×

মুক্তচিন্তা

রাজনীতির সদরে-অন্দরে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০১৯, ০৮:৩৩ পিএম

আমরা রাজনীতিতে যে অবস্থা দেখছি, সব কিছুতে আওয়ামী লীগের যে একক প্রাধান্য বা আধিপত্য দেখছি, তাই যে বছরের পর বছর স্থায়ী হবে তা কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় না। রাজনীতিতে কখন কোনো ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাবে তার পূর্বাভাস দেয়ার মতো রাজনৈতিক আবহাওয়াবিদ কিংবা জ্যোতিষী আমাদের দেশে আছে বলে মনে হয় না। রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটবে সময়ের প্রয়োজনেই। সেটা কার হাত ধরে ঘটবে দেখার অপেক্ষা সেটাই।

হৃদয় খুঁড়ে কেউ বেদনা জাগাতে ভালোবাসে না। আমরা বেদনা জাগাতে না চাইলেও বেদনারা এসে আমাদের জাগিয়ে রাখছে। আমরা ভালো খবর বেশি পাই না, শুনি না। আমাদের চোখের সামনে এসে খারাপ খবর, দুঃখের খবর, বেদনার খবর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা কষ্ট পাই, দুঃখ পাই। বেদনা বোধ করি। আমাদের চোখ ভিজে আসে। আমাদের মন বিষণ্ন হয়ে পড়ে। সড়ক দুর্ঘটনার খবর, আগুনে পুড়ে মরার খবর, ধর্ষণের শিকার নারীর অসহায় কান্নার খবর আমাদের ভারাক্রান্ত করে। স্বস্তি কেড়ে নেয়, উৎকণ্ঠা বাড়ায়।

আমরা ভালো থাকব, ভালো মতো বাঁচব, আমরা আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন জাতি হিসেবে বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়াব। বিশ্বসম্প্রদায় মাথানত করে আমাদের অগ্রযাত্রা দেখবে আর বিস্মিত হবে। এটাই আমাদের স্বপ্ন, এটাই আমাদের আকাক্সক্ষা, চাওয়া-পাওয়া। কিন্তু সেটা হচ্ছে না।

আমরা উন্নতি করছি না, এগিয়ে যাচ্ছি না, তা নয়। আমাদের অর্থনীতি ভালো। আমাদের প্রবৃদ্ধি ভালো। ৪ এপ্রিল প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এত বড় আনন্দ সংবাদেও আমরা উচ্ছ্বাস-উল্লাস প্রকাশ করতে পারছি না। কেন? কারণ আমাদের রাজনীতি। একটি দেশ কেমন চলছে তা বোঝার জন্য সে দেশের রাজনীতির প্রতি নজর দিতে হয়। গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতি হলো সবকিছুর চালিকাশক্তি। রাজনীতির মাধ্যমেই দেশ পরিচালিত হয়, কৌশল প্রণয়ন করা হয়। প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশের রাজনীতি কি সঠিক ধারায় অগ্রসর হচ্ছে বা পথ চলছে? আমাদের রাজনীতিকে অনেকেই ভালো রাজনীতির মডেল বলে মানতে চান না।

আমাদের দেশে নির্বাচন হয়। কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় বলে মনে করা হয় না। নির্বাচন পরিচালনা করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। পাঁচ সদস্য নিয়ে আমাদের নির্বাচন কমিশন। কমিশনের একজন সদস্য প্রকাশ্যে যেসব কথা বলছেন তা থেকে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, দেশে আসলে নির্বাচনের নামে তামাশা চলছে। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার মনে করেন ‘জাতি এক গভীর খাদের দিকে অগ্রসরমান’।

উপজেলা নির্বাচনে ভোটারদের কম উপস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনবিমুখতা গণতন্ত্রের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নেয়ার নামান্তর। আমরা গণতন্ত্রের শোকযাত্রায় শামিল হতে চাই না। রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের বিষয়টি বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখা প্রয়োজন’।

৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে ওই নির্বাচন নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। সরকার এবং নির্বাচন কমিশন একাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর বললেও অন্যরা তা বলছেন না। বিএনপিসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণকরী বেশির ভাগ দলই নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। নির্বাচনে নানা ধরনের কারচুপির আশ্রয় নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং তার সমর্থক-সহযোগীদের বিপুলভাবে জিতিয়ে আনা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

আগের রাতেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়েছিল বলে বলা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের পক্ষে অস্বাভাবিক ভোট পড়ায় এখন এসব অভিযোগ অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে। কিন্তু নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনেও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো কোনো কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। সাধারণ ভোটারদের যারা ভোট দিতে পারেননি তারাও ক্ষুব্ধ হয়েছেন, প্রতিবাদী হননি। ভোট দেয়ার জন্য মানুষের মধ্যে প্রবল আগ্রহের বিষয়টিও লক্ষ করা যায়নি।

