×

জাতীয়

ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পাঠদান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০১৯, ১২:৫৯ পিএম

ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পাঠদান
বরগুনার তালতলী উপজেলায় শ্রেণিকক্ষের ছাদের পলেস্তারা খসে শিশু মৃত্যুর ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সারা দেশের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, এমন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা আসা বন্ধ করে দিয়েছে। কোথাও আবার প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে চলছে ক্লাস। মাঝে মাঝেই পাঠদান অবস্থায় খসে পড়ছে পলেস্তারা। কোনো কোনো ভবন আবার পরিত্যক্ত ঘোষণার পর বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে বাঁশ-টিন দিয়ে অস্থায়ী শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। ঝড়-বৃষ্টিতে যা আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা নতুন ভবন নির্মাণের অপেক্ষায় আছেন। শিশু শিক্ষার্থীরা প্রতীক্ষা করছে কবে প্রাণের ঝুঁকি থেকে মুক্ত হবে তাদের শ্রেণিকক্ষ। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সূত্র মতে, সারা দেশের ৬৫ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠানেই নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। অনেক বিদ্যালয়ে নতুন নির্মাণকাজ চলমান। বাকি পুরনো অনেক প্রতিষ্ঠানই রয়েছে ভয়াবহ ঝুঁকিতে। যেসব ভবনের তথ্য সংগ্রহ করছেন কর্মকর্তারা, সেগুলোর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অনেক ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। আবার অনেক ভবন সংস্কার করে পাঠদান উপযোগী করা হচ্ছে। তবে সারা দেশের ঝুঁকিপূর্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পর্কিত সঠিক পরিসংখ্যান নেই সংশ্লিষ্টদের কাছেও। তালতলীর ছোটবগী ইউনিয়নের পি কে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষের ছাদের পলেস্তারা খসে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মানসুরা (৮) নিহত হওয়ার পর বিক্ষুব্ধ এলাকার অভিভাবকরা। তারা ঝুঁকিপূর্ণ ওই ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত করার দাবি তুলেছেন। শুধু তালতলীর পি কে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ই নয়, সারা দেশে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আছে। যেগুলো সম্পর্কে কোনো তথ্যই নেই শিক্ষা বিভাগের কাছে। প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই পাঠদান করা হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, দক্ষিণের জেলা বাগেরহাটের ৯ উপজেলায় যে ১১৬২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে তার মধ্যে ১৪১টি প্রতিষ্ঠানের ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। কিছু কিছু বিদ্যালয় ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলেও নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। শিক্ষকরা বিকল্প হিসেবে স্কুলের খেলার মাঠে বাঁশ দিয়ে টিনশেড তৈরি করে পাঠদান করছেন। শ্রেণিকক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় প্রতি বছরই এসব প্রতিষ্ঠান ছেড়ে আশপাশের স্কুলে চলে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তাই দ্রুত নতুন ভবন নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকদের অভিযোগ, জরাজীর্ণ ভবনে পাঠদান করা অবস্থায় অনেকবার পলেস্তারা খসে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এসব বিদ্যালয়ে পড়াতে চান না। অনেকে অন্যত্র চলে যায়। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার ভাষ্য, জরাজীর্ণ বিদ্যালয়গুলোতে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সরকারি অনুদানে ভবন নির্মাণ হয়নি এমন প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এ তালিকা ধরেই নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর ১০৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন দীর্ঘদিন ধরে জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সংস্কার না হওয়ায় কয়েকটি বিদ্যালয়ের ভবন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অনেক বিদ্যালয় ভবনের বিমে ফাটল, ছাদের পলেস্তারা খসে খসে ইট-বালু-সুরকি নিচে পড়ছে। কখনো কখনো শিক্ষার্থীদের আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। শিক্ষার্থীদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটাতে হয় ঝুঁকিতে। বিদ্যালয়গুলোতে নতুন ভবন থাকলেও পাশে থাকা জরাজীর্ণ ও পরিত্যক্ত ভবনগুলো যেন মরণফাঁদ। একই রকম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা রাঙ্গাবালী উপজেলার ছয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। এসব বিদ্যালয়ের পাশে থাকা পুরনো ভবনগুলো ১৯৭৭ সালে নির্মিত হয়েছে। যেগুলো মেরামত অযোগ্য এবং ব্যবহার অনুপযোগী ঘোষণা করা