×

মুক্তচিন্তা

পাটের সুদিনের পথে শ্রমিক আন্দোলন কাম্য নয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০১৯, ০৮:৩৩ পিএম

পাট শিল্পে এ শ্রমিক অসন্তোষ যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। তবে পত্রপত্রিকাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে দেখা যায় শ্রমিকরা ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়েই আন্দোলন করছেন। তবে সরকারের তরফ থেকেও আন্তরিকতার কোনো অভাব দেখা যাচ্ছে না। তারাও ফান্ড প্রাপ্তি সাপেক্ষে শ্রমিকদের ৯ দফা আন্দোলনের প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল।

বর্তমান সরকার পাটকে বিশেষ কৃষিপণ্যের মর্যাদা দিয়ে এর গুরুত্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে চলেছে। সে জন্য পাট তার হারানো গৌরব আবার ফিরে পাচ্ছে। যদিও পাটের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে আমাদের প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশ থেকে পাট আমদানির ক্ষেত্রে অ্যান্টিড্যাম্পিং ট্যাক্স আরোপ করেছে।

তা ছাড়া বিভিন্ন সিনথেটিক পণ্যের অধিক্যের কারণে তা কিছুটা হোঁচট খেয়েছে। তারপরও ভালোই চলছিল এ পাট খাত। এর সঙ্গে জড়িত শিল্প, কলকারখানা, শ্রমিক-মালিক, সরকারি-বেসরকারি সব পক্ষ।

কিন্তু হঠাৎ করেই এর একটি ছন্দপতন লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প, চামড়া শিল্পের পাশাপাশি পাট শিল্পও একটি গুরুত্ব বহন করেছে। শুরু হয়ে গেছে শ্রমিক অসন্তোষ। যশোর-খুলনাসহ সারাদেশের কিছু কিছু জায়গায় ৯ দফা দাবিতে তারা আন্দোলন করছে।

অথচ নব্বইয়ের দশকে বিএনপি সরকারের বন্ধ করা পাটকলগুলোকে আস্তে আস্তে সীমিত আকারে যখন চালু শুরু করেছিল তখন বেকার শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে সামনে রেখে তা করেছিল। কিন্তু আমরা জানি পাটের বিভিন্ন চড়াই-উৎরাইয়ের কারণে এ শিল্প আর তারপর থেকে লাভের মুখ দেখতে পারেনি। তাই বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) এ কলকারখানাগুলো চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। তারা এ শিল্পের ক্রমাগত লোকসানের কারণে বছরে মাত্র পাঁচ থেকে সাত মাসের শ্রমিক মজুরি পরিশোধ করতে পারে।

তা ছাড়া সরকার কর্তৃক ২০১৫ সালে ঘোষিত পে-স্কেলও বাস্তবায়ন করতে পারছে বিজেএমসি। সেজন্যই এ শ্রমিক আন্দোলন। একটা সময় বাংলাদেশে পাটের জয়জয়কার অবস্থা ছিল। কিন্তু আশির দশকের পর থেকে পাটের বাজার আস্তে আস্তে কমতে থাকে। আর কমতে কমতে একসময় এমন অবস্থার মধ্যে এসে ঠেকেছিল যে, শুধু গরু বাঁধার দড়ি কিংবা পাটখড়ি ব্যবহারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামান্য কিছু পাট আবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের তৎপরতায় সেই পাটের সুদিন আবার ফিরতে শুরু করেছে।

সে সময় পাট ছিল বাংলাদেশের একমাত্র রপ্তানি পণ্য। তা ছাড়া দেশে বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত পাটের প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রায় ৮৭টি পাটকল ছিল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সেসব পাটকল জাতীয় স্বার্থে জাতীয়করণ করে দিয়েছিলেন। সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নারায়ণগঞ্জের আদমজী এবং সিরাজগঞ্জের কওমি পাটকল ছিল। কারণ নারায়ণগঞ্জ ছিল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদীবন্দর, যাকে প্রাচ্যের ডান্ডি বলা হতো। অন্যদিকে বাংলাদেশের সব জেলাতেই কমবেশি পাট উৎপাদন হলেও ময়মনসিংহ, রংপুর, সিরাজগঞ্জ ইত্যাদি জেলাতে প্রচুর পরিমাণে পাট ফসল উৎপাদিত হতো।

সে সময়টিতে পাট ব্যবসায়ীদের অনেক কদর ও নাম-ডাক ছিল। বাজারে বাজারে, ঘাটে ঘাটে পাটের হাট-বাজার, মহাল, আড়ত, গুদাম ইত্যাদিতে ভরপুর ছিল। পাট মৌসুমে কাঁচা পাটের গন্ধে প্রকৃতিতে এক অন্যরকম পরিবেশ বিরাজিত ছিল। সেসময় হাট-বাজার করার জন্য পাটের ব্যাগ ছিল ঐতিহ্য। প্রত্যেকের বাড়ির কর্তা হাট-বাজার করার জন্য সেই পাটের ব্যাগ নিয়ে বের হতেন। একটি পাটের তৈরি ব্যাগ দীর্ঘদিন ধরে সেই পরিবারের বাজার-সওদা করার কাজে ব্যবহার করতে দেখা গেছে।

কিন্তু এখন দিন পাল্টেছে। আর এ দিন পাল্টানো পাটের জন্য খারাপ সময় ডেকে এনেছে। একদিকে দিনে দিনে বিশ্ববাজারে পাটের বিকল্প তন্তু আবিষ্কৃত হয়েছে, অন্যদিকে সেসব কৃত্রিম তন্তু দামে পাটের তুলনায় অনেক সস্তা হওয়ায় অনায়াসে সেগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। সে জন্য কমতে থাকে পাটের গুরুত্ব ও দাম।

