×

মুক্তচিন্তা

ভবনটি সুশ্রী ছিল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০১৯, ১০:১৬ পিএম

জায়গাটি উদ্ধার হয়েছে। এখন ভবন ভাঙতে যে সময়টি লাগবে, তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ইতোপূর্বে আমরা ৮ বছর অপেক্ষা করেছিলাম সেটির অবসান ঘটিয়েছেন মহামান্য হাইকোর্ট। ভবিষ্যতে যেন কেউ আর জনস্বার্থবিরোধী, পরিবেশবিরোধী কাজ করতে না পারে এবং আইন ভঙ্গের অপরাধে অবশ্যই দণ্ডনীয় হওয়া উচিত। মাননীয় হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন তার বিস্তারিত আমার মতো সাধারণের জানা নেই। তবে মনে করি যারা এসব অন্যায় কাজ করেন তাদের জন্য আইন কঠোর হওয়া বাঞ্ছনীয়।

স্বদেশ যেমন একটি আছে, স্বকালও তেমনি একটি আছে। স্বদেশকে ভালো না বাসিলে যেমন স্বদেশের কাজ করা যায় না, তেমনি স্বকালকেও ভালো না বাসিলে স্বকালের কাজ করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ও সমাজ, চিঠিপত্র ২। আমার শৈশব-কৈশোরে স্বদেশকে কতটুকু ভালোবেসেছি কি বাসিনি, সে কথা মনে থাকলেও মনে আছে কৈশোরের সেই সোনা মাখানো দিনগুলোর কথা। নিয়মিত মার্বেল খেলা, ঘুড়ি উড়ানো এবং স্কুল ছুটির পর সদলবলে মুনছুর হাজীর বিশাল মাঠে, আরিপপুর, দোহারপাড়ার এবং ব্রজনাথপুরের ছেলেরা একসঙ্গে ফুটবল খেলেছি। বেশ অনেকবার সে খেলায় হেরেছি, জিতিনি। এখনকি ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে বারকয়েক ভোকাট্টা হয়ে আমার ঘুড়ি পাবনা শহরের দিকে গা ভাসিয়ে বাতাসের সঙ্গে হাসতে হাসতে কখন যে অলক্ষ্যে চলে গিয়েছে, সে কথা আজ মনে না থাকলেও ওই ঘুড়ি উড়ানো নিয়ে অনেকবার মারামারি করেছি মাসুদ চাচার ছেলে কাউয়ুমের সঙ্গে। কাইয়ুম প্রতিনিয়ত তার ঘুড়ির সুতোয় কাচের গুঁড়ো আর ময়দার লেই দিয়ে মাঞ্জা দিত পরীমার্কা সুতোর রিলে। পরীমার্কা সুতোর রিল ছিল মাত্র এক আনা। আমার পক্ষে সেই এক আনা পয়সা জোগাড় করা সম্ভব না হলেও, মাঞ্জাবিহীন সুতোর ওপর নির্ভর করেই ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে আগেই কাইয়ুমকে বলতাম, তুই আমার ঘুড়ি কেটে দিসনে। ও আমার কথা না শুনেই, যেদিন ঘুড়ি কেটে দিত, সেইদিনই হতো মারামারি। শেষ অব্দি মারামারিতে আমি অধিকাংশ সময়ই জিতে যেতাম, আমার লটাইটি ছিল তেঁতুল কাঠের। সেই তেঁতুল কাঠের লাটাই যেমন ছিল শক্ত, তেমনি ছিল ভারী। কাইয়ুমের শরীরে-হাতে-পিঠে দু-একটি ঘা দিয়েই পালিয়ে যেতাম আমাদের বাড়ির দিকে। এমনিতর ছিল আমাদের সেই আদ্যিকাল।

