×

মুক্তচিন্তা

নুসরাত ঝড় আমাদের দীর্ণ-বিদীর্ণ করেছে, আরো করুক...

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০১৯, ১০:০৯ পিএম

নুসরাত এক দৃপ্ত প্রতিবাদের নাম, নুসরাত এক অমিত সাহসের নাম। নুসরাতের মৃত্যু একটি ঝড়, এই ঝড় আমাদের বিবেককে লণ্ডভণ্ড করেছে। শুধু মৃত্যু নয়- নুসরাতের সাহসী প্রতিবাদ আমাদের জীর্ণ-শীর্ণ বিবেককে দীর্ণ-বিদীর্ণ করে দিয়েছে। তার সেই সাহসী প্রতিবাদের প্রেরণাকে সঙ্গী করে আমরা নিজেদের ঘরে ঘরে থাকা নুসরাতদের শানিত চেতনায় গড়ে তোলায় প্রত্যয়ী হবো।

দুর্বৃত্তদের হাতে অগ্নিদগ্ধ হওয়া নুসরাত চলে গেছে না ফেরার দেশে। নুসরাতের যুদ্ধকালীন পাঁচদিন চরম উদ্বিগ্নতা সঙ্গে নিয়ে আমরা তার পাশে ছিলাম। সমগ্র বাংলাদেশ তার পাশে ছিল। সমগ্র দেশবাসীর মতো প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও নুসরাতের পাশে ছিলেন গভীর আবেগ ও মমতায়ী ভালোবাসা নিয়ে। তিনি সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন নুসরাতের অবস্থা জানার জন্য। নুসরাতের সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের নির্দেশসহ নিয়মিত খোঁজখবরও নিয়েছেন। দেশ-বিদেশের যেখানেই হোক নুসরাতের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্যও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল। কিন্তু নরপশুরা-পিশাচের অধম ঘাতকেরা হতভাগ্য নুসরাতের এমনই অবস্থা করে দিয়েছিল যে, এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে উঠে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য সিঙ্গাপুর পর্যন্ত যাওয়ার অবস্থাটুকুও কাপুরুষরা ধ্বংস করে দিয়েছিল। দেশের নামিদামি চিকিৎসকরাও নুসরাতের সামনে এক ধরনের অসহায়ত্ব নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন চিকিৎসাসেবা দিতে না পারার অপারগতার জন্য। বাইরে স্বজনরা সর্বক্ষণ মহান সৃষ্টিকর্তার স্মরণে কত কিছুই না করেছেন! তাদের এই অসহায়ত্বের সঙ্গী হয়েছেন মানবিক বোধসম্পন্ন দেশবাসীর উৎকণ্ঠাও। দেশের সর্বোচ্চ পদ থেকে শুরু করে সুস্থ ও বিবেক বোধসম্পন্ন সাধারণ মানুষ যেমন নুসরাতের পাশে ছিল তেমনি নুসরাতকে ঘিরে গণমাধ্যমও সজাগ ছিল, সক্রিয় ছিল। সর্বক্ষণ আমাদের গণমাধ্যম নুসরাতকে সমর্থন দিয়েছে, ভরসা দিয়েছে। নুসরাতের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু অগ্নিদগ্ধ অভিমানী নুসরাত চারদিকে পাশ ফিরে নিজের সেই কিশোরী চোখ দিয়ে সামান্যতম তাকিয়ে বিন্দুমাত্র দেখার অবকাশটুকু পায়নি। নুসরাত বুঝতেই পারল না তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এ দেশের লাখো কোটি মানুষ। দেখতে পারল না লাখো কোটি মানুষ তার পাশে আছে, ছিল! অথচ নুসরাতকে কেবল দেখে যেতে হয়েছে বীভৎস হায়েনাদের মুখ, তাদের কালো হাতের নগ্ন থাবা, তাদের লোলুপ জিহ্বা আর কিছু সংঘবদ্ধ অসৎ ও অসাধু মানুষের স্থানীয় কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ও কৌশলের দৌরাত্ম্য!

