×

বিশেষ সংখ্যা

বর্ষবরণকে নির্দেশের সীমায় বাঁধবেন না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০১৯, ০৮:৫৬ এএম

বর্ষবরণকে নির্দেশের সীমায় বাঁধবেন না
বর্ষবরণকে নির্দেশের সীমায় বাঁধবেন না
‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’ কবিগুরু যে প্রবল প্রাণে বৈশাখকে আহ্বান করেছিলেন, সে তো আমাদের বাংলার মানুষের যাপিত জীবনের এক অপরিহার্য অংশ হয়ে আছে। বহু বছর আগে মোগল সম্রাট আকবর ফসলি বছর হিসেবে প্রবর্তন করলেও, প্রকৃতি এর রূপকে ভয়ঙ্কর করতে ছাড়েনি। তাই তো প্রতিবছর বৈশাখের রুদ্ররোষ প্রবল কালবৈশাখীর দুরন্ত ঝাপটায় গৃহস্থের যেমন আবাস লণ্ডভণ্ড করে দেয়, তেমনি ক্ষেতের ফসল লোপাট করে। তবু এই বৈশাখ কখনো কখনো বিপন্নতায় মানুষকে সাহস এবং শক্তি জোগান দেয়। মলিন অতীতকে নির্বাসন দিয়ে সুন্দর নতুনের প্রত্যাশায় মানুষ উৎসবমুখর হয় এই বৈশাখে। আমাদের সবার মনে থাকার কথা ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বৈশাখ এসেছিল। মুক্তিযোদ্ধা শব্দসৈনিক কবি মুস্তফা আনোয়ার শত্রু কে পরাস্ত করার জন্য তার কবিতার পঙ্ক্তিতে রুদ্র বৈশাখের শক্তি প্রার্থনা করেছিলেন। ‘বৈশাখের রুদ্র জামা আমায় পরিয়ে দে মা’ হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কবলিত পূর্ব বাংলার বুক থেকে হায়না-পিশাচদের পরাজিত করার লক্ষ্য নিয়ে লিখেছিলেন যে কবিতা, তার এই পঙ্ক্তি প্রমাণ করে কবি যেন বাংলার মানুষের আকাক্সক্ষারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। আমরা তো আদতেই বিপুল প্রাণের প্রবল শক্তি নিয়ে সেদিন মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানিদের পরাভ‚ত করে নিজ মাতৃভ‚মিকে দখলদার চক্রের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করেছিলাম। বৈশাখ তো আমাদের নতুন বছরের সূচনা করে। তাই উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে সারা বাংলা। ঘরে ঘরে পিঠে-পুলি, পায়েস রান্নার ঘ্রাণে কি যে মৌতাত সৃষ্টি করে, সে কথা আজ আর বোধহয় বলা যাবে না। তবুও ফেলে আসা দিনগুলোর গ্লানি মুছে ফেলার আনন্দে আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই যেন মেতে ওঠেন। বাবা তার দুই হাতে ছেলে আর মেয়েকে নতুন পোশাকে সাজিয়ে মেলায় যেতেন ওদের আশা পূরণের উদ্দেশ্য নিয়ে। অতীতে নদীর ঘাটে বড় বটগাছকে লক্ষ্য করে সামনের বিস্তৃত অকর্ষিত জমিতে বসা বিরাট মেলায় ঘুরে বেড়াতেন বাবা আর বাচ্চাদের জন্য কিনতেন নানা ধরনের খেলনা, পাতার বাঁশি কিংবা ছোট্ট একটা ঢোল। শুধু কি তাই। আহ্লাদের শেষ থাকতো না যখন ছেলেমেয়েরা চিনি দিয়ে তৈরি নানা ধরনের সাজ দেখে বাবার কাছে কিনে দেয়ার জন্য বারবার তাগিদ দিতে থাকতো। কী সুন্দর সব পশু-পাখি নানা ধরনের আকৃতির ওইসব মিষ্টির মধ্যে ইলিশ মাছ, হাতি, মিনার, পাখি ইত্যাকার সব মিষ্টি জন্তু-জানোয়ারগুলো ছেলেমেয়েদের হাতে ধরা দিত। আহ্লাদে আটখানা হয়ে নাচতে নাচতে কখনো ছেলেটা বাবার কাঁধে চড়ে বসত, হাঁটতে না পারার উছিলায়... গ্রামের এই মেলা আকর্ষণ করত গৃহস্থকে তার ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্যও। মেলায় উঠত খাট, চৌকি, আলনা, চেয়ার, টেবিল। কুমার বসতেন হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে। আবার কামার সাজিয়ে বসতেন তার পসরা, যেখানে থাকত দা, বঁটি, ছুরিসহ নানা ধরনের উপকরণ। মেলার এককোণে থাকতো নাগরদোলা, শিশু-কিশোরদের আনন্দের সাথে বুড়োরাও এক হয়ে যেতেন। আর পাশের নদীতে আয়োজন হতো বর্ণাঢ্য নৌকাবাইচ। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য আজকের বাংলার গ্রামগঞ্জে এ ধরনের উৎসব বসতে খুব একটা দেখা যায় না। নববর্ষের আনন্দ উৎসব গ্রামকে ছেড়ে যেন শহরকে আকৃষ্ট করেছে। তাই বর্ষবরণের কত না অভ‚তপূর্ব আয়োজনই আমরা শহরে দেখতে পাই। এ বর্ষবরণ উৎসবে মঙ্গল শোভাযাত্রা ঢাকার আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে প্রতি বছর বেরুচ্ছে চলমান পরিস্থিতি ও শাসন ব্যবস্থার অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতীকী শিল্পকর্ম নিয়ে। কখনো বিশাল ময়ূর, কখনোবা আজদাহা প্রতিনিধিত্ব করছে সময়ের। এ ছাড়া কত যে পাখি নানা ধরনের শিল্পকর্মের সৃষ্ট বঙ্গ সংস্কৃতির রূপ উঠে আসছে চঞ্চল তরুণ-তরুণীদের হাতে। মুখোশ এ আনন্দ উৎসবের একটি বিশেষ আয়োজন। রমনার বটমূলে ছায়ানটের প্রভাতী অনুষ্ঠানের শেষে আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে বেরোয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। সারা বাংলার মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে এই নববর্ষের দিনটির। কারণ এ দিনেই যে তিনি সাজবেন নতুন পোশাকে আর দূর-দূরান্ত থেকে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যাবেন রমনার বটমূলে আর শাহবাগ চত্বরে। আহা কি আনন্দ, কি প্রাণোচ্ছল উৎসব বাংলার মানুষের। কিন্তু সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি যখন হামলা করে সংস্কৃতির ওপর তখন রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানেও বোমা হামলায় ১০ জনকে প্রাণ দিতে হয়। এই ইতিহাস লেখা আছে আমাদের সংগ্রামে মুক্ত স্বদেশের এক পর্যায়ে। এত বড় আঘাত এবং মারণযজ্ঞ সত্তে¡ও বাঙালি কি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উৎসব আয়োজন বন্ধ করে দিয়েছিল, না দেয়নি। বরঞ্চ সগর্বে নবশক্তির উত্থান ঘটিয়ে তারা জঙ্গিবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তুলেছিল সংস্কৃতির সংগ্রামে। হায় মুক্তিযুদ্ধ, হায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের এই তিনটি স্লোগান দিয়ে আমরা অর্জন করেছিলাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। অবিশ্বাস্য হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বলে দাবিদার চলমান সরকার বাংলার ঐতিহ্যবাহী উত্তরাধিকার পূর্ব পুরুষের সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে, নববর্ষের আনন্দ উৎসবের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন বিকেল ৬টা পর্যন্ত। মুখোশ পরা যাবে না, হাতেই নাকি রাখতে হবে, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ। তবে কি নির্ভয়ে জিজ্ঞেস করতে পারি মুখোশ মানেটা কি এবং কোথায়ইবা তার ব্যবহার? এ ধরনের নির্দেশ জারি করে প্রকারান্তরে প্রশাসন কি সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকেই প্রশ্রয় দিচ্ছেন না?... জানি সরকার উদ্বিগ্ন মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে, এ উদ্বেগের জন্য সাধুবাদ জানাই। কিন্তু আনন্দ উৎসবকে দিনের আলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হাজার বছরের প্রচলিত বাঙালি জীবনের ব্যত্যয় কি ঘটাচ্ছেন না? অথচ আমরা বাঙালি বলে নিজেদের দাবি করছি আর সাম্প্রদায়িকতার কাছে আত্মসমর্পণ করছি। এ দেশের মানুষ যখন বা যেদিন আনন্দ করেন, তার জন্য কোনো সীমারেখা নির্ধারিত নেই। নিরাপত্তা দেয়া এটা প্রশাসন বা সরকারের দায়িত্ব। তাই বলে বঙ্গ সংস্কৃতির এই মহান দিনটিকে কেন কালিমা লিপ্ত করার জন্য এমন নির্দেশ জারি? একে প্রত্যাহার করুন এবং বাঙালিকে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠতে দিন। মনে রাখবেন, সরকার যেমন নিরাপত্তা সচেতন, তেমনি কিন্তু সাধারণ মানুষও। সুতরাং ভূতের ভয় দেখিয়ে বাচ্চাগুলোকে এখন থেকেই নির্জীব এবং নির্বীজ করে ফেলবেন না। তাদের জানতে দিন বাংলার পূর্বপুরুষের ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি। তবেই না যে সোনার বাংলাকে আমরা ভালোবাসি বলে দাবি করি, তারাও ভালোবাসতে শিখবে। বাঙালির জীবনে বর্ষবরণ, নবান্ন, বর্ষামঙ্গল, বসন্ত উৎসব, শারদ উৎসব এমনই বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে দুঃখ-যাতনা, দমন-পীড়ন এসবের মধ্যেও প্রাণোচ্ছল বাংলার মানুষ তাদের জীবননির্ভর আয়োজনগুলোকে অব্যাহত রেখেছেন। জঙ্গি পিশাচ শক্তির ভয়ে আমাদের জীবনের প্রচলিত আনন্দকে নির্দেশের বাঁধনে বেঁধে ফেলা এক নিন্দনীয় আঘাত। আমরা সবাই মুক্তিযুদ্ধ করে দেশটাকে স্বাধীন করেছি। দেশের মানুষের বাইরে সরকার নয়। এ কথা মনে রেখেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে তথা বাংলার সব মানুষের ইপ্সিত স্বদেশ ভূমি গড়ে তুলতে সহায়ক হওয়ার অঙ্গীকার গ্রহণ করতে হবে আজকের এই পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণে। শুভ হোক নববর্ষ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App