×

মুক্তচিন্তা

পাকিস্তান সামরিক আদালতের নির্দেশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০১৯, ০৮:৩৮ পিএম

আজ যখন পাকিস্তান সামরিক আদালতের যে নির্দেশের ওপর স্মৃতিচারণ করছি, তখন মনে পড়ছে, যে বাংলাদেশের জন্য সংগ্রাম করেছি, যুদ্ধ করেছি, পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী যেখানে আমাদের অবর্তমানে ১৪ বছর সাজা দিয়েছে, সেই বাংলাদেশেও আমাকে অন্তত ৭ বার কারাগারে যেতে হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একনাগাড়ে ৩৩ মাস ময়মনসিংহ এবং কুষ্টিয়া কারাগারে বন্দি ছিলাম। ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দি অবস্থায় আমাকে কনডেম সেলে রাখা হয়েছিল। ৩ মাস আমি সূর্যের আলো দেখিনি।

১৯৭১-এর ২০ এপ্রিল আমার জীবনের এক বিশেষ দিন। এই দিনে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক সরকার সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের মহামান্য উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, বেতারের উপদেষ্টা আবদুল মান্নান এমসিএ, দি পিপ্ল পত্রিকার সম্পাদক আবিদুর রহমান এবং আমাকে ২৬ এপ্রিল সকাল ৮টায় সামরিক আদালতে সশরীরে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়।

১৯৭১-এর এই দিনে প্রকাশিত সব পত্রিকায় আমাদের ৫ জনকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশটি সিঙ্গেল কলামে ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল ‘৫ ব্যক্তির প্রতি সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ সকাশে হাজির হওয়ার নির্দেশ।’ আমাদের সবার বিরুদ্ধে পাকিস্তান পেনাল কোডের ১২১, ১২৩ক, ১৩১ ও ১৩২; এবং সামরিক বিধি ৬, ১৪, ১৭ ও ২০ এবং ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক নির্দেশ ১২৪ ও ১২৯ আইনের আওতায় অভিযোগ আনা হয়। এই নির্দেশে একমাত্র আবিদুর রহমান ছাড়া অন্য কারো কোনো পেশাগত পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। এটা ছিল পাকিস্তান সামরিক সরকারের একটি হাস্যকর অপপ্রয়াস। কারণ যাদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তারা বাংলার মানুষের কাছে সুপরিচিত রাজনীতিক এবং জনপ্রতিনিধি। বলাবাহুল্য, সে দিন আমরা কেউই বেলুচিস্তানের কসাইখ্যাত জেনারেল টিক্কা খানের আদালতে হাজির হইনি। সামরিক আদালত ১৯৭১-এর ৮ জুন, আমাদের অনুপস্থিতিতে প্রত্যেককে ১৪ বছর সশ্রম কারাদ- এবং সম্পত্তির ৫০ শতাংশ বাজেয়াপ্ত করে।

মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর থেকে পাকিস্তান বহির্বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিল পুরো এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’ ও ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিহিত করে প্রচার করত ‘তাদের নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে’। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকবাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরুর পরপর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ফলে অখণ্ড পাকিস্তানের কফিনে যে শেষ পেরেকটি ঠোকা হয়েছিল, ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অনুসারে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুক্তাঞ্চল বৈদ্যনাথতলাকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ‘মুজিবনগর’ ঘোষণা করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে সেই কফিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাধিস্থ করা হয়। সে দিনের সেই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক এবং বৈপ্লবিক অভ্যুদয়। দেশের অভ্যন্তরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানটি নিষ্ঠুর গণহত্যার খলনায়ক জেনারেল টিক্কা খান ও সামরিক শাসকদের জন্য ছিল চরম আঘাত। এ রকম আঘাতের পর জেনারেল টিক্কা খান আরো হিংস্র হয়ে ওঠে এবং আমাদের বিরুদ্ধে সামরিক নির্দেশ জারি করে।

আমাদের বিরুদ্ধে সামরিক ট্রাইব্যুনালের রায় ভারতের মাটিতে বসে শুনলাম এবং হাসলাম। কারণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তখন এগিয়ে চলেছে। মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান হিসেবে ৭টি জেলার দায়িত্বে ছিলাম আমি। পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালী। এই অঞ্চলের মুজিব বাহিনীর সদস্যদের দেরাদুনে প্রশিক্ষণের পর বিমানে করে দমদম বিমানবন্দর, এরপর ব্যারাকপুরে আমার যে ক্যাম্প ছিল সেখানে তারা অবস্থান করত। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে তাদের বাংলাদেশে প্রবেশ করাতাম। পাকিস্তান সামরিক শাসকগোষ্ঠী আমাদের প্রতি যে কী নিষ্ঠুর ছিল তা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এবং এই মামলার রায় থেকে উপলব্ধি করা যায়। আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে। ভাবতে কত ভালো লাগে জাতির জনকের নির্দেশিত পথেই আমরা প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছি।