যে কাইয়ুমের সঙ্গে গতকাল ঘুড়ি উড়ানো নিয়ে মারামারি হলো, তাকেই আমি আজকে ফুটবল খেলতে নিয়ে গেলাম সেই হাজীর মাঠে, খেলা শেষে হাত-মুখ ধুয়ে কিছুটা সময় জায়গির মাস্টার ফজলুর কাছে পড়ালেখা শেষ করে চাঁদনি রাত হলে আমাদের দোহারপাড়ার বাড়ির বিশাল উঠোনের কোন সন্ধ্যায় চোখ বাঁধা থাকায় কপাল টোকা এবং চি-বুড়ি খেলতাম। আমরা আপন ভাইবোন এবং দুই-তিন চাচার ছেলেমেয়েরা একত্রিত হয়ে খেলতাম, সে খেলাতেও ছিল হারজিত। মেজো চাচা শেখ হাবিবুর রহমান দেশ ভাগ হওয়ার আগে প্রায়ই পাবনা থেকে কলকাতায় গিয়ে আমাদের পার্ক সার্কাসের বাড়িতে থেকে- তিনি তার প্রিয় দল ইস্ট বেঙ্গল, মোহনবাগানের ফুটবল খেলা দেখে ফিরতেন। যেবার ইস্ট বেঙ্গল কিংবা মোহামেডানের খেলা থাকত, তিনি দোহারপাড়া আমার অন্য দুই চাচাকে এবং তার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ঈশ্বরদী হয়ে কলকাতায় পাড়ি দিতেন, ফিরে এসে গল্প করতেন, ফুটবলের জাদুকর আব্দুস সামাদের কথা বলতেন, হাবিব এবং বাচ্চিখানদের কথা। চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন এবং আমাদের দোহারপাড়া আর ব্রজনাথপুর কালীদহের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ঢোল, ডগর, বাঁশি বাজিয়ে চলে যেতেন রাধানগরের চৈত্র পূজার মেলায়। সেই মেলায়ই একদিন পরে হয়ে যেত বৈশাখী মেলা। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ শেষ হতেই শুরু হতো আম-কাঁঠালের মেলা আরিপপুরের আমাদের সেই ফুটবল খেলার মাঠে। আসত আষাঢ় মাসের একটানা সাত দিনের পচানো আঁদল- আঁদল অর্থাৎ বৃষ্টি। পাবনার আঞ্চলিক ভাষায় এখনো বৃষ্টিকে ওই আদলেই বলা হয়ে থাকে। তবে এখন সপ্তাহব্যাপী বৃষ্টি হয় কিনা আমার জানা নেই। আষাঢ় শেষ হতে না হতেই এলো শ্রাবণ। সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু সহপাঠীদের রথের মেলা, যে মেলা হতো পাবনা শহরের কালাচাঁদপাড়ার কেপি ইউনিয়নের খেলার মাঠে। বিগত বছরে পাবনা এবং সিরাজগঞ্জ মিলিয়ে প্রায় ৩৩৭টি থেকে ৩৫০টি পূজা মণ্ডপ হয়েছিল- জানিয়েছিলেন রাজশাহী বেতারের পাবনাস্থ সংবাদদাতা শ্রী দ্বিজেনচন্দ্র তরফদার। সব ধর্মেই আনন্দ উৎসব আছে এবং থাকবে। থাকবে পাওয়া না পাওয়ার কথকতা। আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত অনেক ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে, তবে অনেকেই কিংবা সংঘবদ্ধভাবে যখন নৈতিকতার বাইরে গিয়ে সুদৃশ্য দৃষ্টিনন্দন ১০-১৫ তলা ভবন অন্যের জমিতে কিংবা সরকারের খাসজমিতে বিনা অনুমতিতে এমনকি ঢাকা শহরের রাজউকের নকশাবহির্ভূত ভবন বানিয়ে ফেলেন, সেটি অবশ্যই নিন্দনীয়। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বনানীর এফ আর ভবন, যে ভবনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ২৫ থেকে ২৬ জন মানুষকে পুড়ে মরতে হলো ভবন মালিকদের লোভের আগুনে। তবে ঢাকা শহরের দৃষ্টিনন্দন একটি ভবন ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমরা দেখেছিলাম, পান্থপথ এবং পুরাতন এয়ারপোর্ট রোডের মাঝামাঝি জায়গায় একটি বিশাল ভবন, সেই ভবন তৎকালীন সরকারের নির্দেশে ভাঙতে গিয়ে শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন। আমাদের চোখের সামনে অচিরেই আরো একটি দৃষ্টিনন্দন ভবন ভাঙা হবে, সেটি বিজিএমইএর ভবন। ভবনটি হোটেল সোনারগাঁও সংলগ্ন হাতিরঝিলের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘকাল।

