×

মুক্তচিন্তা

ইতিহাস চর্চা: আগরতলা থেকে বৈদ্যনাথতলা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০১৯, ০৯:২০ পিএম

‘মুজিবনগর’ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী, আর এ সরকার স্বাধীন বাংলার প্রথম বৈধ, নিয়মতান্ত্রিক স্বাধীন সরকার। এ সরকার বিশ্বের অন্যতম সফলতম সরকার, যা তার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে একশ ভাগ সাফল্য অর্জন করেছে। বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে।

যাঁরা ইতিহাস চর্চা করেন তাঁরা মুখ্যত দুধরনের তথ্য-উৎস ব্যবহার করে থাকেন : মৌলিক ও দ্বৈতয়ীক। মজার বিষয় হলো, ঐতিহাসিককে উভয় তথ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে খুব সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়; অন্যথায় সত্য উদঘাটিত না হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। এ বক্তব্য অধিকতর প্রযোজ্য মৌলিক বা প্রাথমিক তথ্যের ক্ষেত্র, কেননা তথ্য প্রদানকারী শুধু নিজের দেখা বা অংশগ্রহণের বিষয়টিকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করেন; পরিপূরক ও সম্পূরক আরো বক্তব্য ও তথ্য যে থাকতে পারে তা তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না। এটা অনেকটা অন্ধের হাতি দেখার মতো। কিন্তু ঐতিহাসিক কোনো বিষয়কে বৃহত্তর সর্বাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রাপ্ত সব তথ্য বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে সত্য উদঘাটনে ব্রতী হতে হয়।

দুদিন আগে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘মুজিবনগর দিবসের তাৎপর্য’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় লক্ষ করলাম, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর গবেষণা করার ও জানার অনেক কিছু বাকি। আর এ উপলব্ধি থেকেই নিম্নের সংক্ষিপ্ত এ উপস্থাপনা। শুধু সাধারণের নয়, আমাদের অনেকের ধারণাটি এমন যে, হঠাৎ ‘মুজিবনগর’ ও ‘মুজিবনগর সরকার’ নামকরণ হয়েছে, আবির্ভাব ঘটেছে। এটা তো সত্য, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিচালনার সব কৌশল বিশেষ করে জনগণের সম্পৃক্ততায় অসহযোগ আন্দোলন ও গেরিলাযুদ্ধের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ আওতায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বরোচিত হামলা, হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মতো জঘন্য কর্মসূচি গ্রহণ করলে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্টভাবে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে (রাত ১২টার পর) স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সব বাঙালিকে হানাদারদের প্রতিহত করতে ও শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আহ্বান জানান। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাঙালিরা (সাধারণ জনগণ, বাঙালি সেনা, পুলিশ-ইপিআর) গেরিলা ও সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু এ যুদ্ধ ও প্রতিরোধ নিয়মতান্ত্রিক কোনো কর্তৃপক্ষ বা সরকারের নেতৃত্বে ছিল না। বঙ্গবন্ধু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিপরীতে সমগ্র বাঙালি জাতিসত্তাকে ঐক্যবদ্ধ করে সুসংগঠিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করেছিলেন। আর সেজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি ও সহযোগিতার বিষয়টিও ছিল তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রেক্ষাপটে ৭ মার্চের পরপরই বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনায় ও নির্দেশনায় কূটনৈতিক তৎপরতা বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। ২৫ মার্চ রাত আনুমানিক ১১টায়, অন্যদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম প্রমুখ বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ গ্রহণ করে ৩২ নম্বর থেকে বিদায় নেন। ড. কামাল হোসেন নিজ বাসভবনে গ্রেপ্তার হন।

তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম নিরাপদ স্থান থেকে ভারতের উদ্দেশে ২৭ মার্চ নিঃস্ব অবস্থায় ঢাকা ত্যাগ করেন। তাঁরা ২৯ মার্চ ঝিনাইদহ পৌঁছেন। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমেদ (বীরবিক্রম), ইপিআর কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেহেরপুর এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরী ও অন্যান্যের সহযোগিতায় তাঁরা ৩০ মার্চ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত পৌঁছেন। সীমান্তের ও পারে বিএসএফ আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার তাঁদের সংবর্ধনা দেন। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল বাঙালিদের সসম্মানে ভারতের মাটিতে গ্রহণের। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বিশেষ করে ৭ মার্চের পরই বঙ্গবন্ধু প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা প্রাপ্তির এ ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। যাহোক, বিএসএফ প্রধান কে এফ রুস্তমজি ও আঞ্চলিক প্রদান গোলক মজুমদারের সহায়তায় তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম ১ এপ্রিল দিল্লি পৌঁছেন। ৪-৫ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিস্তারিত আলোচনা শেষে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে ভারতে অবস্থানের অনুমতি প্রদান, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রদান, বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়, বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, যোগাযোগের জন্য একটি বিমান প্রদান, মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রেরণের জন্য বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ এপ্রিল ১৯৭১ আওয়ামী লীগ দলীয় এমএনএ (মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি) ও এমপিএরা (মেম্বার অব প্রোভিনশিয়াল অ্যাসেম্বলি) ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি/উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী এবং মনসুর আলী ও এইচ এম কামরুজ্জামনকে মন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। এই একই তারিখে (১০ এপ্রিল ১৯৭১) বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে ভিত্তি করে খসড়া স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রও প্রণীত হয়। স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম ও কলকাতা হাইকোর্টের স্বনামধন্য আহনজীবী সুব্রত রায় চৌধুরী। এ বিষয়ে সার্বিক নির্দেশনা দিতেন তাজউদ্দীন আহমদ। পরের দিন ১১ এপ্রিল কর্নেল এমএজি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। এই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ১৭ এপ্রিল পূর্বঘোষিত অন্যতম মুক্তাঞ্চল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে শপথগ্রহণ করে সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। বলা হয়, ১৭ এপ্রিল সরকারের শপথগ্রহণ শেষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বৈদ্যনাথতলাকে ‘মুজিবনগর’ হিসেবে ঘোষণা দেন; আর এখনকার সরকার ‘মুজিবনগর সরকার’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৭ এপ্রিল হলো মুজিবনগর দিবস।

