×

বিশেষ সংখ্যা

পয়লা বৈশাখের স্মৃতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০১৯, ০৯:১৪ এএম

পয়লা বৈশাখের স্মৃতি
প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তি আসে, পয়লা বৈশাখ আসে। সেই কবে শিশুকাল পার করে এসেছি আমরা। তবু মনে হয় বছরের এই একটি দিন আমাদের সঙ্গেই রয়েছে। ‘স্মৃতি বড় লোভাতুর, বিড়ালের মতো যেন ঘুরে-ফিরে থাকে চারপাশে’। পয়লা বৈশাখের স্মৃতিও তেমন। দূর গাঁয়ে এখনো ফিরে যাই ফি বছর। বড়ই মধুর সেই ফেলে আসা শৈশবের দিন। মনে হয়, এই এত বছর পেরিয়ে এসেও এখনো প্রত্যহ ভোরে ঘুম থেকে উঠে একবার ছুটে যাই গ্রামে! আমাদের বাজালিয়া গ্রাম। কী মধুর নাম আমার মায়ের নাম যেন! আমার রক্তের স্রোতে উন্মাতাল বয়ে যাওয়া কেমন উজানে-ঢেউতোলা নামের সৌরভ, শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিময় দিনের সৌরভ। সেইখানে কানামাছি, দাড়িয়াবান্দা, ডুডু, চি-কুৎকুৎ-ছুট, বৈশাখী মেলা আরো কত কী আনন্দ ছিল আমাদের সারাবেলা। বলি পয়লা বৈশাখ ছিল আমাদের অপেক্ষার অন্য এক নাম। নতুন কাপড়-জামা, মৌ-মৌ গন্ধে বিভোর সেই স্মৃতি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে পাল্লা-ছুট পাড়ার সবার। চৈত্রসংক্রান্তির নবসাজ পুরনো বছর বিদায়, নতুনের আবাহন! আমাদের কাজ ছিল পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় দল বেঁধে ছোটা। কোথায় ভাঁটফুল, আর কোথায় কাঠগোলাপের বন, কোথায় বেতসলতার ঝোপ খুঁজে বের করা! বছরের শেষদিনে আমরাও ঘটা করে পুরনোকে বিদায় জানিয়েছি। আর ঘরদোর পরিষ্কার করে নতুন বছরকে আহ্বান করেছি। আমরা পড়ার ঘর, চেয়ার-টেবিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখতাম। মাকে দেখেছি গোবরের ছিটা দিয়ে সারা উঠোন পবিত্র করত। আমি এখনো জানি না গোবরে জীবাণু-প্রতিষেধক কোনো উপাদান আছে কিনা! বাড়ির প্রতিটি কক্ষের দরজায় ঝোলানো হতো গোছা গোছা নিমপাতা, কাঠগোলাপের মালা। এটুকু জেনেছি যে, নিমপাতা বায়ুকে পরিশুদ্ধ করে। শুধু বাসগৃহ নয়, গোয়ালঘর থেকে শুরু করে প্রতিটি ঘর! বাড়ির গেটও থাকত ভাঁটফুলে সাজানো। ঘরের মেঝে নকশা কাটত কুলবধূরা। নিজেরা যেমন পরিশুদ্ধ হতাম, পাশাপাশি গৃহপালিত পশু গরু-ছাগলগুলোকে পুকুরে বা নদীতে নিয়ে গোসল করানো হতো, আর গলায় ও কপালে ঝোলানো হতো ফুলের মালা সেই কাঠগোলাপের মালা! এটাকে বলা হতো ‘বিসু’ পরব। আমাদের পাশের জেলা পার্বত্য চট্টগ্রাম। তারা পালন করে ‘বৈসাবি’ উৎসব বলে। তাদের সেই উৎসবও চলত সপ্তাহব্যাপী। দুটোর মধ্যে সামঞ্জস্য আছে উৎসব আর আনন্দের মধ্যে নববর্ষকে আহ্বান করা! পরের দিন বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখ। ব্যবসায়ীদের জন্যও এক বড় উৎসবের দিন। ছোট-বড় দোকানদার, ব্যবসায়ীরা বকেয়া আদায়ের জন্য দোকানে দোকানে আয়োজন করত পুণ্যাহ উৎসবের। খোলা হতো হালখাতা অর্থাৎ নতুন খাতা। পুরনো বছরের বকেয়া শোধ করে দিত খরিদ্দারেরা। দোকানে দোকানে থাকতো মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা। অনেক সময় বড়দের সঙ্গে ছোটরাও যেত মিষ্টির লোভে! বাবার হাত ধরে আমিও দু-একবার গিয়েছি দোকানের ‘পুণ্যাহ’ উৎসবে! এখনো গ্রামে, এমনকি শহরেও সেই প্রথা চালু আছে। এত সব আয়োজনে এক বড় বিনোদনের ক্ষেত্র চৈত্রসংক্রান্তির মেলা, আর তার পরের দিন পয়লা বৈশাখ। আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সাঙ্গু, আমরা বলতাম শঙ্খনদী। বৈশাখে নদী প্রায় শুকিয়ে যেত। এই