×

মুক্তচিন্তা

চেতনাই পারে অপশক্তিকে পরাস্ত করতে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০১৯, ০৯:৫২ পিএম

একটি দেশ যদি উদারভাবে তার নিজস্ব সংস্কৃতিতে চলতে না পারে, তা হলে দেশটির স্বকীয়তা থাকে কী করে। নিরাপত্তা তো হবে নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাস রক্ষার মধ্য দিয়ে। অধিকার হরণ করে নিরাপত্তা বিধানের প্রচেষ্টা কিন্তু নিরাপত্তা প্রদানেরই এক ধরনের ব্যর্থতা, বুঝতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, চেতনার চেয়ে বড় অস্ত্র আর কিছুই নেই।

বাংলা বছরের প্রথমদিন পহেলা বৈশাখ। নতুন ও পুরনোকে একটি জায়গায় দাঁড় করিয়ে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কষে সম্ভাবনার পথ খুঁজে নেয়ার দিন। বাঙালি জীবনের এক মহাআনন্দ ও বাংলা সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। বাংলা সংস্কৃতির ঐতিহ্য তুলে ধরে বাঙালিপনায় আত্মনিমগ্ন হওয়ার দিন। বাঙালি সত্তায় বিশ্বাসীরা এ দিন বাংলা সাজে সেজে ওঠেন। গান গেয়ে ওঠেন। নেচে বেড়ান। মহামিলনের সুর সাধেন। প্রকৃতি তার সঙ্গে সুর বাঁধেন। এ দিনটি যেন প্রতিদিনের বাঙালি সত্তার শপথের দিন, প্রত্যয়ের দিন। তাই বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ বাংলা ও বাঙালিবোধে উজ্জীবিত হয়ে উঠতে চান, হয়ে ওঠেন। আগের থেকে প্রস্তুতি চলে।

আয়োজনের পরিকল্পনা হয়। পোশাক-আশাক, আহার, আলাপচারিতা, গল্প-কবিতা-উপন্যাস, বিনোদন, সখ্য, মত্ততা ইত্যাদি আচরণের প্রতি ভাঁজে আঁকা হয় বাঙালিপনার নিখুঁত কারুকাজ। বাঙালি জীবনের মহোৎসব এই পহেলা বৈশাখ। অথচ এই উৎসবকে দিনের পর দিন সেন্সর করে সংকুচিত করা হচ্ছে। দিন দিন ভিন্নধারার চিন্তা-ভাবনায় বাঙালিদের এই মহাউৎসবকে ক্ষুদ্র পরিসরে টেনে আনার পাঁয়তারা চলছে। যারা এই পাঁয়তারায় নিবেদিত, তারা ইতিহাস ভুলে যান। কিংবা স্বার্থের প্রয়োজনে ইতিহাসের গুরুত্ব দেন না।

বাংলা ভাষা মাতৃভাষার দাবি নিয়ে বাংলাদেশের স্বপ্নরচনার প্রথম শুরু। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন কেবল বাংলায় কথা বলতে পারা নয়, এ ভাষার ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতির ন্যায্য অধিকার, বাঙালি সংস্কৃতির কৃষ্টি, ঐতিহ্য, আচরণ, জীবনযাপন সবকিছু সুরক্ষিত হওয়ার প্রবল চাহিদা, বাসনা ছিল। চাহিদা এতটাই প্রবল ছিল যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালের মাত্র ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধে দেশটা স্বাধীন হয়েছিল। বাঙালি জাতি পেয়েছিল একটি ভৌগোলিক সীমা, একটি নিজস্ব পতাকা। বায়ান্ন ও একাত্তর আমাদের সত্তার সঙ্গে বহমান দুই চির সত্য। কেউ মানুক বা না মানুক, কেউ গুরুত্ব দিক বা না দিক, এটাই সত্য। আর এই সত্য চাইলে কেউ পারবেন না ধামাচাপা দিতে কিংবা এড়িয়ে যেতে। কারণ সত্য সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। এটা দৃশ্যমান হয় মানুষের বিবেকে। আর বিবেকের আঘাত কোনোকিছু দিয়েই প্রতিহত করা যায় না। বিবেকের আঘাতের ক্ষতটাও অনিরাময়যোগ্য। মরণ অনিবার্য।

