×

বিশেষ সংখ্যা

বাঙালির সংস্কৃতিতে নববর্ষ ও হালখাতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০১৯, ০৮:৫৮ এএম

বাঙালির সংস্কৃতিতে নববর্ষ ও হালখাতা
বাঙালির সংস্কৃতিতে নববর্ষ ও হালখাতা
মহাকাল অনন্ত। তবু তাকে নির্দিষ্ট সীমায় বাঁধতে চেয়েছে মানুষ। যুগ-বর্ষ-মাস-দিবস-ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ড কিংবা সেকেন্ডের চেয়েও কম অংশে সে কালকে বিভক্ত করে জীবনযাপনের অংশ করে নিয়েছে। কাজ করে চলেছে যেন বিশ্রামের অবকাশ নেই! এভাবে ‘বর্ষ’ নামক একটি অখণ্ড একক ধরে সে এগিয়ে চলেছে। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আহ্নিক গতিতে দিন আর বার্ষিক গতিতে বর্ষ বা বছর। এভাবেই বার্ষিক আবর্তনের হিসাবেই শুরু হয়েছে বর্ষ গণনা। এক বর্ষ যায় আরেক বর্ষ শুরু হয়। নতুন এ বছরকে বলা হয় ‘নববর্ষ’। নববর্ষের শুরুটা আনন্দময় করে তুলতে অনুষ্ঠিত হয় নানা উৎসব-অনুষ্ঠান। ‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক’ বলে পুরাতন বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছর বা নববর্ষকে বরণ করে নেয়া হয়। বঙ্গভূমিতে বর্ষ গণনার শুরু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাস থেকে করা হতো। সব শেষে বৈশাখ মাস থেকে বর্ষ গণনা শুরু করা হয়। এখনো তাই চলছে। পয়লা বৈশাখ থেকে বাংলা সনের গণনা শুরু করা হয়। বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ উৎসব পালন করা হয় এ দিনে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৈশাখের আবাহনী গানটি কালজয়ী মর্যাদা লাভ করেছে। তাই পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে বাঙালি গেয়ে ওঠে : ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’ নতুন প্রত্যাশায় ও কল্যাণভাবনা বুকে নিয়ে বলে ওঠে জীর্ণ-পুরাতন যাক ভেসে যাক। এক সময় নববর্ষ পালিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে কৃষির নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আবার ফসল ঘরে উঠলে কৃষক প্রজারা খাজনা দিত। বর্ষ শেষে প্রজারা খাজনা শোধ করে দিত আর পয়লা বৈশাখে ভ‚স্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ রীতি ব্যবসায়ীদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল। এখনো আছে। পুরাতন বর্ষ শেষ হয়ে গেলে নতুন বর্ষে ব্যবসায়ীরা হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। গ্রাহকরা পুরাতন বর্ষের ঋণ বা দেনা শোধ করে দেয়। এই যে নতুন খাতা খোলা এরই নাম ‘হালখাতা’। নববর্ষের একটি প্রধান উৎসব এই ‘হালখাতা’। ব্যাপারটা অর্থনৈতিক হলেও এর সামাজিক-সাংস্কৃতিক তাৎপর্যও কম নয়। ব্যবসায়ী ও গ্রাহকের মধ্যেকার সম্পর্ক যে কেবল বাণিজ্যিক বা আনুষ্ঠানিক নয়, এর একটা আন্তরিকতার দিকও রয়েছে, নববর্ষ উদযাপন বা পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান সে কথাটা মনে করিয়ে দেয়। নববর্ষের উৎসব গ্রাম ও নগরে সমভাবে বিস্তৃত। গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে নববর্ষের উৎসব অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নববর্ষ শুরুর আগেই গ্রামবাংলার মানুষরা আবাসস্থল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে, অন্যান্য সামগ্রী যা তারা ব্যবহার করে। তাও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। নিজেরা স্নান করে পবিত্র হয়। নববর্ষের শুরুর দিন বা পয়লা বৈশাখ তারা নতুন বা যথাসম্ভব ভালো পোশাক পরিধান করে। যথাসম্ভব ভালো খাবার খায়। তাদের ধারণা, নববর্ষের শুরুর দিন যদি ভালো পোশাক পরিধান করে ভালো খাবার খাওয়া হয়, তাহলে সারা বছর ভালো যাবে। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসে, নিজেরাও আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যায়। চলে উপহার বিনিময়। শিশুসহ প্রিয়জনদের উপহার দেয়া হয়। এ রীতি শহরাঞ্চলেও অনুসৃত হয়। নববর্ষের আরো একটি অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা। এ সর্বজনীন লোকজ মেলা অনাবিল আনন্দ নিয়ে আসে। এ মেলার একটি বাণিজ্যিক দিক যেমন আছে, তেমনি আছে সাংস্কৃতিক দিক। বাণিজ্যিক দিক হলো ব্যবহার্য নানা পণ্য গ্রাহকের দোরগোড়ায় নিয়ে আসা এবং তাকে সহজলভ্য করে তোলা। আর সাংস্কৃতিক দিক থেকে মেলা বা বৈশাখী মেলায় পরিবেশিত হয় যাত্রা, পালাগান, পুতুল নাচ, সার্কাস ইত্যাদি। শিশু-কিশোর-কিশোরীদের আকর্ষণের জন্য নাগরদোলা, বায়োস্কোপ। এতে ওরা খুব আনন্দ পায়। শহরাঞ্চলেও এখন বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামাঞ্চলের মেলায় নানা উপকরণ-উপাদান শহরাঞ্চলের মেলাতেও দেখা যায় বা পাওয়া যায়। আবার নগর-সংস্কৃতির প্রকাশক নানা বিষয় নিয়ে শহরাঞ্চলে নববর্ষ উদযাপিত হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সঙ্গীতানুষ্ঠান এবং নাট্যানুষ্ঠান। পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাঙালির নববর্ষের উৎসবকে উৎসাহ বা পৃষ্ঠপোষকতা তো দিতোই না বরং বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিরূপ দৃষ্টিতে দেখত। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীতকে তারা বৈরী দৃষ্টিতে দেখতেন তাকে নিষিদ্ধও ঘোষণা করেছিলেন। তার প্রতিবাদে পয়লা বৈশাখ নববর্ষের অনুষ্ঠান করা হতো এবং রবীন্দ্রনাথের এসো হে বৈশাখসহ অন্যান্য গান আনুষ্ঠানিকভাবে পরিবেশিত হতো। ছায়ানট নামক সাংস্কৃতিক সংগঠন রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখের প্রভাতে এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদযাপন শুরু করে প্রতিবাদী চেতনায়। এ চেতনা আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে দৃঢ়তর করে এবং স্বাধিকার চেতনায় উদ্দীপ্ত করে যা পরবর্তীকালে স্বাধীনতার স্বপ্নকে সার্থক করে তোলে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনায় ছিল পয়লা বৈশাখের এই দীপ্ত ও দৃপ্ত আদর্শ। স্বাধীন বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান এ দিনটিতে নববর্ষকে মর্যাদার সঙ্গে পালন করার উদ্যোগ গ্রহণ করে উদযাপন করে। নববর্ষের উৎসব বা পয়লা বৈশাখের উৎসব আমাদের জাতীয় উৎসব। এ উৎসবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণের অধিকার ও সুযোগ রয়েছে। পাহাড়িরাও দিনটিকে পালন করে বৈসাবি উৎসব নামে। সাঁওতাল, গারো, হাজং প্রভৃতি জনগোষ্ঠীও নিজ নিজ সংস্কৃতির আলোকে নববর্ষ উদযাপন করে। এই বৈচিত্র্যের মধ্যেই তো দেশের প্রাণশক্তির ও প্রাণ প্রবাহের প্রকাশ। স্বাগতম নববর্ষ। নববর্ষ সবার জন্য আনন্দ বয়ে আনুক কল্যাণময়, শান্তিময় হয়ে উঠুক সবার জন্য। সবার জন্য রইল শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App