হয়েছে। জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলার ২নং উত্তর চণ্ডীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একমাত্র ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। নিরুপায় হয়ে পরিত্যক্ত একটি মসজিদে বিদ্যালয়ের পাঠদান করতে হয়। তবে সে মসজিদের অবস্থাও নাজুক। বৃষ্টির সময় টিনের ছাউনি দিয়ে পানি পড়ে। মাসখানেক ধরে ছাউনির উপরে পলিথিন দিয়ে কোনোরকম পাঠদান করা হয়। প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক সোহরাফ হোসেনের বক্তব্য, স্কুলের ভবনটি পাঠদানে অনুপযোগী বলে পরিত্যক্ত ঘোষণা করার পর ছাত্রছাত্রীদের পাঠদানের জন্য মসজিদের পরিত্যক্ত টিনের ছাউনিযুক্ত ঘর পাঠকক্ষ হিসেবে বেছে নেয়া হয়। এদিকে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ী ইউনিয়নের দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের দেয়াল ভেঙে পড়ায় কিছুদিন আগে ভবনগুলো সরকারিভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। নতুন ভবন নির্মাণ না করায় পুরনো জরাজীর্ণ টিনের ঘর, কখনো গাছতলা আবার কখনো বা খোলা আকাশের নিচে ক্লাস করছে শিক্ষার্থীরা। একই রকম চিত্র কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার ১৩৭নং খোশকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এ প্রতিষ্ঠাটি নির্মিত হয়েছে ১৯৭৩ সালে। অদ্যাবধি সংস্কার না করায় প্রতিদিন ছাদের সিলিং, বিম এবং দেয়াল থেকে খসে পড়ছে আস্তর, খোয়া, বালি ও পাথর কণা। যে কোনো সময় ভবনটি ধসে পড়তে পারে। শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা বলছেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসংখ্য স্কুল, কলেজ আর মাদ্রাসা আছে। সেগুলোর বেশির ভাগই ব্যক্তিপর্যায়ের অনুদান নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। কোথাও টিনের ছাউনি দিয়ে অস্থায়ীভাবে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ভবনের ছাউনি দিয়ে যেমন বৃষ্টির পানি পড়ে তেমনি সামান্য ঝড়েই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। এসব কারণে অল্প ঝড়-বৃষ্টিতেই শিক্ষার্থীদের ছুটি দিয়ে দিতে হয়। সরকার এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুঁজে ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন বিষয়ক প্রকল্পের সাবেক এক কর্মকর্তা জানান, সরকার সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে টেকসই ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি জরাজীর্ণ ভবন সংস্কারের কাজও চলছে। তবে ঠিক কী পরিমাণ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ সে বিষয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। এসব তথ্য সংগ্রহের জন্য জনবল বাড়ানো প্রয়োজন। জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, তালতলীর দুর্ঘটনার স্থান পি কে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য ছিল না। তবে দুর্ঘটনার পরই জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে চিঠি দেয়া হয়েছে ঘটনা খতিয়ে দেখার জন্য। এদিকে শ্রেণিকক্ষের ছাদের পলেস্তারা খসে শিশু মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল রবিবার হাইকোর্টে করা এক রিট আবেদনে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন জরিপ করার নির্দেশনাও চাওয়া হয়েছে। যাতে করে কোন ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ও কোনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ নয় তা যেন চিহ্নিত করা যায়। শুধু প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোই নয়, মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের অনেক ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। সেসব ভবন চিহ্নিত করে সংস্কারের কাজ যেমন করা হচ্ছে, তেমনি জরাজীর্ণ ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণও করা হচ্ছে। তথ্য মতে, সারা দেশে ৩২ হাজারেরও বেশি স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা রয়েছে। এর মধ্যে গত দশ বছরে ১৩ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। আগামী ২০২১ সালের মধ্যে ১০ হাজারের বেশি ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হবে। তবে মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ঠিক কতটি আছে তা নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হাতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতি পুরনো যেসব ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে সেগুলোর মধ্যে অর্ধেকের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। জানতে চাইলে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান মোহাম্মদ হানজালা ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের জানা মতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নেই। তবে জানার বাইরে যে নেই তা বলা যাবে না। সেসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App