কেন বলছি এসব কথা? হতাশায় বলছি। অভিমান, দুঃখ আর লজ্জায় বলছি। কারণ যে বাংলা আর বাঙালিপনার জন্য বাঙালি জাতির আত্মত্যাগ, সেই বাংলা ও বাঙালিপনার উৎসবকে সংকুচিত করার পাঁয়তারা নেহায়তই চরম ব্যর্থতা, উদাসীনতা, অবহেলা কিংবা ভিন্ন কোনো ভাবধারার গোষ্ঠীকে তুষ্ট করার এক ধরনের কৌশল। এ কথা আর গোপন করার সুযোগ নেই যে বাঙালি জাতির মহাউৎসব পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে অপ্রীতিকর, অপ্রত্যাশিত নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। অনেক প্রাণ ঝরেছে। অনেক মানুষ লাঞ্ছিত হয়েছেন। যার মধ্যে আছেন সাধারণ মানুষ ও নারী। কোন ক্ষমতাধর শ্রেণিগোষ্ঠী ও ক্ষমতাধর নারী এমন নৃশংসতা বা লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন, তেমন গল্প নেই, কাহিনী নেই। সবটাই সাধারণের গল্প, কাহিনী। এমন উৎসবে নৃশংসতার বন্দুক কখনোই ক্ষমতাবানদের দিকে তাক করা হয় না। না হওয়ার কারণ থাকে, যে কারণ শুধু তাদের ভেতর থাকে। অন্যরা বুঝলেও তাদের বুঝকে বেশিদূর এগোতে দেয় হয় না।

শৈশব থেকে তারুণ্য পর্যন্ত যে বৈশাখ দেখে এসেছি, জীবন সায়াহ্নে এসে সেই বৈশাখ খুঁজে পাই না। প্রকৃতির কোনো বদলে যাওয়া নেই, বদলে গেছে সামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতি, রাষ্ট্রের রীতিনীতি। এই বদলে যাওয়ার কারণ নাকি দেশ আর দেশের মানুষকে নিরাপত্তা দেয়া। যারা পহেলা বৈশাখ উৎসবকে নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা করেন, তাদের আচরণে, বয়ানে বাঙালি জাতির নিরাপত্তার কথাই উচ্চাতি হয়। অবশ্যই রাষ্ট্র তার দেশ আর দেশের মানুষের নিরাপত্তার কথা ভাববে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামগ্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু তাই বলে অধিকার হরণ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন! বাঙালিরা যতক্ষণ খুশি তার দেশে তার নিজস্ব উৎসব পালন করবেন, সাজগোজ করবেন, গান গাইবেন, নাচ করবেন, বাঁশি-বেহালা বাজাবেন, ভালোবাসা প্রকাশ করবেন। এটাই তো তার সাংবিধানিক অধিকার। এ আচার রীতি-নীতির ভেতর দিয়ে বাঙালির চেতনা, বাঙালির অধিকার দৃশ্যমান ও নিশ্চিত করার জন্যই তো আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমরা যদি রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য যুদ্ধ করি, প্রাণ দেই, বাংলা ভাষার জন্য গর্ববোধ করি, সারা বিশ্বে বাংলা ভাষা যদি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে থাকে, তাহলে কেন এই ভাষার দিনপঞ্জিকার বর্ষ শুরুকে বাংলাদেশিরা উদার চিত্তে বরণ করে নিতে পারব না? বাধাটাইবা কোথায়? নাকি এটা নিরাপত্তার দোহাই বা অজুহাতে বাঙালি জাতির এই বৃহৎ উৎসবকে সংকুচিত করে অন্য কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে সমন্বয় করে চলার প্রচেষ্টা? নাকি বাঙালি সত্তার বিরুদ্ধে সক্রিয় অপশক্তিকে প্রতিহত করার উপযুক্ত শক্তি, ক্ষমতা, বুদ্ধির কোনোটাই নেই বলে উৎসবকে ছোট করে এনে ব্যর্থতাকে আড়াল করে রাখা? একটা কিছু নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু যে কোনো কারণ দিয়েই এই অস্তিত্বমুখর উৎসবকে এককোণে ঠেসে রেখে স্বদেশ প্রীতির বিষয়টি রীতিমতো দুঃখজনক।

