে সোনাগাজীর প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অজানা আতঙ্কে ভুগছেন। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকদের সকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া থেকে শুরু করে বাড়ি ফিরে আসা পর্যন্ত দুশ্চিন্তায় কাটাতে হচ্ছে। এখানকার অভিভাবকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা ঘটলে আমাদের ছেলেমেয়েরা বা আমরা কী করব? আমাদের ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তা কোথায়? বিশেষ করে ছাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। অনেকে প্রশ্ন করছেন মেয়ের মা-বাবা হওয়াটা কি অপরাধ? সোনাগাজী ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ইকবাল হোসাইন বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচালনা পর্ষদে থাকা ব্যক্তিদের শিক্ষিত হতে হবে। তাদের অবশ্যই শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। এনায়েত উল্লাহ মহিলা কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ফাতেমা আক্তার মনিষা বলেন, রাফির ঘটনা থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের পথে সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে সবার সচেতন হওয়া জরুরি। সোনাগাজী ইসলামিয়া মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী আয়েশা আক্তার বলেন, রাফিকে হত্যাচেষ্টার দিন থেকে আমাদের পরীক্ষা কেন্দ্রের সব পরীক্ষার্থীর ভেতরে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। মানসিক চাপের কারণে আমাদের ফলাফল নিয়েও আমরা শঙ্কিত। সেকান্তর মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর বাবা মজিবুল হক বলেন, আমরাও আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা ও লেখাপড়া নিয়ে শঙ্কিত। ঘর থেকে বের হয়ে ফিরে না আসা পর্যন্ত দৈনন্দিন কাজের ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানদের নিয়ে আমাদের ভাবতে হচ্ছে। এ বিষয়ে সোনাগাজী ইসলামিয়া মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা হোছাইন আহমেদ বলেন, আমরা আমাদের মাদ্রাসার পরীক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগী করার চেষ্টা করছি। নুসরাত হত্যার পর মাদ্রাসার ওপর একের পর এক ধকল যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের তা থেকে বাইরে রাখার চেষ্টা করছি। সিরাজের শাস্তি চান তার স্বজন ও সহকর্মীরা : সোনাগাজীর সাধারণ মানুষের মতো নুসরাত হত্যার বিচার ও শাস্তির দাবি উঠছে প্রধান আসামি সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার গ্রামের বাড়ি থেকেও। তার স্বজন ও মাদ্রাসার সহকর্মীরাও নুসরাত হত্যায় দায়ীদের কঠিন শাস্তি চেয়েছেন। সোনাগাজীর ৮ নং আমিরাবাদ ইউনিয়নের চর কৃষ্ণজয় গ্রামে অধ্যক্ষ সিরাজের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তার ঘরে তালা। বাড়ির সামনে পুলিশ পাহারা বসানো হয়েছে। সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে সিরাজের বাড়ির অন্যান্য ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন তার আত্মীয়রা। সিরাজের বড় ভাইয়ের স্ত্রী হাছিনা আক্তার বলেন, সিরাজ উদদৌলার বাড়িতে একটি ঘর থাকলেও এখানে কেউ থাকেন না। তিনি বাড়িতে খুব কম আসেন। পরিবার নিয়ে থাকেন ফেনীর পাঠানবাড়িতে। তিনি বলেন, মেয়েটার জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছি। আমার দেবর যদি এ ঘটনায় দোষী হন তাহলে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। সিরাজ উদদৌলার গ্রামের ইউপি সদস্য মো. গোলাম কিবরিয়া শামীম বলেন, আমাদের গ্রামটি খুব শান্তিপূর্ণ। একটি ঘটনায় পুরো গ্রাম কলঙ্কিত হয়ে গেছে। আমরা নুসরাত হত্যার কঠিন শাস্তি দাবি করছি। নুসরাত হত্যায় জড়িত সন্দেহে আটক অধ্যক্ষ সিরাজের শ্যালিকার মেয়ে মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী উম্মে সুলতানা পপির মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার বাবা সহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, অধ্যক্ষ আমার ভায়রা। তিনি যে অপকর্ম করেছেন এতে তাকে আত্মীয় পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করি। তার অপকর্মের বলি হয়েছে আমার মেয়ে। আমার মেয়ে শুধু তার আত্মীয় হওয়ার কারণে ফেঁসে গেছে। তার জীবনটা শেষ হওয়ার পথে সিরাজের কারণে। সিরাজের মাদ্রাসার সহকর্মী ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা হোছাইন আহমেদ বলেন, তার বিরুদ্ধে আগেও এ ধরনের বহু অভিযোগ ছিল। সর্বশেষ ন্যক্কারজনক এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার আশা করি। অজানা আতঙ্কে নুসরাতের পরিবার : সোনাগাজীর চর চান্দিয়া গ্রামে নুসরাতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বাড়ি শোকে স্তব্ধ। এখনো ঘর থেকে থেমে থেমে কান্নার আওয়াজ আসছে। অসুস্থ শয্যাশায়ী নুসরাতের মা শিরিন আক্তার মেয়ের শোকে ঘুমের মাঝে এখনো চিৎকার করে ওঠেন। বিধাতার কাছে কিছুক্ষণ পর পর দুহাত তুলে দুঃখ সইবার শক্তি প্রার্থনা করেন। ঘরের সামনে কথা হয় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানের সঙ্গে। তিনি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার বিচার দাবি করেন। নোমান বলেন, কোনো আসামি যেন ছাড়া না পায়। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি মামলার তদন্তভার গ্রহণ করায় পিবিআইয়ের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। এ সময় তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, যতদিন পুলিশ পাহারা আছে ততদিন হয়তো নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা নেই। পুলিশ চলে গেলে আমরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ব। এ বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নুসরাতের ভাই বলেন, আমার বোনের মৃত্যুর পর বাড়ি থেকে বের হতে পারি না। আমাদের মাঝে অজানা এক আতঙ্ক ভর করেছে। ঘর থেকে বের হতেই ভয় পাচ্ছি। মনে হচ্ছে খুনিদের সহযোগীরা আমাদের অনুসরণ করছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App