×

জাতীয়

প্রতিকারহীন যৌন পীড়ন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০১৯, ০১:৪৭ পিএম

প্রতিকারহীন যৌন পীড়ন
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার স্কুল-মাদ্রাসায় শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীদের ওপর নীরবে চলে যৌন হয়রানি। ভয়ে, লজ্জায় ও সামাজিক সম্মানহানির কথা চিন্তা করে শিক্ষার্থীরা সবকিছু নীরবে চেপে যেতে বাধ্য হয়। অনেক সময়ই যৌন হয়রানির বিষয়টি তারা অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান বা সহপাঠীদের কাছে বলতেও বিব্রতবোধ করে। সাহস করে দুয়েকজন শিক্ষার্থী মুখ খুললেও প্রতিকার পায় না, বরং প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে অভিযোগ ধামাচাপা পড়ে যায়। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, স্কুল-মাদ্রাসায় অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীরা কতখানি নিরাপদ? অভিভাবক ও কর্তৃপক্ষ এসব ব্যাপারে কতটা সচেতন? মেয়ে শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসার কোনো কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধেও, যার সর্বশেষ শিকার সোনাগাজীর ইসলামিয়া মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী কবিতা খানম (ছদ্মনাম) ভোরের কাগজকে তার একটি তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানান। অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় এক সহকারী শিক্ষক কর্তৃক যৌন নিপীড়নের শিকার হন তিনি। তাকে মাদ্রাসার বেতন, ফ্রি প্রাইভেট পড়ানো, পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র দেয়া এবং পরীক্ষার খাতায় বেশি নম্বর দেয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। তবে বিষয়টি তিনি অভিভাবক, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ কা অন্য কাউকে জানাননি। কেন জানাননি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই শিক্ষকের কাছেই তাকে পড়াশোনা করতে হয়েছে। তাই তিনি পরবর্তী হয়রানির কথা চিন্তা করে কাউকে কিছু বলতে পারেননি। ছাড়াইতকান্দি হোসাইনিয়া দাখিল মাদ্রাসার ঝরে পড়া এক সাবেক ছাত্রী বলেন, মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক কর্তৃক যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে অভিভাবকদের অবহিত করায় আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রীটির লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে তার বাবার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মেয়েটি একদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে তার মায়ের কাছে কান্নাকাটি করে অধ্যক্ষ কর্তৃক নিপীড়নের বিষয়টি জানালে তার মায়ের পরামর্শে তার লেখাপড়া বন্ধ করে দিই। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কেন অভিযোগ দেননি জানতে চাইলে এই অভিভাবক বলেন, সামাজিক সম্মানহানির কথা বিবেচনা করে বিষয়টি এড়িয়ে যাই। সোনাগাজী এনায়েত উল্লাহ মহিলা কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, আমার মেয়ে স্থানীয় একটি ফাজিল মাদ্রাসায় লেখাপড়া করত। দশম শ্রেণিতে থাকাকালীন এক শিক্ষক কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়। দাখিল পাস করার পর ওই মাদ্রাসায় আলিমে পড়তে সে রাজি হয়নি। পরে বাধ্য হয়ে তাকে মহিলা কলেজে ভর্তি করি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একজন শিক্ষকের কাছে ছাত্রীরা সবচেয়ে নিরাপদ থাকার কথা। তাদের কাছে কেউ হয়রানির শিকার হবে, সেটা আশা করা যায় না। জানা যায়, উচ্চ আদালত ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী যৌন হয়রানি রোধে প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি মনিটরিং সেল গঠন করার নির্দেশনা রয়েছে। এ জাতীয় অভিযোগ পেলে এই সেল দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ ধরনের কোনো সেল সোনাগাজী উপজেলার কোনো বিদ্যালয়েই গঠন করা হয়নি। একই সঙ্গে যৌন নিপীড়নের ঘটনার প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থাও নেই এখানকার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। জানা যায়, সোনাগাজী উপজেলায় ৩টি ফাজিল, ৩টি আলিম ও ১৩টি দাখিল মাদ্রাসা রয়েছে। ৪টি কলেজ ও ২৩টি মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে। স্কুল-মাদ্রাসায় যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. সোহেল পারভেজ ভোরের কাগজকে জানান, যৌন হয়রানি রোধে প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি মনিটরিং সেল গঠন করার নির্দেশনা রয়েছে। এ জাতীয় অভিযোগ পেলে এই সেল দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। এ ছাড়া শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এলে স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তদন্ত করা হয়। সেখানে দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। পাশাপাশি পুলিশ বা স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থাও নেয়া হয়ে থাকে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সোনাগাজী উপজেলার কোনো বিদ্যালয়ে এ ধরনের সেল এখনো গঠন করা হয়নি। এ বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নুরুল আমিন জানিয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক-ছাত্র সমন্বয়ে মাদক প্রতিরোধ কমিটি থাকলেও যৌন নিপীড়নবিরোধী কোনো সেল নেই। তবে আমরা সেল গঠন করার চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে সোনাগাজী ছাড়াইতকান্দি হোসাইনিয়া দাখিল মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সভাপতি শামসুল আরেফিন বলেন, নির্দেশনা থাকলেও আমরা এখনো সেল গঠন করতে পারিনি। তবে এ ধরনের সেল থাকা প্রয়োজন। ওলামা বাজার হাজি সেকান্তর মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষা অনুরাগী সদস্য সৈয়দ দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, আমাদের স্কুলে পথেঘাটে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ কখনো কখনো পেলেও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো ছাত্রী অভিযোগ করেনি। এ ধরনের ঘটনায় নির্দেশনা আছে কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে স্কুলের বোর্ড এবং প্রশাসনকে জানাতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো হয়রানির ঘটনা ঘটলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা নিজেরাই সেটি চেপে রাখে। ছাত্রীদের যৌন হয়রানির বিষয়ে সোনাগাজী ছাবের পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জয়নুল আবেদীন বলেন, প্রতিষ্ঠানকে না জানিয়ে তারা অনেক সময় অভিভাবকদের জানায়। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকরা সামাজিকতার কথা চিন্তা করে এড়িয়ে যায়। তবে দুয়েকজন অভিযোগ করলেও পরবর্তীতে ধাপে ধাপে হয়রানি দেখে অন্যরা ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায় না। বাংলাদেশ মানবাধিকার সম্মিলনের চেয়ারম্যান এডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম নান্টু বলেন, অনেক ছাত্রী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েও অভিযোগ নিয়ে পরবর্তী হয়রানির ভয়ে সামনে এগিয়ে আসতে চায় না। তবে সব অভিভাবকের উচিত তাদের সন্তানদের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং কোনো ঘটনা নিজেদের মধ্যে চেপে না রেখে সাহস করে প্রতিবাদ করা। নারী ও শিশুবিষয়ক সংগঠন স্বপ্ন সাজাইয়ের চেয়ারম্যান নারী নেত্রী রোকেয়া প্রাচী বলেন, কোনো অভিযোগই হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এটা নিশ্চিত করা গেলে এ ধরনের ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে। অভিযোগ করার পর ধাপে ধাপে হয়রানির বিষয়ে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে আরো সচেতন হতে হবে। যাতে অভিযোগকারী কোনোভাবেই দ্বিতীয়বার হয়রানির শিকার না হয়। এ জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয়রানি প্রতিরোধে মনিটরিং সেল থাকা উচিত। কিন্তু বেশির ভাগ স্কুল-মাদ্রাসায় সেটা নেই। সেলগুলো গঠন করে সেটাও নজরদারি করা উচিত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App