দীর্ঘ আট বছর আইনের লড়াইয়ে দেশের রপ্তানি আয়ের শীর্ষখাত তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারদের সংগঠন বানিয়েছিল দৃষ্টিনন্দন ভবনটি। যতদূর মনে পড়ে আমাদের দেশের দুই নেত্রী ভিত্তি স্থাপন এবং উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। যা হোক, ঢাকা শহরের হাতিরঝিল এলাকায় ওই দৃষ্টিনন্দন বিজিএমইএ ভবনটি ভাঙতে মাননীয় হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ভবনটি আসলেই সুন্দর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাকালেই আমার বারবার মনে হয়েছে কুয়ালালামপুরের একটি সুউচ্চ ভবনের কথা। মালায়ালামরা ভবনটি আবৃত করেছেন নীল বর্ণের কাচ দিয়ে, আমাদের হাতিরঝিলের ভবনটিও আবৃত ওই একই বর্ণের কাচে। হাতিরঝিল একদা ছিল চিত্রা নদীর একটি শাখা, চিত্রা নদীর ওই শাখা দিয়ে বড় বড় নৌকায় মালামাল নিয়ে যাতায়াত করতেন সদরঘাটে। এ প্রসঙ্গে বলা যায় বিশিষ্ট নাট্যকার সাঈদ আহমদ (যিনি কাদের সরদারের ভাইয়ের ছেলে হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত) আদি ঢাকাইয়া। তিনি আমাদের নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের এক রিহার্সেলে এসে সেকালের গল্প করেছিলেন। বলেছিলেন, আমরা সপরিবার ঢাকার সদরঘাটের বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে প্রায় দেড় দিন ধরে আমাদের বাড়ির সবাই বিশাল একটি নৌকায় চড়ে আনন্দে আনন্দে চলে যেতাম মিরপুরের শাহ আলীর মাজারে। নৌপথে অনেক ঘুরে পৌঁছাতাম এবং চারদিক ঘন সবুজ গাছপালা, সেই গাছপালার আড়ালে-আবডালে থাকত ঠাঙ্গরের দল অর্থাৎ ডাকাত। এখন বলা যেতে পারে (বিখ্যাত নাট্যকার সাঈদ আহমদের মাইল পোস্ট নাটকটি ইংরেজি ভাষায় লিখিত। জনাব আহমদ পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন) হাজার হাজার লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ ব্যয়ে হাইকোর্টের নির্দেশে এত সুন্দর ভবনটিকে ভেঙে ফেলতে হবে। আমার বিশ্বাস বা ধারণা আমরা হয়তো অনেকেই জানি না ওই ভবনটির সম্পত্তির ইতিহাস। জানি অনেকেই দৃষ্টিনন্দন এ ভবনটি ভাঙলে দুঃখ পাবেন। জমিটির পত্তন দেয়া ও নেয়া উভয়ই আইনবিরোধী। নীতিগতভাবে অবৈধ। অথচ সেই অবৈধ-অনৈতিক কাজটি করেছিল দেশের ধনিক শ্রেণির একটা লোভাতুর দল। যদিও তারা ঢাকা শহরের উত্তরে কিংবা পুবে, পশ্চিমে জায়গা-জমি কিনে নিতে পারতেন, সে কাজটি না করে করেছিলেন জনস্বার্থবিরোধী কাজ। অপরদিকে যতদূর জানা গিয়েছে, এই ভবনটি রাজউকের অনুমোদন যোগ্য নয়। কারণ হলো জনগণের ব্যবহার্য জমি এবং চিত্রা নদীর খাসজমি। জমিটি নাকি হোটেল সোনারগাঁও সম্প্রসারণের জন্য চাওয়া হয়েছিল। তাদের দেয়া হয়নি। কেমন করে এটি বিজিএমইএর দখলে গেল, সে রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি। জায়গাটি নিয়ে কিছু কথা শোনা যায়- ১৯৮৫-৮৭ সালে সিএসসি মোকাম্মেল হক ছিলেন ভূমি সচিব। ঢাকার যে কোনো জমি অধিগ্রহণ করতে হলে তখন মন্ত্রীকেই অধিগ্রহণ করতে হতো। আমার যতদূর মনে পড়ে তখনকার রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে ভূমিমন্ত্রী ছিলেন একেএম মাইদুল ইসলাম এমপি এবং নিয়মটা এখনো বর্তমান। ঢাকার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রস্তাব যেত, মন্ত্রী মহোদয়ের দপ্তরে রাজউকসহ অন্য সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে। তবে জমিটি আসলে রেলওয়ে সড়ক এবং চিত্রা নদীর খাসজমি। আমার ধারণা ভবন কর্তৃপক্ষ কমবেশি অনেকেই জানতেন, জমি খাস এবং চিত্রা নদীর ওপর এত বিশাল ভবন তৈরি করলেন বিত্তশালীরা অনৈতিকভাবেই। হাতিরঝিলের জমিগুলোকে দখলে নেয়ার জন্য অনেকেই চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও হয়নি বিজিএমইএ।

