×

মুক্তচিন্তা

শেয়ারবাজারের সংকট: প্রাসঙ্গিক কথা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০১৯, ০৮:৩৭ পিএম

বাংলাদেশের আইপিও মার্কেটে কোনো তারল্য সংকট হবে না। বিনিয়োগকারীর অভাব হবে না যদি ন্যূনতম গুণসম্পন্ন শেয়ারবাজারে আনা যায়। আইপিওর জন্য রিজার্ভ কোটা কিংবা বুক বিল্ডিংয়ের বিষয় নিয়ে বিএসইসি বেশি রদবদল বা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় চেষ্টা না করাই ভালো। খুব বড় ইস্যু না হলে স্বাভাবিক আইপিও ছাড়লে ক্রেতার অভাব হবে না। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীরা বহুবার এটা প্রমাণ করে দিয়েছে।

গত কয়েকদিন যাবৎ অব্যাহতভাবে শেয়ারের দাম পড়ে চলেছে। এমনকি শক্তিশালী ভিতে অবস্থান করা শেয়ারও এ বিপর্যয় থেকে রেহাই পাচ্ছে না। উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে অনেক ঢাকঢোল বাজিয়ে পুঁজিবাজার মেলা অনুষ্ঠিত হলো। সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ সরকারি-বেসরকারি সুধীজনরা এসে অনেক জ্ঞানদান করলেন, কিছু প্রস্তাবও রাখলেন। কিন্তু সেই মাঝির মতো বলতে হয় সাঁতার জানেন তো, তাই সবটুকু বৃথা। এই মেলায় পর শুরু হলো দরপতন, কেউ বোধহয় সাঁতার জানেন না, নইলে এমনটা হলো কেন? যাহোক শেয়ারের দরপতনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদ ও সংবাদ সম্মেলন হচ্ছে। এসবের আলোকে সাধারণ মানুষের মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছে।

ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেছেন যে, মানসম্মত শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে এলে অবস্থার উন্নতি হবে। উন্নত মানের আইপিও না আসায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারিয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, যে গত কয়েক বছর একই স্টাইলে বাজারে আইপিওর মাধ্যমে শেয়ার আসছে। কোনো হঠাৎ পরিবর্তন হয়নি যে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হবে। আর দেশেরও সামগ্রিক রাজনৈতিক সামাজিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরঞ্চ প্রবৃদ্ধির হার তো ভালো।

দেশের ভেতরে-বাইরে সর্বত্র নন্দিত হচ্ছে। ডিবিএর চেয়ারম্যানের কথা মনে হচ্ছে যে প্রচুর নিম্নমানের শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে এসেছে। কেন এমনটা হবে, শেয়ার ছাড়ার আগে তো বিএসইসি (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন) সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সব কাগজ (হিসাবপত্রসহ) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকে। স্টক এক্সচেঞ্জকে প্রসপেকটাস ছাপানোর আগে অনুলিপি দেয়া হয়। তারপর তালিকাভুক্তির শর্তাবলী পালন করতে হয়। তাহলে নিম্নমানের শেয়ার বাজারে ঢুকল কীভাবে, এটা জানার অধিকার তো সবার রয়েছে। এখানে প্রাসঙ্গিক আরেকটা কথা আসে, পুঁজিবাজার মেলায় একজন বক্তা বলেছেন যে অধিক পরিমাণে আইপিও বাজারে আসতে হবে। শেয়ারবাজারের মাধ্যমে পুঁজি সংগ্রহ করতে হবে, দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির উৎস হবে পুঁজিবাজার। আর সেটি সম্ভব হবে আইপিওর মাধ্যমে।

কেননা স্টক এক্সচেঞ্জ তো বাজার যেখানে সিকিউরিটিজ লেনদেন হয়। এটা পুঁজির উৎস নয়। যিনি এ কথা বলেছেন তিনি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, তার কাছে কি জানতে চাওয়া হয়েছিল যে সাবেক অর্থমন্ত্রীর বারবার আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও সরকারের পোর্টফোলিও থেকে একটি শেয়ারও বাজারে ছাড়া হয়নি। বাংলাদেশের প্রায় সব বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী ডিবিএর সদস্য। তাদের অনেকেরই লব্ধ প্রতিষ্ঠিত শিল্প রয়েছে, সেসব কোম্পানিকে আইপিওর মাধ্যমে শেয়ার আনতে বলা হয়েছে কি? কথা বলে বদান্যতা বাড়িতে শুরু হয়। বিদেশি/বহুজাতিক কোম্পানি তো বিশ্বের আঙ্গিকে সিদ্ধান্ত নেবে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের এক সময়ের তালিকাভুক্ত কোম্পানি যেসব ফিলিপস, আইসিআই এখানে থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছে এসব কথা মাথায় রাখতে হবে। সরকার এক যুগেরও বেশি সময় আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করল। অথচ আজ পর্যন্ত একটি শেয়ারও জনগণের কাছে বিক্রয় করা হয়নি। সেই যে কথায় বলে ডেনমার্কের যুবরাজ ছাড়া কি হ্যামলেট নাটক করা যায়? সরকার নিজেই যদি এগিয়ে না আসে, তাহলে অপরকে আসার আহ্বান কতটা যুক্তিসঙ্গত।

