×

জাতীয়

নিয়ন্ত্রণহীন গ্যাস সিলিন্ডার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০১৯, ০৩:৪০ পিএম

নিয়ন্ত্রণহীন গ্যাস সিলিন্ডার
গত বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার রাজাখালী গ্রামের আবদুস ছাত্তারের বসতঘর সম্পূর্ণ ভস্মীভ‚ত হয়েছে। এ সময় সবাই বাড়ির বাইরে থাকায় হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এর আগে গত ৫ মার্চ রান্নার জন্য চুলা জ্বালাতে গিয়ে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মারাত্মকভাবে দগ্ধ (৪০ শতাংশ) হন বগুড়া শহরের নিশিন্দারা মধ্যপাড়ার গৃহবধূ সালেহা বেগম। ১৯ ফেব্রæয়ারি সকালে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার একটি গ্যাস সিলিন্ডারের গুদামে বিস্ফোরণে দগ্ধ হন সাতজন। তার আগে গত বছরের ১৬ নভেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার ধলপুরের একটি বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে তাহসান (৮) নামে এক শিশু নিহত হওয়ার পাশাপাশি আরো ছয়জন দগ্ধ হন। এভাবে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় একের পর এক গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ উঠেছে- মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার সরবরাহ এবং রক্ষণাবেক্ষণ, স্থানান্তর ও ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান না থাকার কারণেই দিন দিন গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা বাড়ছে। এ দিকে রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব জেলায় ফুটপাত ও মূল সড়কের পাশে অবাধে বিক্রি হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার। পথের পাশেই সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় এসব। এ ছাড়া বেশিরভাগ হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং টি-স্টলেই রাস্তার ওপর গ্যাস সিলিন্ডার রেখে ব্যবহার করা হয়। অসাবধানতার কারণে এ রকম একটি সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হলেই মারাত্মক হতাহতের ঘটনা ঘটে যেতে পারে। অভিযোগ রয়েছে, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই অবাধে গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ, বিক্রি ও ব্যবহার করা হচ্ছে। রাজধানীসহ সারা দেশেই একই অবস্থা। সারা দেশে কি পরিমাণ গ্যাস সিলিন্ডার রয়েছে, কতজন ব্যবসায়ী গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত- এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই বিস্ফোরক পরিদপ্তরের কাছে। গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করতে হলে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক হলেও অধিকাংশ দোকানের তা নেই। গ্যাস সিলিন্ডারের মজুদ রাখতে বা বিক্রি করতে হলে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক হলেও কেউ এই বিষয়টির তোয়াক্কা করে না। সিলিন্ডারের গায়ে লেখা থাকে না উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখও। মোট কথা, গ্যাস সিলিন্ডারের মান নিয়ন্ত্রণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহার বিধির ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর। ফলে অবাধে ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে মানহীন গ্যাস সিলিন্ডার। শুধু এ কারণেই সারা দেশে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলছে। ‘গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা-২০০৪’-এর ৬৯ ধারা অনুযায়ী একজন গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসায়ী লাইসেন্স ছাড়াই ১০টি গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার বিক্রির জন্য মজুদ রাখতে পারে। তবে একই ধারার ৭০ বিধি অনুযায়ী ওই ব্যবসায়ীকে সিলিন্ডার মজুদের জন্য অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামাদিও কাছাকাছি রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা আইনের উভয় ধারার অপব্যবহার করেই নিজেদের ইচ্ছেমতো গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি ও সরবরাহ করছে। অন্যদিকে ‘গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা ১৯৯১’ অনুযায়ী সিলিন্ডার বিক্রেতার প্রতিষ্ঠানের ঘরের ফ্লোর আধাপাকা হতে হবে এবং ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতার ছাড়পত্র থাকতে হবে। সিলিন্ডার রাখার সংরক্ষণাগারটি মজবুত ও ঝুঁকিমুক্ত হতে হবে। দুই চাকার যানে গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার বহন করা যাবে না। ৪১ বিধি অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বিনা লাইসেন্সে সিলিন্ডারে গ্যাস ভর্তি করতে পারবেন না, অথবা গ্যাসপূর্ণ কোনো সিলিন্ডার তার অধিকারে (মজুদ) রাখতে পারবেন না। কিন্তু বাস্তবে এসব নীতিমালা প্রয়োগ নেই বললেই চলে। গত সপ্তাহে রাজধানীর পশ্চিম পান্থপথের একটি রেস্টুরেন্টের সামনের ফুটপাতের ওপরই ৫টি বড় গ্যাস সিলিন্ডার দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা যায়। ব্যস্ততম এই ফুটপাতের ওপর দিয়ে শত শত পথচারী ও রাস্তা দিয়ে শত শত যানবাহন চলাচল করে। অথচ আইন অনুযায়ী এভাবে গ্যাস সিলিন্ডারের মজুদ রাখার কোনো নিয়ম নেই। মগবাজার মোড়ের ‘ভর্তা ভাত’ রেস্টুরেন্টের সামনের ফুটপাতের ওপরেও ৪টি গ্যাস সিলিন্ডারের মজুদ দেখা গেছে। টঙ্গি ডাইভারশন রোডের পূর্ব পাশে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে দেখা যায়, পিকআপ, মিনি ট্রাক ও ভ্যান গাড়ি এসে প্রধান সড়কের ওপরে থামছে। খালি সিলিন্ডার নামানোর পর গ্যাসপূর্ণ ছোট-বড় গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহের জন্য তোলা হচ্ছে। তবে সিলিন্ডারগুলো স্থানান্তরের সময় সামান্যতম যতেœর কোনো ছাপ দেখা যায়নি। এখানে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত নয়। রাজধানীর বাইরের জেলা-উপজেলাগুলোতে ট্রাক, অটো, নছিমন-করিমন, ভটভটি, ইজিবাই, বাইসাইকেল ও রিকশা ভ্যানের মাধ্যমে গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ ও স্থানান্তর করা হয়। মাটিতে গাড়ির একটি টায়ার ফেলে তার ওপর ট্রাক থেকে সিলিন্ডার ছুড়ে ফেলা হয়। এরপর বড় সিলিন্ডারগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে এবং ছোটগুলো টেনে নেয়া হয়। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলম বলেন, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়া কেউই গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবসা করতে পারে না। ডিলার ও সাব-ডিলারদের অবশ্যই লাইসেন্স নিতে হয়। তবে খুচরা ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে কিছুটা শিথিলতা রয়েছে। বর্তমান আইন বা বিধি অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া খুচরা ব্যবসায়ীরা ১০টি পর্যন্ত গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার সংরক্ষণে রেখে ব্যবসা করতে পারবে। ১০-এর অধিক সিলিন্ডার মজুদ রাখলে তাকেও লাইসেন্স নিতে হবে। তবে অনেকেই অবৈধভাবে সিলিন্ডারের ব্যবসা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের সত্যতা পেলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই। শামসুল আলম আরো বলেন, সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে অসচেতনতা রয়েছে। অনেকেই নিম্নমানের প্লাস্টিকের পাইপ ব্যবহার করে চুলার সঙ্গে সিলিন্ডারের সংযোগ দেয়। অনেকেই সিলিন্ডারের মুখ থেকে গ্যাস লিকেজ হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারে না। এ কারণেও অনেক সময় সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটে। তিনি জানান, সাধারণত সিলিন্ডার স্থানান্তরের সময় যতœ না নেয়ায় ঢাকনা বা চাবির প্যাঁচ নষ্ট হয়ে গেলে গ্যাস লিক করতে থাকে। আবার ব্যবহারের ফলে সিলিন্ডারের ঢাকনায় জং ধরে যায়। এগুলোই মূলত বাতিল সিলিন্ডার। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এগুলো বাতিল করে না। ফলে তাতে বিস্ফোরণ ঘটে। সিলিন্ডারের গায়ে এর উৎপাদন ও মেয়াদ শেষের তারিখ উল্লেখ থাকলে এবং পরিবহন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন হলে বিস্ফোরণের ঝুঁকি অনেক কমে যাবে বলে মনে করেন শামসুল আলম।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App