অন্যদিকে আমরা জানি, পাট ভেজানো এবং পচানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে পানির প্রয়োজন পড়ে। সঙ্গত কারণেই পাটের আবাদ করতে কৃষকরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে থাকেন। সেই সুযোগে কৃষি পরিক্রমায় ফসল চক্রে পাটের স্থান দখল করে নেয় অন্যান্য ফসল।

পাট একটি পরিবেশবান্ধব দ্রব্য। আমরা যদি পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে শুধু একটি দিকে তাকাই অনেক চিত্র পাওয়া যেতে পারে। সেটি হলো, পরিবেশবান্ধব ব্যাগ ব্যবহারের পরিবর্তে ক্ষতিকর পলিথিন ব্যবহার করা। কারণ দেখা গেছে পলিথিন এমন একটি জিনিস, যাকে যেভাবেই ব্যবহার করি না কেন তার ক্ষতি থেকে কোনোভাবেই বাঁচা সম্ভব নয়। কারণ পলিথিন ৩এমন একটি রাসায়নিক বস্তু, যা পচনশীল নয়। সেজন্য এর কোনো বিনাশ নেই।

এমনকি এটি পোড়ালেও দুর্গন্ধ হয়ে ধোঁয়া দিয়ে পরিবেশ নষ্ট করে দেয়। এটি যেখানে পড়ে থাকে সেখানেই থেকে কৃষি ফসলের জমিতে মাটির রস চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। বিভিন্ন খাল-বিল, নদী-নালা, ড্রেন, নর্দমা- সব জায়গায় পরিত্যক্ত পলিথিন জমে জমে পানি চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়ে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে থাকে।

সে জন্যই পলিথিনের বিকল্প হিসেবে শুধু বাংলাদেশে নয়, আমাদের প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশ ক্যারিং ব্যাগ হিসেবে পাটের তৈরি ব্যাগ অনায়াসে ব্যবহার করছে। আর যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে পাটের বিকল্প হিসেবে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হয়ে আসছিল, সে জন্য সময়ের দাবি ছিল পাট দিয়ে পলিথিন তৈরি করতে পারা।

ইতোমধ্যে সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এখন বাংলাদেশেই পাট দিয়ে পলিথিন তৈরি হচ্ছে। আস্তে আস্তে তা ব্যাপকতা লাভ করলে কৃত্রিম পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। কারণ পাটের তৈরি পলিথিন সহজেই মাটির সঙ্গে পচে গিয়ে মিশে যাবে। ফলে পরিবেশের ক্ষতি হবে না।

ঢাকাই মসলিন, সিল্কের শাড়ি কিংবা কাপড় যেমন নামে-ডাকে গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক পাটের তৈরি অনেক জিনিসপত্রও এখন দেশে-বিদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পাট দিয়ে এখন শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার, কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতোয়া, বাহারি ধরনের ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়াল মেট, আলপনা, দৃশ্যাবলি, নকশিকাঁথা, পাপোশ, জুতা, স্যান্ডেল, শিকা, দড়ি, সুতলি, দরজা-জানালার পর্দার কাপড়, গহনার বক্সসহ এমন কিছু নেই, যা পাট দিয়ে হয় না। প্রায় ১৩৭ ধরনের জিনিস পাট দিয়ে তৈরি হচ্ছে। এমনকি পাট দিয়ে এখন নানা রকম গহনাও তৈরি করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে পাটের গুরুত্ব বেড়ে এর বাজারমূল্য বাড়ার কারণে পণ্যটির সুদিন ফিরছে।

কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন উৎপাদন, চাহিদা, রপ্তানি, প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদির জন্য এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এক হিসাব মতে, দেশে বর্তমানে বেসরকারি পাটকলগুলো মোট চাহিদার ৬০ ভাগ পূরণ করে থাকে এবং সরকারি কলগুলো থেকে চাহিদা মিটে ৪০ ভাগ। আমাদের দেশের একটি সমস্যা সবসময়ই রহস্যময় হয়ে দেখা দেয়।

যেমনটি প্রায়ই অন্য উদীয়মান সম্ভাবনাময় রপ্তানি শিল্প যেমন গার্মেন্টস ও চামড়াসহ আরো কিছু শিল্পে দেখা দেয়, যা কোনো কোনো অবস্থাতেই কাম্য হতে পারে না। এবারে পাট শিল্পে এ শ্রমিক অসন্তোষ যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। তবে পত্রপত্রিকাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে দেখা যায় শ্রমিকরা ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়েই আন্দোলন করছেন। তবে সরকারের তরফ থেকেও আন্তরিকতার কোনো অভাব দেখা যাচ্ছে না। তারাও ফান্ড প্রাপ্তি সাপেক্ষে শ্রমিকদের ৯ দফা আন্দোলনের প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল।

তবে এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতামতে দেখা যায় যে, যেখানে বেসরকারি পাটকলে তেমন কোনো সমস্যা নেই সেখানে সরকারি কারখানাগুলোতে লোকসানের কারণেই এমনটি ঘটছে। আর সেজন্য প্রয়োজনে আস্তে আস্তে এ খাতের শ্রমিকদের বিশেষ সুবিধার আওতায় গোল্ডেন হ্যান্ডশেক প্রদান করে সে কলগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া।

সে ক্ষেত্রে বিজেএমসি শুধু রেগুলেটরি বডি হিসেবে কাজ করতে পারে। তাবে শ্রমিক আন্দোলনকে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির দিকে যাওয়ার আগেই তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। আশা করি, বর্তমান সরকারে এ খাতের বিশেষজ্ঞদের এমন প্রজ্ঞা রয়েছে।

ড. মো. হুমায়ুন কবীর: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App