অনেকে ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে এই বর্ষবরণ উৎসবের সমালোচনা করেন। বিরুদ্ধাচরণ করেন। জানি না তাদের কারণে এই নিরাপত্তার প্রয়োজনবোধ কিনা সরকারের। যদি তাই হয়, তাহলে সরকারকে প্রশ্ন করতে হয়, প্রতিদিন যে হারে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন, সড়ক যেভাবে অনিরাপদ হয়ে পড়ছে, সেই অবস্থা থেকে মানুষকে নিরাপত্তা দিতে কী সড়কের কাঠামো, পরিধি, প্রশস্ততাকে ছোট করে আনা হবে, নাকি গণপরিবহনকে সড়ক থেকে উঠিয়ে দেয়ার কথা ভাবা হবে? নিশ্চয়ই সরকার তা করবে না, করেও না। কারণ সড়ক ও গণপরিবহন এ দুটি বিষয় জীবনযাপনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উন্নত জীবনধারার প্রয়োজনীয় দুটি বিষয়। এসব অগ্রাহ্য করলে, তুচ্ছ করলে জীবনধারার মান উন্নত হয় না, জীবন পেছন চলে যায়। তা হলে কোনো গোষ্ঠীর সমালোচনায়, হুমকিতে কেন বাঙালির ঐতিহ্যময় উৎসব পালনে বিধিনিষেধ আরোপ করা? সময় বেঁধে দেয়া? বাংলা ও বাঙালির শেকড় সংস্কৃতিকে বাধাগ্রস্ত করলে ফলাফল কী হতে পারে, কেন আমরা তা গভীরভাবে ভেবে দেখছি না, ভেবে শঙ্কিত হই। প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এর গভীর প্রভাব কী হতে পারে, কতটা অস্তিত্ব রক্ষায় যায়, তা ভেবে দেখা দরকার। আর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা দিয়ে অভিযান শুরু হলে বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির বিপক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে কেন জিরো টলারেন্স অভিযান শুরু হবে না, সেই প্রশ্ন কিন্তু রয়ে যায়। অবাক হই যখন দেখি যারা বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির বুদ্ধিওয়ালা, তাদের নির্লিপ্ততা দেখে। কোনো গভীর বিশ্লেষণ, ভাবনা নেই, পরামর্শ নেই।

নামকাওয়াস্তে বাংলাপ্রীতি তাদের। বরং রংবেরং কাপড় পরে তারা বেঁধে দেয়া রীতিতে দিবস উদযাপন করেন। ইলিশ কেনেন, পান্তা খান। ছবি তোলেন। বাঙালির চেতনার বয়ান দেন। এদের অনেকেই পহেলা বৈশাখের আধুনিক ভার্সনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। থার্টিফার্স্ট আর পহেলা বৈশাখের মধ্যে এরা কোনো পার্থক্য রাখেন না।

পরিশেষে বলি, একটি দেশ যদি উদারভাবে তার নিজস্ব সংস্কৃতিতে চলতে না পারে, তা হলে দেশটির স্বকীয়তা থাকে কী করে। নিরাপত্তা তো হবে নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাস রক্ষার মধ্য দিয়ে। অধিকার হরণ করে নিরাপত্তা বিধানের প্রচেষ্টা কিন্তু নিরাপত্তা প্রদানেরই এক ধরনের ব্যর্থতা, বুঝতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, চেতনার চেয়ে বড় অস্ত্র আর কিছুই নেই। চেতনাই পারে অপশক্তি বা শত্রুকে পরাস্ত করতে। করি না কেন চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে, রাখতে? নিশ্চয়ই পারি। এবং তা প্রকৃত দেশপ্রেম বোধের মধ্য দিয়েই পারা সম্ভব। সেই দৃষ্টিতে সরকার ও প্রতিটি বাঙালির কাছে অনুরোধ থাকবে, বাংলা ও বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় উৎসব পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হোক নির্বিঘ্নে পরিপূর্ণতায়!

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App