বাউফলের মৃৎ পণ্য এখন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০১৯, ০৩:৪২ পিএম
চোখে পড়ছে মাটির তৈরী বাহারি সব তৈজসপত্র এবং শোনা যাচ্ছে নানা রং-বেরংয়ের খেলনার টুং টাং শব্দ। প্রতিযোগিতা চলছে দ্রুত সরবরাহের। চলছে রাতদিন প্যাকেজিং ও গাড়ি ভর্তির কাজ। বাজার ধরতে গাড়িগুলো যাবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে। বাঙালির শ্রেষ্ট উৎসব পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে প্রায় মাসাব্যাপী সময় ধরে মৃৎ শিল্পীরা তাদের স্নেহমাখা হাতের কারুকার্যে কাদামাটি দিয়ে বাহারি এসব মাটির পণ্য তৈরী করেছে। এসব মাটির পণ্য ডিজাইন মোতাবেক তৈরী, রোদে শুকানো, রঙ করা কিংবা পোড়ানো সবই এখন শেষ। পটুয়াখালীর বাউফলের কাগুজিরপুল, মদনপুরা এবং কনকদিয়া ইউনিয়নের পালপাড়া এলাকায় এখন এমনই দৃশ্য চোখে পড়ছে।
বাউফলে আধুনিক মাটির পণ্য তৈরীর দিকপাল বিভিন্ন সংস্থা থেকে জাতীয় পর্যায়ে একাধিক পুরুষ্কার প্রাপ্ত বিশ্বেশ্বর পাল জানান, এখানকার মাটির পণ্য দেশ এবং বিদেশে নন্দিত। এসকল মাটিরপণ্য আড়ং , কোড় দি জুট ওয়ার্কস, ঢাকা হ্যান্ডিক্রাফটসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিদেশে রপ্তানি করছে। তিনি বলেন, প্লাটিক পণ্যের প্রভাবে বংশানুক্রমিকভাবে চলে আসা এই পেশা বিলুপ্ত হওয়ার সময় আশির দশকে ঢাকায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে বাউফলের মাটির পণ্যের মান দেখানো হয়। ওই সময় আড়ংয়ের কর্তৃপক্ষের সাথে কথা হয়। তারা বাউফলে তৈরী মাটির পণ্য দেখে মুগ্ধ হন। সেই থেকেই তাদের সহযোগিতায় এ শিল্পে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। এরপর ঢাকা হ্যান্ডিক্রাফট নামক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলে এরপর থেকেই ঢাকায় বাউফলে তৈরী নানা ধরণের মাটির পণ্য সরবারহ শুরু হয়।
তিনি বলেন, আমরা কঠোর পরিশ্রম ও মনোনশীলতা দিয়ে বাউফলের মাটির পণ্যকে বিশ্বমানের আধুনিক পণ্যে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছি এবং একই সাথে সব শিল্পীরাও এই গর্বের অংশীদার হতে পেরেছেন। বর্তমানে বাউফলের মাটির তৈরী নানা পণ্য দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আড়ং, কোড় দি জুট ওয়ার্কস এবং ঢাকা হ্যান্ডিক্রাফটসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাউফলের এসব পণ্য দখল করে নিয়েছে কানাডা, আমেরিকা, গ্রেড বৃটেন, নেদারল্যান্ড, অষ্ট্রেলিয়া এবং জাপানের মত শিল্পোন্নত দেশের বাজার। স্বীকৃতিও মিলেছে কাজের।
মৃৎ শিল্পের ওপর কাজ করা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সম্মাননাসহ আজীবন সম্মাননাও পেয়েছি। তিনি আরো জানান, সারা বছরই এসব পণ্যের চাহিদা থাকলেও পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এসময় বাউফল এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রামীণ মেলা উপলক্ষে পুতুল, ঘোড়া, হাতি, টিয়াসহ রং-বেরংয়ের নানা মাটির তৈরী খেলনারও ব্যাপক চাহিদা থাকে। তাই এসময় নিয়োমিত মৃৎ শিল্পী ছাড়াও অতিরিক্তি সহায়ক শিল্পী কাজে লাগানো হয়। এসময় সৃষ্টি হয় বিশাল কর্মযজ্ঞ এবং কর্মচাঞ্চল্য।