সময়ে হতো ভক্তদের বারুণী স্নান। আর শুকনো চরে বসত বারুণী মেলা। মেলায় নাগরদোলা, জাদু, পুতুলনাচ, বায়োস্কোপ, মোরগের লড়াই ইত্যাদির আয়োজন হতো। বিকেল থেকে মধ্যরাত অবধি চলত সেই মেলা। আমরা কেউ ভেঁপু, কেউ বেলুন আর কেউ ঘুড়ির খেলায় মত্ত হতাম। আমি ঘুড়ির খেলায় পারদর্শী ছিলাম। দীর্ঘ নদী-চরে ঘুড়ি ওড়ানোর এই খেলা চলত আরো ৪-৫ দিন। আমার ঘুড়ি এত উপরে উঠত যে প্রায় দেখাই যেত না। বৈশাখে দাবদাহেও যেন আমাদের ক্লান্তি ছিল না। তখন গ্রীষ্মের ফল পাকত। আমাদের ছিল গ্রামের বড় কৃষি খামার। তরমুজ, বাঙ্গি ক্ষেতে গিয়ে ইচ্ছে মতো খেতাম, বন্ধুরা মিলে। পাড়াগাঁর আর এক মহোৎসবের নাম ‘ক্ষেত্রপাল’। মহোৎসব না বলে বলা ভালো ভূমি পূজার উৎসব। পয়লা বৈশাখের দিন সাঙ্গুর তীরে জেলে পাড়ায় বসত এই উৎসব, অর্থাৎ এই মেলা। মানুষের ঢল নামত। আমরা ছোটরাও যেতাম ক্ষেত্রপালের মেলায়। বড়রা দেবতার উদ্দেশে মন্ত্রপাঠ করত, কোথাও কোথাও হতো পশু বলিদান। লালসালু মোড়ানো স্তম্ভ, লাল সিঁদুরে রাঙা মাটির বাসন ঘটিবাটি। এত লালের আয়োজন কিছুটা তো ভীতিকর বটে! ক্ষেত্রপালের মেলা জমে উঠত সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি। মেলায় কাঁসর-ঘণ্টা বাজত সারাক্ষণ। ঠাকুরের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে সেবক-সেবিকা যারা মাথা কুটে মরছে তাদের বিশ্বাস, তারাই দেবতার কৃপা লাভ করবে। মধ্য দুপুরে সূর্য যেন নেমে আসে দেবালয়ে। দেবতার প্রতিনিধি হয়ে কেউ কেউ দুঃখী-সরল মানুষদের পক্ষে দেবতার কাছে প্রার্থনা করত। স্থানীয় ভাষায় এদের বলত ‘গাছা’। তাদেরও বিশ্বাসে ছিল যে, ক্ষেত্রবিশেষে এখনো আছে, দেবতার কৃপালাভে দুর্গতি থেকে তাদের মুক্তি লাভ হতো! এরই মধ্যে আমাদের ছোটদের ফুর্তির মেলা বয়ে যেত। এখানেও আরেক মেলা। পূজারির কাঁসর-ঘণ্টার সাথে আমাদের ছোটদের ভেঁপুও বেজে উঠত প্রত্যেকের হাতে। আর কেউ ধুলি ওড়ানো মাঠে ওড়াত রঙিন ঘুড়ি লাল-নীল-হলুদ-সবুজ। ক্ষেত্রপাল ছাড়াও অবস্থাপন্ন পরিবারগুলো ঘরে ঘরে আয়োজন করত ভ‚মিপূজার! আমাদের বাড়ির পূজার বেদি বসাতো জল শুকিয়ে-পড়া পুকুরের ঘাটে। বৃষ্টির বন্দনাও করা হতো। আমার মায়ের বিশ্বাস ছিল এতে সন্তানের ও পরিবারের মঙ্গল সাধিত হতো! এসবের মাঝেই চলত নতুনের আগমনী সুর পয়লা বৈশাখের আহ্বান। এভাবে পুরনোকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে বরণ করে নিতে উৎসুক হয়ে উঠত সারাগ্রাম। সবাই নতুন কাপড়ে পাড়ায় পাড়ায় দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতাম। সারা গ্রাম যেন মহোৎসবে মেতে উঠেছে! বড়দেরও আনন্দের দিন। প্রত্যেক বাড়িতে নাড়–, খই, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, গজা, জিলিপির উৎসব। বাড়িতে বাড়িতে সপ্তপদী শাক-ডাঁটা নিরামিষ ভোজ। শুনেছি এসব নাকি ভেষজ ওষুধ বছরান্তে একবার খেতে হয়। এতে নাকি অজানা রোগ-শোক-তাপ নিরাময় হয়! কেউ বলে তিতা খাওয়া। এই সপ্তপদের মধ্যে ছিল গিমাশাক, সর্ষেশাক, হলুদপাতা, পাটশাক, কলমিশাক, থানকুনিপাতা, নিমপাতা এসব মিলে সপ্তপদ মেশানো সবজি। তার সাথে কাঁচা কাঁঠাল, করলা, আলুরও মিশ্রণ থাকত। বেশ উপাদেয় হতো বছরে একবার এই শাক-ডাঁটা খাওয়ার উৎসব! প্রত্যেক ঘরে থাকতো এসবের আয়োজন। ঢাকা শহরের বৈশাখী পান্তা-ইলিশের কোনো ব্যাপার গ্রামে কখনো দেখিনি! পয়লা বৈশাখে সারাগ্রাম যেন এক উৎসবের গ্রাম। আমাদের বাঙালির গ্রাম।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App