×

মুক্তচিন্তা

সংখ্যালঘু-আদিবাসী এমপিদের সংবর্ধনা এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০১৯, ০৯:৩১ পিএম

দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদও কৃতিত্বের দাবিদার। সভায় প্রত্যয় ঘোষণা করা হয় যে, নির্বাচনের ভেতর দিয়ে সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় যে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে উঠেছে, তাকে চোখের মণির মতো রক্ষা করে অগ্রসর হতে হবে। আওয়ামী লীগের বিজয়ী সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সাংসদদের নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনগণের পাশে যেমন দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে, তেমনি নিজস্ব সম্প্রদায়ের দাবিদাওয়া বাস্তবায়নেও যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে।

সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ২১ জন সংসদ সদস্যের সংবর্ধনা দিয়েছে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ৬ এপ্রিল বিকেলে সিরডাপ মিলনায়তনে। আমন্ত্রণ পেয়ে এই প্রথম ওই সংগঠনের কোনো সভায় কেবল যোগই দেইনি, কর্মকর্তারা বক্তব্য দেয়ারও সুযোগ করে দিয়েছেন। অনুষ্ঠানে যাওয়ার পর পরিচিত যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে তারা কেউ কেউ অনুযোগ করে বলেছেন, সম্প্রদায়ের একজন হিসেবে আমি ওই সংগঠনের সভা-সমাবেশে যাই না কেন? বাস্তবে না যাওয়ার কারণ রয়েছে আমার রাজনীতির হাতেখড়ির দিনগুলোর মধ্যে। ১৯৬৭ সাল। ৭ জুন ১৯৬৬-এর পর দমন-পীড়ন ও দল ভাঙাভাঙির পটভূমিতে রাজনীতিতে চরম ভাটার টান। কিছুদিন আগে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছি। গোপন কমিউনিস্ট পার্টিতেও ঢুকে গেছি। সম্প্রদায় হিসেবে নয়, ধর্ম-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সবাই এক হলেই সমাধান সম্ভব হবে ভাবছি। এমন সময়ে একদিন জগন্নাথ হলের ময়মনসিংহের এক পরিচিত ছাত্র বলল, ত্রৈলক্য মহারাজের ওপর থেকে এবডো (রাজনীতিতে নিষিদ্ধ) উঠে গেছে। এখন রাজনীতি করতে পারবেন। গ্রাম থেকে ঢাকা এসেছেন। কথা বলতে চান। তিনি কংগ্রেসি। আমি কমিউনিস্ট। কি আলোচনা করবেন? ভেবে পেলাম না। তবে অগ্নিদিনের নমস্য বিপ্লবী কথা বলতে চান, মনে প্রচণ্ড আলোড়ন। পার্টির অনুমতিক্রমে দুরু দুরু বক্ষে গেলাম ওর সঙ্গে পুরান ঢাকার এক বাসায়।

আদর করে পাশে বসালেন। রাজনীতির খবরাখবর নিতে গিয়ে ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ, হিন্দু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগ, ৬-দফার পর সাম্প্রদায়িক ও ভারতবিরোধী উগ্র প্রচারের পটভূমিতে হিন্দু সম্প্রদায় বিশেষত তরুণ ছাত্রদের মনোভাব কি তা বিশেষভাবে জানতে চাইলেন। কংগ্রেস দলের কাজ শুরু করলে কিংবা হিন্দুদের স্বার্থ নিয়ে দল করলে কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব পড়বে এবং এই উদ্যোগে ছাত্ররা সাড়া দিবে কিনা ইত্যাদি জানতে চাইলেন। তখন কতটুকুইবা বুঝি! কিন্তু কথায় এতটাই নৈকট্য সৃষ্টি হয়েছিল যে, যা বুঝি তা-ই বললাম। হিন্দু ছাত্ররা সাধারণভাবে ছাত্র ইউনিয়ন সমর্থক, ৬-দফার পর ছাত্রলীগ দাঁড়াচ্ছে, এখন অন্য দল বা সংগঠন হবে না ইত্যাদি সব তুলে ধরার পর বললাম, পাকিস্তানিরা হিন্দু-মুসলিম ভাগ করতে চাইছে। আলাদা কিছু করলে ওদেরই লাভ হবে। আর এখন তা হবেও না। সব শুনে তিনি নিশ্চুপ রইলেন। সবশেষে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। পরে তিনি স্বতন্ত্র কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ নেননি এবং শেখ মুজিবের প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লি গিয়েছিলেন বলেও জানা যায়। সেখানে তিনি কেন্দ্রীয়ভাবে সংবর্ধনা পেয়েছিলেন।

