×

জাতীয়

সুপারিশেই সীমাবদ্ধ সড়কের শৃঙ্খলা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০১৯, ০১:৩২ পিএম

সুপারিশেই সীমাবদ্ধ সড়কের শৃঙ্খলা
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাবে কে? এই একটি প্রশ্ন এখন রাজধানী তথা দেশের প্রতিটি মানুষের প্রশ্ন। পুরো সড়ক ব্যবস্থাপনা রাজনীতিক মোড়কে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো মাঝে মাঝে সরব হয়ে উঠলেও রহস্যজনক কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই আবার সিন্ডিকেটের জোয়ারের সঙ্গে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। ফলে রাজধানীসহ দেশের সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে একের পর এক কমিটি গঠন ও সুপারিশ জমা হচ্ছে। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। অনেকেই বলছেন সুপারিশেই সীমাবদ্ধ রয়েছে সড়কের শৃঙ্খলা। সাধারণ নাগরিকরা মনে করেন সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর ব্যাপারে সরকার ও পরিবহন মালিক-শ্রমিক সিন্ডিকেটের দেয়া সুপারিশগুলো ‘ফাঁকা বুলি’ ছাড়া আর কিছুই নয়। সুপারিশ সমন্বয় করতেই বছরের পর বছর পার করেন তারা। বিগত সময়ে দেখা গেছে, সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে যখনই জোরাল আন্দোলন শুরু হয় বা গণমাধ্যম সরব হয়, তখনই সবার টনক নড়ে। সড়ক নিরাপত্তার দায় যাদের ঘাড়ে তারা সবাই নড়েচড়ে বসেন। সড়ক নিরাপত্তা জোরদার করতে এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরিবহন মালিক-শ্রমিকরাও সতর্ক হয়। তারাও লোক দেখানো উদ্যোগ নেয়। আইনকানুন মেনে চলতে শুরু করে। এসময় সড়কে শৃঙ্খলাও ফিরে আসে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সবাই সব ভুলে যায়। সড়কে আবারো নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। এখন পর্যন্ত সড়ক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার বা দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সড়ক-মহাসড়কে চালকদের বেপরোয়া আচরণ, বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো, অদক্ষ্য ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের হাতে গাড়ি তুলে দেয়, ওভারট্রেকিং, যান্ত্রিক ত্রু টিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় চালানো, সড়কে চলাচল ও পারাপারের সময় পথচারীদের অসতর্কতা, ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, মোটরসাইকেলসহ তিন চাকার যানবাহন চলাচলের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা, স্থানীয়ভাবে তৈরি ধীর গতির যানবাহন প্রধান সড়কে চালানোর বিষয়গুলো প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। যখন যে কমিটি গঠন করা হোক না কেন, তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে এই কারণগুলো উঠে আসা একরকম নিয়মে পরিণত হয়েছে। সব প্রতিবেদনে এসব কারণের পাশাপাশি ডজন ডজন সুপারিশ থাকে। দেখা গেছে, এই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল ও সুপারিশের মধ্যেই ‘সড়ক নিরাপত্তা’ সীমাবদ্ধ থাকে। বছরের পর বছর কেটে গেলেও সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। সড়কে শৃঙ্খলাও ফিরে আসে না। কমিটি ভিন্ন হলেও সব তদন্ত প্রতিবেদনে একই ধরনের কারণ ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সম্প্রতি দেখা গেছে, সড়ক নিরাপত্তায় প্রধানমন্ত্রীর বা তার দপ্তরের দেয়া নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৮ সালের জুন মাসে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার রমিজউদ্দিন স্কুলের দুই শিক্ষার্থীর নির্মম মৃত্যুর পরে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবাই সজাগ হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১৭ দফা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু সেই নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। ওই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক দুর্ঘটনায় চালকদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ পাস হয়। বিআরটিএ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। পুলিশ সরব হয়। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আবারো সড়কে নৈরাজ্য শুরু হয়। এর আগে ২০১৭ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ দফা নির্দেশনা দেন। কিন্তু এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের হাতে তারা তা আজও বাস্তবায়ন করতে পারেননি। জানা যায়, সড়ক নিরাপত্তার সবচেয়ে শক্তিশালী ফোরাম ‘সড়ক নিরাপত্তা’ কাউন্সিল ২০১১ সালে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছিল। ২০১২ সালে এই কাউন্সিল ৫২টি স্বল্পমেয়াদি, ১৪টি মধ্যমেয়াদি ও ২০টি দীর্ঘমেয়াদিসহ মোট ৮৬টি সুপারিশ করে। চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি ২৬তম সভায় সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খানের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। গত মার্চ মাসে শাজাহান খানের কমিটি ১১১ দফা সুপারিশের খসড়া দাখিল করে। সুপারিশগুলো কোন সংস্থা কিভাবে বাস্তবায়ন করবে তাও উল্লেখ করে দেয়া হয়। তবে অতীতের মতো শাহজাহান খানের কমিটির সুপারিশগুলোও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই। এ বিষয়ে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, বিভিন্ন সময়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন হলে আর কোনো বিশৃঙ্খলা থাকবে না। কিন্তু যাদের ওপর এই দায়িত্ব তারাই কোনো পদক্ষেপ নেয় না। তাছাড়া এই সেক্টরে রাজনৈতিক নেতাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাদের কারণে পরিবহন শ্রমিকরা সড়কে বেপরোয়া। এদিকে, রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পুলিশ, বিআরটিএ, টাস্কফোর্স কমিটি, সিটি করপোরেশন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগের কথা জানিয়েছে। কিছু উদ্যোগ শুরু করলেও তা হঠাৎ করেই আবার ভেস্তে যেতে দেখা গেছে। গতবছর দেশজুড়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের গণআন্দোলনের মুখে সড়ক নিরাপত্তায় নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী, বাসের সামনে চালকদের পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফটোকপি ঝুলিয়ে রাখা, নির্দিষ্ট বাস স্ট্যান্ড ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসের গেট বন্ধ রাখা, সেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠানামা না করানোসহ বেশ কিছু দাবি বাস্তবায়নে বিআরটিএ, পুলিশ প্রশাসন, পরিবহন নেতারা আশ্বাস দেন। সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই চালকরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। গত ১০ এপ্রিল নগর ভবনে টাস্কফোর্স কমিটির সভা শেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন জানিয়েছেন, রাজধানীর সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০২০ সালে মুজিববর্ষে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ৬টি পরিবহন কোম্পানি গঠন করে গণপরিবহন চলাচলের ব্যবস্থা নেয়া হবে। ৬ রংয়ের বাস ২২টি রুটে চলাচল করবে। এই উদ্যোগ কতটা বাস্তবায়ন হবে তা এখন দেখার বিষয়। সুপারিশ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ওসমান আলী বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সরকারের দায়িত্ব। তারা বাস্তবায়নের এগিয়ে আসলে আমরা সহযোগিতা করব। তবে শ্রমিকদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, নিরাপদ সড়কের জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন আসছি। অনেক দাবি তুলে ধরেছি। সব যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়নে সরকারের উচিত পদক্ষেপ নেয়া। উল্লেখ্য, বেসরকারি সংগঠন ‘নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) জরিপের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সারা দেশে ১ হাজার ১৬৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ২১২ জন নিহত ও ২ হাজার ৪২৯ জন আহত হন। নিহতদের মধ্যে ১৫৭ জন নারী ও ২১৫ জন শিশু রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App