জায়গাটি উদ্ধার হয়েছে। এখন ভবন ভাঙতে যে সময়টি লাগবে, তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ইতোপূর্বে আমরা ৮ বছর অপেক্ষা করেছিলাম সেটির অবসান ঘটিয়েছেন মহামান্য হাইকোর্ট। ভবিষ্যতে যেন কেউ আর জনস্বার্থবিরোধী, পরিবেশবিরোধী কাজ করতে না পারে এবং আইন ভঙ্গের অপরাধে অবশ্যই দণ্ডনীয় হওয়া উচিত। জলাধার আইন অমান্য করে অন্য কেউ যেন ১৮ তলা থেকে ২২ তলা ভবন নির্মাণ না করতে পারে, সেদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিশেষত রাজউকের রাজদূতেরা সতর্ক হলেই তবেই মঙ্গল। সবাই জানি রাজদূতেরা অর্থের বিনিময়ে যা কিছু তাই করতে পারেন। ভবনটির যারা ছিলেন বা রয়েছেন- তাদের স্বরূপ জনগণের সামনে উন্মোচন করা একান্তই প্রয়োজন। মাননীয় হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন তার বিস্তারিত আমার মতো সাধারণের জানা নেই। তবে মনে করি যারা এসব অন্যায় কাজ করেন তাদের জন্য আইন কঠোর হওয়া বাঞ্ছনীয়।

তবে অতি সম্প্রতি কয়েক একর জমির ওপর বিজেএমইএর নতুন ভবনটি নির্মিত হতে চলেছে উত্তরার পশ্চিমাংশে। আশা করি সেটিও দৃষ্টিনন্দন হবে। ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছেন ভবনটি। এই ভবনটিকে ঘিরেই বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বৈদেশিক অর্থ উপার্জনের একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। দিন কয়েক জানতে পারলাম এবারে বিজিএমইএর নির্বাচনে মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হকের নেতৃত্বাধীন ‘সম্মিলিত ফোরাম’ পূর্ণ প্যানেলে জয়ী হয়েছেন।

আশা করি ভবিষ্যতে তিনি দেশের অর্থনীতিতে এবং গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির সব শ্রমিকের আয়-উন্নতিতে সহযোগিতা দেবেন। রবীন্দ্রনাথের একটি উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। তার পথে ও পথের প্রান্তে থেকে ‘গতকাল বলে যে অতীত, সে আজই আছে, গতকাল সে ছিল না।’

মাকিদ হায়দার : কবি ও প্রাবন্ধিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App