সেই সময় থেকেই মনের মধ্যে গেঁথে আছে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের লড়াই-সংগ্রামের ভেতর দিয়েই কেবল সাম্প্রদায়িক ও সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান হতে পারে। তাই হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে উৎসাহিত হইনি। প্রসঙ্গত আশির দশকের মাঝামাঝি এমন একটি সংগঠন করার কথা যখন ওঠে, তখন প্রথমদিকে বেশ বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলাম। ভালো করতে গিয়ে আরো খারাপ হবে না তো? সম্প্রদায়গতভাবে আলাদা দল করতে গিয়ে সাম্প্রদায়িকতা ও সংকীর্ণতা বাড়বে না তো? এসব প্রশ্নে যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলাম, তখন এরকম সম্প্রদায়গত সংগঠন হলে কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান কি হবে, দলের সদস্যরা তাতে কাজ করবে কিনা, এ নিয়ে পার্টির সর্বোচ্চ ফোরামে মত দেয়ার প্রশ্নটিও সামনে ছিল। তখন আইনি কারণে ঘন ঘন যেতে হতো ওই সংগঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যের কাছে। বিষয়টা বুঝতে চাইলে তিনি বললেন, সংখ্যালঘুরা দেশের জনগণেরই অংশ। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। আলাদাভাবে অবস্থান গ্রহণের কথা আগে কখনো ভাবেনি। ক্রমে বঞ্চনা বৈষম্য নিপীড়ন ইত্যাদি বাড়ছে। নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে, সমঅধিকার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংখ্যালঘুদের আলাদা সংগঠন যেমন প্রয়োজন, তেমন জাতীয় মূলধারার রাজনৈতিক সংগঠন-আন্দোলনেও আগের মতোই সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ বাড়ানো প্রয়োজন। যুক্তি ছিল অকাট্য। তাই ১৯৮৮ সালে যখন ঐক্য পরিষদ গঠিত হয়, তখন পার্টিতে ওই সংগঠন প্রশ্নে মত পক্ষে দিয়েছি এবং পার্টি সংগঠনের কাজে যখন জেলায় গিয়েছি, তখন পার্টির সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাকর্মীদের ওই সংগঠনে কাজ করার জন্য দায়িত্ব নিতে উৎসাহিত করেছি।

১৯৮৮ সাল থেকে ২০১৯ সাল। সুদীর্ঘ ৩০ বছরের ওপরে উল্লিখিত সংগঠনটি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সম্প্রদায় ও আদিবাসীদের পক্ষে কাজ করছে। সাংগঠনিক শক্তি, নেতাকর্মীর সংখ্যা ও জমায়েত ক্ষমতার দিক থেকে এটি এখন সমাজ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি প্রভাবশালী সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সংখ্যালঘুদের কণ্ঠস্বর হিসেবে সংগঠনটির মর্যাদা বাড়ছে। তবে এটাই বাস্তব যে, ধর্মান্ধ-সংকীর্ণ ব্যক্তি গোষ্ঠী দল তো বটেই; যারা অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন তাদের একাংশ কমবেশি এখনো মনে করেন, এই সংগঠন সাম্প্রদায়িকতাকে সাহায্য করছে। তাদের প্রশ্ন কেন তিন ধর্মের হবে, চার ধর্মের মানুষের সংগঠন হলে ক্ষতি কোথায়? তাতে সমঅধিকারের দাবি আরো জোরালোভাবে উত্থাপন করা যাবে। বিরোধীরা ‘হিন্দু’, ‘ভারত’ জুজুর ভয় দেখিয়ে সংখ্যাগুরুদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিতে পারবে না।