প্রশাসনিকভাবে ক্ষমতাধর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও স্থানীয়ভাবে ‘সুখে’ থাকার জন্য অপরাধচক্রের হোতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রশাসনকেও ‘কালো’ করে ফেলে। সোনাগাজী থানার অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে এটুকু সহজেই বোঝা যায় যে, নুসরাত এসব কালোর বিরুদ্ধে সাহস নিয়ে একাই দাঁড়িয়েছিল। তার চারপাশে ছিল আমাদের বিকৃত মনস্তত্ত্বের সমাজমানসিকতা। তাই মাদ্রাসার অধ্যক্ষের নিপীড়নের পর তাকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও দ্বিতীয়বারের মতো নিপীড়ন করে। সেখানে তার বিচার চাওয়ার আহাজারিকে পর্যন্ত ভিডিও করে রাখে। রক্ষক যখন ভক্ষক হয় তখন সাধারণ মানুষের যাওয়ার আর কোনো পথই খোলা থাকে না। অথচ শক্তিধর এসব অপরাধী আইসিটি আইনের আওতায় পড়ে না! একের পর এক অপরাধ করেও ‘ধোয়া তুলসিপাতা’ থেকে যায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থেকে মাদ্রাসার শিক্ষক সিরাজ উদদৌলা পর্যন্ত। সমাজের এই চেহারা দেখে নুসরাতরা বাঁচতে পারে না- তাদের বাঁচারও দরকার নেই। এত অপমান ও আত্মগ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকার কোনো অর্থও নেই। আমাদের ঘরে ঘরে যত নুসরাত আছে তাদের এই গ্লানি থেকে কে মুক্ত করবে? ফেনীর নুসরাত কোনোভাবেই হায়েনার কালো থাবা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তাই কালবৈশাখী প্রলয় ঝড়ের মতো নুসরাত প্রচণ্ড গতিতে চলে গেল আমাদের ছেড়ে। নুসরাত চলে গেছে ভিন্ন এক ঝড়কে সঙ্গে নিয়েও। এই ঝড় সারাদেশের মানুষের ভালোবাসার ঝড়, এই ঝড় পাশবিকতার বিরুদ্ধে সুস্থ বিবেককে জাগ্রত করার ঝড়। প্রতিবাদী চেতনায় দীপ্ত এই ঝড় নুসরাত-ঝড়।

আজ সর্বত্র নুসরাতের নাম, সর্বত্র নুসরাতের জন্য ভালোবাসা, সর্বত্রই তার জন্য চাপা কান্নার গুঞ্জরন। এরূপ নুসরাত-ঝড়ের পরও যদি আমাদের বিবেকবোধ জেগে না ওঠে, নুসরাত-ঝড়ের পরও যদি পশুশক্তির বিরুদ্ধে আমরা আমাদের বিবেককে দাঁড় করাতে না পারি তবে ঈশ্বরসৃষ্ট প্রাকৃতিক অমঙ্গলের কোনো এক ঝড় আমাদের ধ্বংস করে দিক, অমঙ্গলের কালো কালবৈশাখীর ঝড়ে আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিলোপ ঘটুক। বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির জায়গায় এসে স্থান করে নিক উদ্ভট অদ্ভুত কোনো সভ্যতা ও সংস্কৃতি। আর নুসরাতের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে চলমান পৈশাচিকতার কাছে আমরা আমাদের আত্মা ও অস্তিত্ব বিক্রি করে দিই! একটি মর্যাদাহীন, মেরুদণ্ডহীন, পিশাচ জাতি হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করি! নুসরাত মরে গেছে। মরে গিয়েই বরং বেঁচে গিয়েছে নুসরাত। কারণ আমাদের সমাজে এরকম অনেক নুসরাত আমাদের চোখের আড়ালে নীরবে দগ্ধ হচ্ছে যাদের খবর আমরা কেউ জানি না। সেসব হাজারো দগ্ধ এবং অভিমানে অভিমানে জর্জরিত আহত কিশোরীদের অগ্রগামী হয়ে নুসরাত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে আমাদের হৃদয়কে দীর্ণ-বিদীর্ণ করেছে। গণমাধ্যমের আড়ালে থেকে যাওয়া অথচ সীমাহীন কষ্ট ও মর্মযাতনা ভোগ করা ভিন্ন ভিন্ন নামের নুসরাতদের কষ্টের চৌহদ্দির মধ্যে আমরা যেতে পারছি না- তাদের কোনো খবরও রাখছি না। স্থানীয় কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক এক ধরনের উদ্ভট ক্ষমতাধরদের কাছে নানাভাবে আমরা জিম্মি হয়ে পড়েছি। স্বাভাবিকভাবেই এই জিম্মিত্ব বরণকারীদের মধ্যে মেয়েরাই সংখ্যায় বেশি। তারা নানাভাবে কিছুসংখ্যক ব্যক্তির কিংবা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের আবেষ্টনীর রহস্যময় ঘুরপাকে বন্দি এ কথাও আমরা বলতে পারি। স্থানীয় শক্তিধর ও ক্ষমতাধরদের কাছে জিম্মিত্ব বরণ করে থাকি বলে শ্লীলতাহানির বিচার চাইতে গেলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিংবা বিচারিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের কাছেও পুনর্বার শ্লীলতা হারাতে হয়! কী এক অদ্ভুত সখ্য অপরাধী আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছুসংখ্যক অসাধু ব্যক্তির মধ্যে! আমাদের বিচার ব্যবস্থা কিংবা বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে একজন ধর্ষিতাকে পরবর্তী বিভিন্ন পর্যায়ে যে কতবার মৌখিকভাবে ধর্ষিতা হতে হয় তার কোনো ইয়ত্তা নেই! এর বিপরীতে ধর্ষক বা অপরাধীরা যথেষ্ট আরামেই সময় কাটাতে পারে।