বঙ্গবন্ধু সে দিন বলেছিলেন, ‘তোমাদের জন্য আমি সব রেখে গেছি। যে নির্দেশ আমি দিয়েছি। সেই নির্দেশিত পথে তোমরা পরিচালিত হও। বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে গেলে তোমরা সর্বাত্মক সাহায্য পাবে।’ ভারতে গিয়ে চিত্তরঞ্জন সুতার (সূত্রধর) যে বাড়িতে অবস্থান করতেন অর্থাৎ ‘সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা’, সেই বাড়িতেই আমরা অবস্থান করেছি। সেখান থেকেই মুজিব বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনা করেছি। চিত্তরঞ্জন সুতার ছিলেন বামপন্থি নেতা। তিনি জীবনে বহুবার কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন।

১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য খরচ হিসেবে বঙ্গবন্ধু আমাকে ২৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। নির্বাচনে খরচ হয়েছিল ২১ হাজার টাকা। বাকি ৪ হাজার টাকা ইউনাইটেড ব্যাংকের ভোলা শাখায় জমা ছিল। পাকিস্তান সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে। দেশ স্বাধীনের পর ফেরত পেয়েছিলাম।

সে দিন অভিযুক্তদের মধ্যে ৪ জন ব্যক্তিই আজ প্রয়াত। জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ উভয়েই ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সশস্ত্র বাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্যের গুলিতে শহীদ হন। মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও বেতার উপদেষ্টা আবদুল মান্নান- স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকারে স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন- কয়েক বছর আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। কবি-সাংবাদিক-শিল্পপতি হিসেবে সুপরিচিত ‘দি পিপ্ল’ পত্রিকার সম্পাদক নিভৃতচারী সজ্জন মানুষ আবিদুর রহমান ইতোমধ্যে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। এখন বেঁচে আছি কেবল আমি। যে প্রশ্নটি আমায় নিয়তই তাড়া করে, সে দিন কেন আমাদের সঙ্গে আবিদুর রহমানকেও পাকিস্তান সামরিক সরকার জড়িত করেছিল? আসলে সামরিক সরকার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চেয়েছিল।

কারণ আবিদুর রহমান সম্পাদিত ইংরেজি পত্রিকা ‘দি পিপ্ল’ ছিল জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নির্ভীক কণ্ঠস্বর। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বিপরীতে অবস্থিত ‘দি পিপ্ল’ পত্রিকার দপ্তরটি ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে গ্রেনেড ও ট্যাংক হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় পাকবাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর অফিসটির ধ্বংসস্তূপ থেকে পত্রিকাটির দুজন কর্মীর পোড়া কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। কত ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছি। বিভীষিকাময় ২৫ মার্চ কালরাতে গ্রিন রোডে অবস্থিত ‘চন্দ্রশিলা’ নামক যে বাসায়- আমি এবং প্রয়াত শ্রদ্ধাভাজন নেতা আবদুর রাজ্জাক- থাকতাম, পাকবাহিনী তা ধ্বংস করে দেয়।

সেখানে সংরক্ষিত ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনের দুর্লভ ছবি, দেশি-বিদেশি খবরের কাগজ ও দলিলপত্রাদি ভস্মীভূত হয়। আজ যখন পাকিস্তান সামরিক আদালতের যে নির্দেশের ওপর স্মৃতিচারণ করছি, তখন মনে পড়ছে, যে বাংলাদেশের জন্য সংগ্রাম করেছি, যুদ্ধ করেছি, পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী যেখানে আমাদের অবর্তমানে ১৪ বছর সাজা দিয়েছে, সেই বাংলাদেশেও আমাকে অন্তত ৭ বার কারাগারে যেতে হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একনাগাড়ে ৩৩ মাস ময়মনসিংহ এবং কুষ্টিয়া কারাগারে বন্দি ছিলাম। ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দি অবস্থায় আমাকে কনডেম সেলে রাখা হয়েছিল। ৩ মাস আমি সূর্যের আলো দেখিনি।

এ সময় আবিদুর রহমান ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দি ছিলেন। তাকে ২০ মাস কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। ১৯৮২-এর ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের পর আমাদের এক কর্মীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করলে সাজেদা চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম এবং আমাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে সাভার থানায় আটকে রাখে। একই বছরে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে আমাকে গ্রেপ্তার করে চোখ বেঁধে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে ৮ দিন, এরপর কেন্দ্রীয় কারাগারে ২ দিন রেখে সিলেট কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

১৯৮৪-এ গ্রেপ্তার করে কুমিল্লা কারাগারে ৬ মাস বন্দি করে রেখেছিল। ১৯৮৭-এ ভোলা থেকে আমাকে গ্রেপ্তার করে বরিশাল কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি রাখা হয়েছিল। ১৯৯৬-এ নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে আমাকে গ্রেপ্তার করে রাজশাহী কারাগারে ফাঁসির আসামির মতো দিন কাটাতে হয়েছে।