বাউফল পৌর সভার এক নম্বর ওয়র্ডের কাউন্সিলর ও বাউফলের একটি মৃৎ শিল্প কারখানার মালিক শংকর পাল জানান, প্রতিবছরই পণ্যের ডিজাইনে পরির্বতন আসে। আড়ং, এবং কোড় দি জুট ওয়ার্কসসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নতুন ডিজাইন করে তাদের চাহিদাপত্র দেন। সে অনুযায়ি নতুন নতুন ডিজাইনের পণ্য তৈরী হয়। তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর সবগুলো মাটির পণ্যেই নতুনত্ব এসেছে। অপর এক মৃৎ শিল্পী শ্যামল পাল জানান, এ বছর ডিনার সেটে থাকছে প্লেট, গ্লাস, মগ, কারিবল, জগ, লবনদানি, শানকি (বাসন), কাপপিরিচ ও তরকারির বাটি। এ ছাড়াও নতুন ডিজাইনে তৈরী করা হয়েছে সুপ সেট। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে নতুন ডিজাইনের কয়েলদানি, মোমদানি, ঘটি, ফুলদানি ও নানা ধরণের খেলনা ক্রেতাদের আলাদা ভাবে আকৃষ্ট করবে। ডিনার সেট ছাড়াও আলাদা বিক্রির জন্য তৈরী করা হয়েছে মাটির প্লেট, গ্লস, জগ, মগ, ইত্যাদি। রাসায়নিক কোন পদার্থের ছোঁয়া ছাড়াই তৈরী করা হয়েছে মাটির ওইসব পণ্য। তিনি বলেন, পণ্যের রঙ করা হয় গাছের কস দিয়ে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শিল্পীরা সবাই শেষ সময়ের ব্যস্ততায় দৌঁড়ঝাপ করছেন। পরিবারের সকল সদস্যসহ বাড়তি শ্রমিক নিয়োগ করা হয়েছে প্যাকেজিং করে বাজারজাত করণের কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য। মৃৎ শিল্প কারখানার মালিক শিল্পী বরুন পাল বলেন, একসময় বাউফলের পাল পাড়ায় জালের কাঠি, পুতুল, কলস, বাচ্চাদের খেলনা, রসের হাঁড়িসহ গ্রামবাংলার ঘরে ব্যবহার্য নানা ধরণের মাটির সামগ্রী তৈরী হতো। ক্রমান্বয়ে একই কাঁচামালে তৈরী হতে থাকে মোমদানি, এ্যাষ্ট্রে, ফুলদানি এবং পা-ঘষোনি (ঝামা)। বৈশাখের চাহিদা ছাড়াও ডিনার সেট, মোমদানি, এ্যাষ্ট্রে, ফুলদানি, কয়েলদানি, টি সেট, হুক্কা, ভর্তার বাটি, ল্যাম্পসেট, মাটির মালা, ব্রেসলেট, কানের দুলসহ আর্কষনীয় মাটির শোপিচ উৎপাদন করেন।
মাটির নানাসব তৈজসপত্রসহ এসব যাচ্ছে ইতালী, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য উন্নত দেশে। তিনিও জানান, বৈশাখে অতিরিক্ত অর্ডার থাকে। আধুনিক ডিজাইনের এসব মাটির পণ্য তৈলী করে অনেক পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে। সন্তানরা লেখাপড়া করছে। তবে প্রতিযোগিতার বাজারে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে আধুনিক যন্ত্রপাতি দরকার। এগুলো সংগ্রহ করতে অনেক টাকার দরকার। সরকার যদি এক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা করেন তবে এশিল্প দেশের অর্থিক খাতকে আরো শক্তিশালী করতে অবদান রাখতে পারবে বলে তিনি মনে করনে।