বিএনপি দায়সারাভাবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালানোতে মানুষ এটা ধরেই নিয়েছিল যে, বিএনপি জেতার জন্য ভোট করছে না। আওয়ামী লীগ জেতার জন্য ভোট করেছে এবং তার জন্য যা যা করা দরকার তারা তার সবই করেছে। আওয়ামী লীগ প্রশাসনকে ব্যবহার করে কি কি কৌশল নিতে পারে সে বিষয়ে কারো কোনো ধারণাও হয়তো ছিল না। নির্বাচন কমিশনও সবদিকে সমান নজর দিতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনে মাত্র আটটি আসন পেয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট হতচকিত হয়ে পড়ে। তারা অন্তত ৬০/৭০টি আসন পাবে বলে ধারণা করা হয়েছিল।

আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য যারা ভোট ম্যাকানিজম করেছে তারা কাঁচা কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত হলেও দেশের নির্বাচনী রাজনীতির বড় ক্ষতি করেছে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন। নির্বাচন ব্যবস্থায় যে একটি মারাত্মক ক্ষত তৈরি হয়েছে সেটা এখন আর গোপন করা যাচ্ছে না। কীভাবে এর নিরাময় হবে ভাবনার বিষয় এখন সেটাই।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দলই অংশগ্রহণ করেনি। ফলে ওই নির্বাচন ছিল একতরফা। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি তখন উঠেছিল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলো কিন্তু সুষ্ঠু হলো না। এই ধারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও অব্যাহত আছে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি নেয়নি। এটাও প্রায় একতরফা নির্বাচন। শতাধিক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বিনাভোটে জয়ী হয়েছেন। ভোট আমাদের দেশের মানুষের কাছে উৎসবের মতো। কিন্তু উপজেলা পরিষদের নির্বাচন হচ্ছে নিষ্প্রাণ পরিবেশে। ভোটার উপস্থিতি খুবই কম। তারপরও আছে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ। আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরার চেষ্টাও চলেছে। সব মিলিয়ে আমাদের দেশের নির্বাচনী রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকের মধ্যেই দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। কেউ বা হতাশ। এর শেষ কোথায়, পরিণতি কি?

সর্বোত্তম ব্যবস্থা না হলেও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের চেয়ে ভালো ব্যবস্থার হদিস পাওয়া যায়নি। সামরিক-বেসামরিক স্বৈরশাসনের চেয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই অধিক গ্রহণযোগ্য। নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি বড় উপাদান। নির্বাচনের মাধ্যমেই মানুষ তার পছন্দের ব্যক্তিদের বেছে নেন। সংখ্যাগরিষ্ঠরা সরকার গঠন করেন এবং সংখ্যায় যারা কম তারা বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকেন। আমাদের দেশে এমন অবস্থা হয়েছে যে সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য নেই।

সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কিছু দেশে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে আর প্রথাগতভাবে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচন ব্যবস্থায় নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশেও নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের সংকট দেখা যাচ্ছে। মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে প্রভাব-প্রলোভনমুক্ত থেকে ভোট দিতে পারার সুযোগ পাচ্ছেন না। কোন ব্যবস্থায় মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যাবে তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চললেও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তবে আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন যে সম্ভব নয়- এটা মনে হয় এখন অনেকেই মেনে নেবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায়ও হয়তো শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তবে আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোই বেশি বিতর্কিত হয়েছে।

এবার যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে আর মনে হয় না যে, ভবিষ্যতে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো দল নির্বাচনে অংশ নেবে। পরপর দুবার আওয়ামী লীগ কৌশলের খেলায় জিতে গেলেও পরের বার আর এই কৌশল কাজ দেবে বলে মনে হয় না। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ সংবিধানে নেই। সংবিধানে যা নেই আওয়ামী লীগ তা মানবে না। তাহলে কি হবে? সংবিধান সংশোধন করার পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হবে?

নির্বাচনের প্রশ্নটি যদিও এখনই সামনে নেই, তবু মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতি ঘুরপাক খাবে এই নির্বাচনী রাজনীতিকে কেন্দ্র করেই। ‘কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন’- এই কথা বলে বেশিদিন মানুষকে ভোটের অধিকার বঞ্চিত করে রাখা যাবে বলে মনে হয় না। দেশে যদি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি না থাকে, সুশাসন নিশ্চিত হয়, উন্নয়নের সুফল যদি মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে জমা না হয়, আয় বৈষম্য, ধন বৈষম্য যদি প্রকট না হয়, তাহলে হয়তো ভোট-গণতন্ত্র নিয়ে মানুষ মাথা না ঘামাতে পারে। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় কি এটা বলা যায় যে এই সমস্যাগুলো থাকবে না?

আমরা জানি যা চোখে দেখা যায় তাই সব নয়, তাই শেষ নয়। চোখের আওতার বাইরেও আরো অনেক কিছু থাকে। এখন আমরা রাজনীতিতে যে অবস্থা দেখছি, সব কিছুতে আওয়ামী লীগের যে একক প্রাধান্য বা আধিপত্য দেখছি, তাই যে বছরের পর বছর স্থায়ী হবে তা কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় না। রাজনীতিতে কখন কোনো ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাবে তার পূর্বাভাস দেয়ার মতো রাজনৈতিক আবহাওয়াবিদ কিংবা জ্যোতিষী আমাদের দেশে আছে বলে মনে হয় না। রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটবে সময়ের প্রয়োজনেই। সেটা কার হাত ধরে ঘটবে দেখার অপেক্ষা সেটাই।

বিভুরঞ্জন সরকার: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App