×

জাতীয়

জালিয়াতি করে অধ্যক্ষ হন সিরাজ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০১৯, ১১:৩৬ এএম

জালিয়াতি করে অধ্যক্ষ হন সিরাজ
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মূল হোতা সিরাজ উদদৌলা একা-ডেমিক ও অভিজ্ঞতা সনদ জালিয়াতি করেই সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। রাফি ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানিসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে। নারীলোভী এ অধ্যক্ষের চরিত্র পুরোটাই কালিমালিপ্ত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০০ সালের মাঝামাঝি ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় উপাধ্যক্ষ পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ওই পদে নিয়োগে সরকারি বিধি অনুযায়ী, কমপক্ষে ফাজিল/কামিল মাদ্রাসায় ৬ বছরের প্রভাষকের অভিজ্ঞতা অথবা কোনো আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে ৭ বছরের অভিজ্ঞতা বাধ্যতামূলক রাখা হয়। সে অনুযায়ী সিরাজ উদদৌলা ওই পদের জন্য আবেদন করেন। আবেদনে তিনি অভিজ্ঞতার জাল সনদ দাখিল করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি কোনো ফাজিল বা কামিল মাদ্রাসায় কখনো প্রভাষক ছিলেন না। এ ছাড়া তিনি কোনো আলিম মাদ্রাসারও অধ্যক্ষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন ফেনীর মমতাজ মিয়ারহাট দৌলতপুর সালামতিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার (প্রধান শিক্ষক)। জানা যায়, মিয়ারহাট দৌলতপুরের ওই মাদ্রাসায় তিনি মাত্র ৪ বছর সুপারের দায়িত্বে ছিলেন। ওই মাদ্রাসার এক শিশু ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে তাকে বহিষ্কারও করা হয়। আবেদনে জমাকৃত সনদে দেখা গেছে, সালামতিয়া দাখিল (এসএসসি) মাদ্রাসার পরিবর্তে তিনি আলিম (এইচএসসি) মাদ্রাসা উল্লেখ করে অধ্যক্ষ হিসেবে ৮ বছরের অভিজ্ঞতা দেখান। এ ছাড়া তার একাডেমিক সনদেও ঘাপলা রয়েছে। আলিম ও ফাজিল পাসের সনদে ঘষামাজা করে বিভাগ পরিবর্তন করেছেন তিনি। এ জাল সনদের ভিত্তিতেই তিনি উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পান। তার নিয়োগের দেড় বছর পর অধ্যক্ষ মারা যাওয়ায় পদ শূন্য হয়। এ সুযোগে তিনি বিভিন্ন তদবির ও কারসাজি করে অধ্যক্ষ বনে যান। অধ্যক্ষ হওয়ার পর থেকে ক্রমান্বয়ে তার অপকর্মের পরিধি বাড়তে থাকে। শুরু করেন সনদ বাণিজ্য। তার বিরুদ্ধে একাধিক সনদ বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের টাকার বিনিময়ে জাল সনদ সরবরাহ করতেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই মাদ্রাসায় গ্রুপিং, মাদ্রাসার অর্থ তছরুপের অভিযোগের পাশাপাশি মাল্টি-পারপাস কোম্পানি খুলে অর্থ আত্মসাৎ, অন্য একটি মাদ্রাসা গড়ে চেক জালিয়াতি এবং নাশকতার অভিযোগে মামলাও আছে তার নামে। এর মধ্যে পাঁচ মামলায় বেশ কয়েকবার জেলও খেটেছেন তিনি। ফেনী আদালতের আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম নান্টু বলেন, মাল্টি-পারপাস কোম্পানি খুলে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে তার নামে মামলাও হয়। এ মামলা ছাড়া আরো চার মামলায় গ্রেপ্তারও হন তিনি। এর মধ্যে ফেনী মডেল থানায় দায়ের হওয়া একটি নাশকতা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি তিনি। সোনাগাজী থানায় দায়ের হওয়া দুটি ও আদালতে হওয়া আরো এক মামলায় তিনি জেল খাটেন। সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, অভিভাবক কমিটির সদস্য ও স্থানীয় রাজনীতিবিদরা জানান, আশির দশকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির মাধ্যমে জামায়াতের রাজনীতিতে সক্রিয় হন সিরাজ উদদৌলা। তিনি জামায়াতের রোকন ছিলেন। ২০১৬ সালের দিকেও তাকে জামায়াতের মিছিল-সমাবেশে দেখা যেত। তবে পরবর্তী সময়ে তাকে আর জামায়াতের সভা-সমাবেশে দেখা যায়নি। একজন অভিভাবক জানান, চলতি বছরই সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অন্য এক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির দায়ে মাদ্রাসার সভাপতির কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়। কিন্তু সে অভিযোগ স্থানীয় প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে ধামাচাপা দেন সিরাজ উদদৌলা। নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন অভিভাবক অভিযোগ করেন, যখনই সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে অপকর্মের অভিযোগ উঠত, তার কাছ থেকে কিছু সুবিধা নিয়ে ওই সব অভিযোগ ধামাচাপা দিত মাদ্রাসা কমিটির সহসভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন। সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অভিভাবক কমিটির সাবেক সদস্য আবদুল মান্নান বলেন, মাদ্রাসায় নিয়োগ পাওয়ার পর সুবিধাবাদীদের নিয়ে অনিয়মের মহোৎসবে মেতে ওঠেন সিরাজ উদদৌলা। নানা সময়ে মাদ্রাসার বিভিন্ন তহবিলের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। একাধিকবার তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের যৌন হেনস্তার অভিযোগও ওঠে। কিন্তু প্রভাবশালীদের কাজে লাগিয়ে সে সব অভিযোগ তিনি ধামাচাপা দেন। এ ব্যাপারে মাদ্রাসা সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পিকে এনামুল করিম বলেন, মাদ্রাসার দায়িত্ব নেয়ার পর অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসছিল, এটি সত্য। কিন্তু এগুলো যাচাই-বাছাই করাটা আমার পক্ষে কঠিন ছিল। তারপরও আমি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অন্য কারো সহযোগিতা পাইনি। উল্লেখ্য, গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার একজন আলিম পরীক্ষার্থী ছাত্রীকে যৌন হয়রানির চেষ্টা করেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা। এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর মা বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে থানায় মামলা করলে তাৎক্ষণিক পুলিশ অধ্যক্ষকে আটক করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করেন। গত ৬ এপ্রিল সকাল ১০টায় প্রশ্নপত্র দেয়ার আগ মুহূর্তে ওই ছাত্রীকে ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দেয় বোরকা পরিহিত ৪ দুর্বৃত্ত। রাজি না হওয়ায় গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। তিনি ঢাকা মেডিকেলে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল রাত ৯টায় মারা যান। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সোনাগাজীর উত্তর চর ছান্দিয়ায় পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App