শেয়ারবাজারের বর্তমান সংকটের অন্যতম কারণ বলা হচ্ছে তারল্য সংকট। শেয়ার বাজারে তো তারাই বিনিয়োগ করতে আসবেন যাদের বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। ধারের টাকা দিয়ে রক্ষণশীল বিনিয়োগকারী শেয়ার কেনার কথা নয়। আসলে শেয়ার বাজারে দুই শ্রেণির বিনিয়োগকারী রয়েছে। একটি শ্রেণি তার নিজের সঞ্চয়ের মধ্যে সীমিত থাকতে চান। আর একটি শ্রেণি যারা শেয়ারে বিনিয়োগকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। এদের সংখ্যা এবং প্রভাব বেশি। এটি অবশ্য বিশ্বের স্টক এক্সচেঞ্জে। এদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য তারল্য সরবরাহের কথা ওঠে ব্যাংক বা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে, আর যে অঘটনগুলো ঘটে তার উৎস এখানেই। এর ফলে অনেক সময় নানা প্ররোচনায় সাধারণ বিনিয়োগকারী বিভ্রান্ত হয় এবং সর্বশান্ত হয়ে পথে বসেন।

যেমন ঘটেছে বাংলাদেশে ১৯৯৬ এবং ২০০৯-১০ সালে। ২০০৯-১০ সালে তো অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে একটি ভুল বার্তা জনগণের কাছে গেল। তৎকালীন সরকারি দলের কিছু লোক যারা ডিএসইর সঙ্গে জড়িত তারা এমন প্রচার করলেন যে সরকার স্টক এক্সচেঞ্জের রক্ষাকবচ। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দিগি¦দিক জ্ঞান হারিয়ে শেয়ারবাজারে আসলেন। এরপর সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হলেন। তবে এই ঘটনার ভালো দিক হলো স্টক এক্সচেঞ্জকে ডিমিউচুয়ালাইজ করা হলো।

অর্থাৎ আগে স্টক এক্সচেঞ্জ দুটো প্রাইভেট মেম্বার্স ক্লাব ছিল, তা থেকে কর্পোরেট শাসন প্রতিষ্ঠিত গণমুখী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। তারপরও নানা ধরনের সমস্যা থাকবে। তবে ১৯৯৬ বা ২০১০ সালের মহাবিপর্যয়ের সম্ভাবনা এখন অনেক কম।

যা হোক শেয়ারবাজারে মন্দাভাব দেখা দিলে তারল্য সংকটের কথা বেশি না বলে শেয়ারবাজারে কোনো কারচুপি বা চক্রান্ত হচ্ছে কিনা সে দিকটা লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। শেয়ারবাজারেও আর দশটি বাজারের মতো দাম উঠবে পড়বে। স্টক এক্সচেঞ্জে কোনো দ্রব্য উৎপাদন হয় না যে নতুন করে অর্থের আগমন ঘটবে। এটা জিরোসাম গেম, একজন কিনবে, আরেকজন বেচবে। লাভ-লোকসান তাদের বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভর করবে। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় পুঁজিবাদের দর্শন অক্ষত রাখার জন্য বিভিন্ন কলাকৌশল অবলম্বন করে। শেয়ারবাজারের বাজার মূলধন সেরকম। একটি নির্দিষ্ট দিনে বাজার মূল্য হিসেবে সব শেয়ারের মূল্য যোগ দিয়ে বাজার মূলধন নির্ণয় করা হয়। এখন একটি কোম্পানির মাত্র কয়েকটি শেয়ার বেশ কম দামে বিক্রয় করার সঙ্গে সঙ্গে বাজার মূলধনের পরিমাণ কমে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকার শিরোনাম হবে যে বাজার থেকে এত কোটি উধাও। অবস্থা বুঝে এই প্রচারকে কাজে লাগানো হয়ে থাকে। বর্তমানে আরো একটি হিসাব চলছে জিডিপি ও মাথাপিছু আয়।

আর ভারত ইংল্যান্ডকে হটিয়ে দিয়ে বিশ্বে পঞ্চম অর্থনীতি, অথচ বিশ্বে আর কোনো দেশে এত লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে না যেটা ভারতের বেলায় প্রযোজ্য। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের সরকাররা এই কথিত উন্নয়নে আত্মতৃপ্তি লাভ করছেন সে দেশের সাধারণ মানুষ যত কষ্টেই থাকুক না কেন। পশ্চিমের এক পত্রিকার সাংবাদিক ঠাট্টা করে লিখেছিলেন বিল গেটস যখন কোনো ক্লাবে যান, তখন সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার সবাই বিলিয়নিয়ার হয়ে যান। যাহোক বিএসইসি এখন যথেষ্ট অভিজ্ঞ।

আমরা আশা করব যে অস্বাভাবিক দরপতন বা উত্থানে তারা অস্থির হবেন না। জনস্বার্থকে সামনে রেখে ব্যবস্থা নেবেন। প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করবেন। কৃত্রিম উপায়ে মার্কেটকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করবেন না।

বাংলাদেশের আইপিও মার্কেটে কোনো তারল্য সংকট হবে না। বিনিয়োগকারীর অভাব হবে না যদি ন্যূনতম গুণসম্পন্ন শেয়ারবাজারে আনা যায়। আইপিওর জন্য রিজার্ভ কোটা কিংবা বুক বিল্ডিংয়ের বিষয় নিয়ে বিএসইসি বেশি রদবদল বা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় চেষ্টা না করাই ভালো। খুব বড় ইস্যু না হলে স্বাভাবিক আইপিও ছাড়লে ক্রেতার অভাব হবে না। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীরা বহুবার এটা প্রমাণ করে দিয়েছে।

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ: সাবেক ইপিসিএস ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App