এখানে বলতেই হয় যে, উল্লিখিত সংবর্ধনা সভায় গিয়ে একজন মনোযোগী শ্রোতা হয়ে বক্তাদের কথা থেকে এসব প্রশ্ন ও কথার উত্তর পেতে সচেষ্ট হয়েছি। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, সংখ্যালঘু ও আদিবাসীরা ‘এ দেশের গর্বিত জনগণের অংশ।’ কিন্তু ‘নারী সম্প্রদায়ের মতো বিগত ১৯৪৭ সালের পর একটানা দীর্ঘ সাত দশকেরও ঊর্ধ্বকাল অব্যাহত বঞ্চনা ও বৈষমের শিকার হয়ে ফরংধফাধহঃধমবফ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।’ কীভাবে এমনটা হয়েছে, তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেছেন, তাই ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে’ সংখ্যালঘুদের ‘যথাযথ ক্ষমতায়ন ও অংশীদারিত্ব’ প্রয়োজন। এ ধরনের কথাই নানাভাবে সবাই বলে সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সংসদ সদস্যদের ভূমিকা পালনের ‘আর্তি’ সভায় তুলে ধরা হয়েছে। এমন কথাও বলা হয়েছে, পঁচাত্তরের পর বঞ্চনা ও নিপীড়ন বাড়তে থাকলেও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আলাদা সংগঠন করেনি। ১৯৮৮ সালের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণার পর পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক হওয়ায় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গঠন করা হয়েছে। যদি কখনো সর্বোতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ হয়, তবে এই সংগঠন থাকারই প্রয়োজনই পড়বে না।

প্রসঙ্গত বলতেই হয়, সংক্ষিপ্ত ওই স্বাগত বক্তব্যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরুর দিন থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতা, যারা সংসদের ভেতরে বাংলা ভাষার দাবিতে, বাঙালির জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধিকার ও গণতন্ত্রের দাবি তুলে ধরার জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাদের নামসহ অবদান তুলে ধরা হয়েছে। এসব ইতিহাসের সবটা অন্তত আমার জানা ছিল না। সত্যটা জানার জন্য এই ইতিহাস ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন রয়েছে। ওই সভার এসব বক্তব্য শুনতে শুনতে গণঅভ্যুত্থানের পর সামরিক শাসনামলে ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরের এক খণ্ডচিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। তখন নির্বাচন না দিয়ে সেনাশাসক ইয়াহিয়া খানের কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে উদ্বেলিত বাঙালি জাতিকে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের মাধ্যমে বিভক্ত না করে নির্বাচন দিতে ভরসা পাচ্ছিল না। তাই চারটি ষড়যন্ত্র-চক্রান্তমূলক উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রথমত, দমন-পীড়নের মধ্যে আগস্ট মাসে ইসলামী ছাত্র শিবিরকে লেলিয়ে দেয়া হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিরুদ্ধে। লক্ষ্য ছিল আন্দোলনের কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি দখলে নেয়া। আক্রমণের মুখে শিবির নেতা মালেক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পিটাপিটিতে নিহত হলে ওই চক্রান্ত ভেস্তে যায়।

দ্বিতীয়ত, অক্টোবর মাসে ভোটার তালিকা প্রণয়নের অজুহাতে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার জন্য বিহারি-বাঙালি দাঙ্গা বাধানো হয়। তা কার্যত বুমেরাং হয়। তৃতীয়ত, নভেম্বরে পূর্ববাংলাকে ভাগ করে চারটি প্রদেশ করার পাঁয়তারা চলে। প্রতিরোধের মুখে তাও সম্ভব হয় না। চতুর্থত, অর্থাৎ সর্বশেষ ইয়াহিয়া সরকার হিন্দুদের সংসদ সদস্য হওয়ার টোপ দেয়ার উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র নির্বাচনের ইস্যুটি সামনে এনে তথাকথিত হিন্দু নেতাদের টাকাপয়সা দিয়ে উসকে দেয়।

২১ ডিসেম্বর ১৯৬৯ বার লাইব্রেরি হলে সংখ্যালঘু সম্মেলন আহ্বান করা হয় পৃথক নির্বাচন প্রথার দাবি জাতীয়ভাবে উত্থাপনের জন্য। বিশেষত জগন্নাথ হল ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আহসানউল্লাহ হলের হিন্দু ছাত্রদের বিভ্রান্ত করে জমায়েত করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়। খবর পেয়ে এই সম্মেলনকে ভণ্ডুল করে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এখনো মনে পড়ে এই লক্ষ্যে রাজনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় কর্মীদের সেখানে সংগঠিত করে পাঠানো হয়। তারা পৃথক নির্বাচনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়। কিন্তু জমায়েত ভাড়াটে হওয়ায় খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। এক পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনখ্যাত ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ) পৃথক নির্বাচনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিলে পরিস্থিতি পাল্টে গিয়ে সম্মেলন ভণ্ডুল হয়ে যায়। ওইদিন যদি ওই প্রস্তাব পাস হতো তবে ঘোলা পানিতে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে পাকিস্তানের শাসক-শোষকগোষ্ঠী নিঃসন্দেহে চেষ্টা করত।