উপরোক্ত বক্তব্যে ইতিহাসের বড় কোনো ব্যত্যয় বা বিকৃতি নেই, তবে এর সঙ্গে আরো যৌক্তিক ও সুষ্ঠু বিবেচনাপ্রসূত কিছু কর্মপন্থা, সিদ্ধান্ত ও তথ্য সম্পৃক্ত রয়েছে, যা বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনায় অধিকতর উপযোগী। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, এক. ‘মুজিবনগর’ অভিধার ব্যবহার কোনো একক ব্যক্তির তাৎক্ষণিক আবেগিক অভিব্যক্তি নয়; দুই. বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর করাও কারো উদ্দেশ্য ছিল না, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ হিসেবে এটি কারো কাম্যও ছিল না। ইতিহাসের পরিক্রমায় এসব সংঘটিত হয়েছে। বস্তুত, ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল আগরতলায় অনুষ্ঠিত সংসদীয় দলের প্রথম সভায় সবার ঐকমত্য সিদ্ধান্তের ফলে এরূপ ঘটেছে। আগরতলায় ১১ এপ্রিলের অন্যান্য সিদ্ধান্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বাংলাদেশ সরকারের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার করা, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার অনুমোদন, ১০ এপ্রিল প্রণীত খসড়া স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র অনুমোদন, মুক্তিফৌজের নাম মুক্তিবাহিনী করা প্রভৃতি। এ সভারই আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো ১০ এপ্রিল গঠিত সরকারের রাজধানীর নাম হবে ‘মুজিবনগর’। জাতীয় ঐক্য, সংহতি, মহান নেতার প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও আনুগত্য এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের সর্বোত্তম অনুপ্রেরণার প্রতীক হিসেবে যৌক্তিক উপায়ে সুবিবেচনাপ্রসূত এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইতিহাস বিকৃতি প্রতিরোধে এটি আজ এক বলিষ্ঠ ঐতিহাসিক উপাত্ত। উল্লেখ্য, ১৯৭৫-পরবর্তী সামরিক সরকার সংবিধানসহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক কিছু বিকৃতি করলেও ভুলক্রমে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে হাত দিতে পারেনি, ফলে তা অবিকৃত দলিল হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে। মূলত যে জায়গায়ই সরকার শপথগ্রহণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করত, উল্লিখিত সিদ্ধান্তক্রমে, সে জায়গাটিই ‘মুজিবনগর’ নামে খ্যাতি অর্জন করত। অন্যতম মুক্তাঞ্চল বিশেষ করে ভারতবেষ্টিত মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলাকে কৌশলগত কারণে নিরাপদ স্থান হিসেবে বিবেচনা করে এটিকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কেন্দ্র তথা রাজধানী হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সার্বিক নিরাপত্তায় স্বার্থে বিষয়টি অতি দ্রুত ও সর্বোচ্চ গোপনীয়তার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। বৈদ্যনাথতলা হয় বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম। আগরতলায় ১১ এপ্রিলে সংসদীয় দলের ঐকমত্যের সিদ্ধান্তসূত্রে বৈদ্যনাথতলা তাই ‘মুজিবনগর’ খেতাব পাওয়ার মর্যাদা লাভ করল, যা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা করলেন ১৭ এপ্রিল সরকারের শপথগ্রহণের দিনে। বাংলাদেশের ভূরাজনীতিতে সংযোজিত হলো ‘মুজিবনগর’ আর এর সরকার হলো ‘মুজিবনগর সরকার’। আকস্মিক নয়, আবেগে নয়, ১৭ এপ্রিলের হঠাৎ আবিষ্কার হিসেবেও নয়, ইতিহাসের পথপরিক্রমায় জন্ম হলো ‘মুজিবনগর’ আর ‘মুজিবনগর সরকার’র। এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।

‘মুজিবনগর’ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী, আর এ সরকার স্বাধীন বাংলার প্রথম বৈধ, নিয়মতান্ত্রিক স্বাধীন সরকার। এ সরকার বিশ্বের অন্যতম সফলতম সরকার, যা তার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে একশ ভাগ সাফল্য অর্জন করেছে। বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। আর অগণিত মানুষ, বীর মুক্তিযোদ্ধা যাকে আবর্তন করে, যার নামে শপথ নিয়ে, যার আদর্শ ও অনুপ্রেরণা ধারণ করে এ মহান কাজ সম্পাদন করেছেন, তিনি আর কেউই নন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের ইতিহাসে তাই ‘মুজিবনগর’ আর ‘মুজিবনগর সরকার’ থাকবে চির অম্লান।

ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ : শিক্ষাবিদ ও গবেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App