নুসরাতের মৃত্যুতে আমাদের চোখ কিছু সময়ের জন্য খুলেছে। কিন্তু আমাদের এই চোখ কতক্ষণ খোলা থাকবে সেটাই বিরাট প্রশ্ন। অবশ্য, চোখ খোলা রাখা একটু কঠিনও বটে। কারণ একটি লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক ঘটনার পর আবার ভিন্নমাত্রার আরেকটি অনুরূপ ঘটনায় আমাদের মনোযোগ চলে যায় সেই ঘটনার পশ্চাতে। সুতরাং চোখেরও দোষ দিয়ে লাভ নেই। অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় নুসরাতকে ঢাকায় আনার পর দেশের সচেতন মানুষের মতো গণমাধ্যম যেমন তৎপর ছিল তাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখতে চাই। কিন্তু আমরা তো এও জানি যে, নুসরাতকে অগ্নিদগ্ধ করার আগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ তাকে নিজ কক্ষে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এরূপ ঘটনার সহযোগী ঘটনা হিসেবে সাধারণত যা যা ঘটে নুসরাতের ক্ষেত্রেও প্রায় তাই ঘটেছে। অর্থাৎ মামলা করার জের হিসেবে বাদীকে নানা রকমের হুমকি-ধামকির মুখোমুখি হতে হয়। তখন থেকেই যদি আমরা বিশেষ করে আমাদের স্থানীয় গণমাধ্যম কিংবা সংশ্লিষ্ট অন্যরা সতর্ক অবস্থানে থাকত তবে, নারকীয় এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নরপিশাচদের হাতেনাতে ধরা সহজতর হতো। প্রধানমন্ত্রী নুসরাত হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করবে বলে আমরা আশা করি। এই নৃশংস ঘটনার দ্রুত বিচারের মধ্য দিয়ে আইনের শাসন তার স্বীয় অস্তিত্বের প্রমাণ দেবে, পাশাপাশি দেশের অন্যত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দুর্বৃত্তরা সতর্ক ও সাবধান হবে বলেও আমরা মনে করি।

নুসরাত এক দৃপ্ত প্রতিবাদের নাম, নুসরাত এক অমিত সাহসের নাম। নুসরাতের মৃত্যু একটি ঝড়, এই ঝড় আমাদের বিবেককে লণ্ডভণ্ড করেছে। শুধু মৃত্যু নয়- নুসরাতের সাহসী প্রতিবাদ আমাদের জীর্ণ-শীর্ণ বিবেককে দীর্ণ-বিদীর্ণ করে দিয়েছে। তার সেই সাহসী প্রতিবাদের প্রেরণাকে সঙ্গী করে আমরা নিজেদের ঘরে ঘরে থাকা নুসরাতদের শানিত চেতনায় গড়ে তোলায় প্রত্যয়ী হবো। তাহলেই কেবল নুসরাতের জন্য আমাদের অবিরল অশ্রু বিসর্জন একটি অর্থবহ পরিণতি লাভ করবে। সমাজের বিকৃত ও অসুস্থ মনস্তত্ত্বকেও আমাদের ঘরের নুসরাতরা দীর্ণ-বিদীর্ণ করে তুলবে। নুসরাত এখন আর শুধু ফেনীর সোনাগাজীর নয়- নুসরাত হয়ে উঠেছে সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিবাদী মেয়েদের কণ্ঠস্বর।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App