পাকিস্তানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পৃথক নির্বাচন প্রথার বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ের এতটা অবদান সত্ত্বেও কেন এখন যুক্ত নির্বাচনের মধ্যে থেকে সংখ্যার ভিত্তিতে ৬০টি সংসদীয় আসন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ দাবি করছে, তা বিশেষভাবে জাতীয় রাজনীতির মূলধারার সংখ্যাগুরু নেতারা ও রাজনৈতিক দলগুলোকে বিবেচনায় নেয়ার একান্ত প্রয়োজন রয়েছে। এটা আজ সংশ্লিষ্ট সবাইকে উপলব্ধিতে নেয়া আবশ্যক যে, কারণ থাকলে ক্ষোভ ধূমায়িত হবেই, যেমন ভেতরে আগুন থাকলে ধোঁয়া এড়ানো যায় না। তাই সমস্যার মূলে গিয়ে সমাধানের পথ অনুসন্ধান করা ভিন্ন বিকল্প নেই।

এখানে উল্লেখ করতেই হয় যে, এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে তিনটি বিশেষ ইতিবাচক দিক সামনে এসেছে, তা গভীরভাবে ওই সংবর্ধনা সভায় বিবেচনা করা হয়। প্রথমত, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে ১৯৩৭ সালে এ মানচিত্রে প্রথম নির্বাচনের সময় থেকে বিগত ২০১৪ সালের নির্বাচন পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতা ছিল সব নির্বাচনের অন্যতম প্রধান ইস্যু। এই প্রথমবারের মতো নির্বাচনে কোনো দল বা প্রার্থী বাঙালি জাতির জন্য সবচেয়ে অনিষ্টকর এই ইস্যুকে প্রকাশ্যভাবে প্রচার করেনি। নির্বাচনে জাতীয়ভাবে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ বজায় ছিল।

দ্বিতীয়ত, এবারেই হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সুসংঘবদ্ধভাবে সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের দাবি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে এবং সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় ছাড়া সব দাবি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ইশতেহারে যুক্ত করেছে। তৃতীয়ত, এবারেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সংখ্যালঘু প্রার্থী মনোনয়ন পেয়েছেন এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী ও স্বার্থবিরোধী অন্তত এক ডজন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২১ জন প্রার্থী নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। ওই সংবর্ধনা সভায় বসে নবনির্বাচিত সাংসদদের বক্তব্য শুনতে শুনতে মনে হলো, সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের অবস্থা বিবেচনায় সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো ইতিবাচক দিক হচ্ছে, এদের অধিকাংশই অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সের এবং মহিলারাও রয়েছেন। নতুন সংখ্যালঘু ও আদিবাসী নেতৃত্ব সামনে আসছে। তবে সভায় বলা হয়, ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সাংসদ ৪ জনে নেমে আসে। বর্তমানে শতকরা হিসাবে জনসংখ্যা কমলেও সাংসদ সংখ্যা বেড়ে ২১ জন হয়েছে। যদিও জনসংখ্যার অনুপাতে তা কম।

স্বাভাবিকভাবেই দেশের রাজনীতিতে উল্লিখিত তিন ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানান। এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের রাজনীতিতে এই ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদও কৃতিত্বের দাবিদার। সভায় প্রত্যয় ঘোষণা করা হয় যে, নির্বাচনের ভেতর দিয়ে সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় যে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে উঠেছে, তাকে চোখের মণির মতো রক্ষা করে অগ্রসর হতে হবে। আওয়ামী লীগের বিজয়ী সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সাংসদদের নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনগণের পাশে যেমন দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে, তেমনি নিজস্ব সম্প্রদায়ের দাবিদাওয়া বাস্তবায়নেও যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে।

শেখর দত্ত : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App