২০০২-এ চিকিৎসা শেষে বিদেশ থেকে ফেরার পর গ্রেপ্তার করে প্রথমে ক্যান্টনমেন্ট থানায় ১ রাত পরে কাশিমপুর কারাগারে ফাঁসির আসামি এরশাদ শিকদারকে যে কক্ষে রাখা হয়েছিল সেই কক্ষে রেখে ১২ দিন পর কুষ্টিয়া কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। জীবনে জেল-জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছি। সবচেয়ে দুঃখ লেগেছে, ২০০২-এ যখন কাশিমপুর থেকে আমাকে কুষ্টিয়া কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, আরিচা ফেরিঘাটে একটি পতাকাবাহী গাড়ি দেখলাম; জানলাম স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী তৎকালীন সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ গাড়িতে করে যাচ্ছেন। ভাবলাম, যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, সংগ্রাম করেছি, সেই দেশের মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক- আমার হাতে হাতকড়া, আর স্বাধীনতাবিরোধী মুজাহিদের গাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা!

আবার, ২০০৭-এ ১/১১-এর মধ্যে আমাকে, আমার স্ত্রী ও মেয়েসহ দুর্নীতি মামলার আসামি করা হয়েছিল। এই দুঃখ রাখব কোথায়? জীবনে এসব সহ্য করতে হয়েছে। যখন ১৯৮২-এ ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদকালে আমার চোখ ছিল বাঁধা! তখন ভাবছিলাম পাকিস্তান আমলেও সেই ১৯৬৯-এর ১৭ সেপ্টেম্বর আমরা যখন সামরিক আইন ভঙ্গ করেছিলাম, তখন ‘সামারি মিলিটারি কোর্টে’ আমাকে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু আমার চোখ ছিল খোলা। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে? কর্নেল আকবর, আমি দেখতে পেয়েছি একজন কর্নেল আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। যে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখে ভাবতাম, একদিন বাংলার সন্তানেরাই হবে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীর প্রধান- সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস, পাকিস্তান আমলে জিজ্ঞাসাবাদের সময় চোখ ছিল খোলা, আর স্বাধীন বাংলাদেশে জিজ্ঞাসাবাদের সময় চোখ ছিল বাঁধা। কোনো কিছুতেই কোনো দুঃখ নেই! কেননা, এই ক্ষুদ্র জীবনে এমন এক মহান নেতার সান্নিধ্য পেয়েছি যে, জীবন আমার ধন্য।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর সবকিছুই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যে বীজ তিনি রোপণ করেন, তা বাস্তবায়নে ধাপে ধাপে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬৬-এর ৬ দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং পরিশেষে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ।

১৯৭০-এর নির্বাচনের পরপরই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সামরিক শাসকগোষ্ঠী বিজয়ী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তখন থেকেই তিনি স্থির করেন রাজনৈতিক ঘটনাধারাকে এমনভাবে নিয়ে যাবেন যে, ওরা হবে আক্রমণকারী আর আক্রান্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে সারা বিশ্বের সমর্থন পাবেন। যাতে কোনো পক্ষই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ তুলতে না পারে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রজ্ঞাবান, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতা। শ্রী চিত্তরঞ্জন সুতারকে বঙ্গবন্ধু ভারতে পাঠিয়েছিলেন। চিত্তরঞ্জন সুতার বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ভারতে গিয়ে আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানেই বঙ্গবন্ধু ক্ষান্ত হননি। সিরাজগঞ্জ থেকে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্য আমার প্রিয় বন্ধু ডা. আবু হেনাকে অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে ভারতে পাঠিয়েছিলেন।

আবু হেনা যে পথে গিয়েছিলেন ও যে পথে ফিরে এসেছিলেন, ঠিক সেই পথেই ২৯ মার্চ কেরানীগঞ্জ থেকে দোহার-নবাবগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, সারিয়াকান্দি-বগুড়া হয়ে ৪ এপ্রিল আমরা ভারতে পৌঁছাই। সঙ্গে ছিলেন জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, জাতীয় নেতা এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও শেখ ফজলুল হক মনি। আর ডা. আবু হেনা ছিলেন আমাদের পথপ্রদর্শক। মুক্তিযুদ্ধের ৯টি মাস আবু হেনা আমাদের সঙ্গে থেকে নিরলসভাবে কাজ করেছেন।

মনে পড়ে, ১৭ এপ্রিল প্রথম বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে বজ্রকণ্ঠে স্লোগান তুলেছিলাম, ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’; ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’; ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’; ‘আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’; ‘আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’; ‘জয় বাংলা’। শত-সহস্র মুক্তিযোদ্ধা কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে সমবেতভাবে স্লোগনে স্লোগনে মুখরিত করেছে মুজিবনগরের আম্রকানন। সে দিন আমার পরিবার-পরিজন জানত না আমি কোথায় আছি, কীভাবে আছি বা আদৌ বেঁচে আছি কিনা। মহান মুক্তিযুদ্ধের মহিমান্বিত সেসব দিনের কথা ভাবলে গর্বে আজো বুক ভরে ওঠে।

তোফায়েল আহমেদ: আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App