×

জাতীয়

ডেমু এখন রেলের বোঝা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০১৯, ১২:১৮ পিএম

ডেমু এখন রেলের বোঝা
যাত্রীসেবার মান বাড়ানো এবং যানজট নিরসনের লক্ষ্যে ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে চীন থেকে কেনা ২০ সেট ডেমু (ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট) এখন রেলের কাছে শ্রেফ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এর অর্ধেক সেটই খারাপ হয়ে পড়ে আছে ওয়ার্কশপে। যা মেরামতের মতো প্রকৌশলী, অবকাঠামো ও যন্ত্রাংশ এ দেশে না থাকায় এসব ডেমু ট্রেন এখন জঞ্জালে পরিণত হওয়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র। অথচ এসব ডেমু পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে ব্যয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। প্রতি বছর শুধু এ ডেমু ট্রেন থেকেই রেলের লোকসান হচ্ছে প্রায় ২-আড়াই কোটি টাকা। মূলত চীনে তৈরি এসব ডেমু মেট্রোরেল বা চক্ররেল হিসেবে বিশ্বের অনেক দেশে ব্যবহৃত হয়। এটি বিদ্যুতে চলাচল করার জন্য উপযুক্ত হলেও বাংলাদেশে পাঠানো এ ২০ সেট ডেমু ডিজেল কিংবা বিদ্যুৎ যে কোনো শক্তিতে চলবে এমনভাবে তৈরি করে সরবরাহ করা হয়। এটি এতটাই অত্যাধুনিক যে, সম্পূর্ণ শীততাপ নিয়ন্ত্রিতভাবে এ ডেমু ট্রেন চলার কথা। আমাদের দেশের রেল অবকাঠামো উন্নত বিশ্বের মতো না হওয়ায় ডেমু ট্রেনগুলোর শীততাপ ব্যবস্থাপনা বাদ দিয়ে নরমাল ট্রেন হিসেবে এগুলো চালানো হচ্ছে। সে কারণে এর স্বয়ংক্রিয় দরজা বাদ দিয়ে তা ঝালাই করে নরমাল দরজায় বদলে ফেলা হয়। কাচের সম্পূর্ণ বন্ধ জানালা বাদ দিয়ে নরমাল জানালা তৈরি করে এটিকে নরমাল রেল কোচে রূপান্তরিত করা হয়। রেল নিজস্ব পদ্ধতিতে ডেমু ট্রেনে বৈদ্যুতিক পাখা লাগায় এবং বেশ কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন করেন। এ ট্রেনে ওঠার জন্য আলাদা করে প্লাটফর্ম তৈরি করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা না করে ডেমুর বগিতে লাগানো হয় সিঁড়ি, যা দিয়ে যাত্রীরা ওঠা-নামা করে। তারপরও পর্যাপ্ত দরজা-জানালা না থাকায় গরমের সময় ডেমুতে অতিরিক্ত গরম হয়ে পড়ে। নেই টয়লেট সুবিধা। যার ফলে যাত্রীরা অসুস্থ বোধ করেন। আবার প্রতি সেট ডেমুর দুদিকে ইঞ্জিন থাকায় একটি ইঞ্জিন বিকল হলেই পুরো সেটটি অকেজো হয়ে যায়। এসব কারণে ডেমুর যাত্রীও কমেছে অনেক। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমলাপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মধ্যে প্রথম ডেমু ট্রেনের উদ্বোধন করেন। এরপরে ঢাকা-জয়দেবপুরের (দূরত্ব ৩৪ কিলোমিটার), ঢাকা-টঙ্গী (২২ কিলোমিটার), জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ (৯০ কিলোমিটার), সিলেট-আখাউড়া (১৭৬ কিলোমিটার), ঢাকা-আখাউড়া (১২০ কিলোমিটার), চট্টগ্রাম-কুমিল্লা (১৫৫ কিলোমিটার), নোয়াখালী-লাকসাম (৪৮ কিলোমিটার), লাকসাম-চাঁদপুর (৪৯ কিলোমিটার), চট্টগ্রাম-নাজিরহাট (৩৭ কিলোমিটার), পার্বতীপুর-লালমনিরহাট (৭১ কিলোমিটার) এবং পার্বতীপুর-পঞ্চগড় (১৩২ কিলোমিটার) রুটে ২০ সেট ডেমু চলাচল শুরু করে। অথচ ডেমু স্বল্প দূরত্বে (সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার) চলাচলের উপযোগী একটি যান। কিন্তু অল্প কিছু দিনের মধ্যে অতিরিক্ত দূরত্ব, চলাচল অনুপযোগী রেললাইনসহ অবকাঠামোগত কিছু ত্রু টি থাকায় ডেমুর বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে থাকে। বর্তমানে ২০ সেটের মধ্যে ১০-১১ সেট ডেমুই খারাপ হয়ে পড়ে আছে। মূলত ইঞ্জিনের ওভারহোলিং না করায় ইঞ্জিনে গণ্ডগোল দেখা দেয় এবং কয়েকটি দুর্ঘটনায় পড়ায় এসব ট্রেন এখন রেলের বিভিন্ন ওয়াকর্শপে নষ্ট হচ্ছে। ডেমুর ইঞ্জিনের সমস্যা আদৌ সুরাহা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়েও দ্বন্দ্বে আছে রেলের মেকানিক্যাল বিভাগ। রেল সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের প্রচণ্ড আগ্রহের কারণেই এ ডেমু ট্রেনগুলো কেনার পর দেশে আসে। অনেকের আপত্তি তোয়াক্কা না করে তিনি তার প্রভাবে ডেমুগুলো চীনের তাংসাং রেলওয়ে ভেহিকেল কোম্পানির কাছ থেকে কেনেন। রেলের কর্মকর্তারা জানান, এ সময় রেলের ক্রয়সংক্রান্ত কমিটি আপত্তি তোলে, রেলের ইঞ্জিন-কোচসহ যে কোনো কেনাকাটার ক্ষেত্রে পরিবহন বিভাগের মতামত চাওয়ার নিয়ম থাকলেও ডেমুর ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। রেলের নথি থেকে জানা যায়, ৬৫৪ কোটি টাকা ডেমু প্রকল্প প্রথমে চীন থেকে ঋণের মাধ্যমে (যে দেশ টাকা দেবে সে দেশ থেকে কেনা) প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপর ২০১০ সালে রাজস্ব খাত থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিলে তা অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। কিন্তু রাজস্বের টাকায় এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অনীহা দেখায় পরিকল্পনা কমিশন। এরপর প্রকল্পটি অতি গুরুত্ব এবং যানজট নিরসনের সহায়ক হবে উল্লেখ করে তা রাজস্ব খাত থেকে বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ জানিয়ে ২০১০ সালে জুলাই মাসে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে আবারো পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়। ২০১১ সালে চীনের তাংসাং রেলওয়ে ভেহিকেল কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে ২০ সেট ডেমু ৪২৬ কোটি টাকায় কেনা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শুল্ক ও কর। প্রায় ৩০ জন কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ ও মাসাধিককালব্যাপী বিদেশ ভ্রমণ-ভাতা সবমিলিয়ে ডেমুর পেছনে খরচ হয় ৬৫৪ কোটি টাকা। পুরো টাকা খরচ করা হয় সরকারের রাজস্ব তহবিল থেকে। এ দিকে রেলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ডেমুতে রেলের লোকসানের বোঝা বাড়ছে। তার ওপরে ১০-১১ সেট ডেমু অচল। এই ট্রেনে যাত্রী পরিবহন করে গত পাঁচ বছরে রেলের আয় ১৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। আর খরচ ২৬ কোটি টাকা। প্রতি বছরে শুধু ডেমুতেই রেলের লোকসান হচ্ছে প্রায় দেড় থেকে ২ কোটি টাকা। রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, ডেমু ট্রেন খাতে রেল কর্তৃপক্ষের আয়ের চেয়ে লোকসানের পরিমাণ অনেক বেশি। বছরে ডেমু ট্রেন থেকে আয় হয় ৪ কোটি টাকা। ব্যয় হচ্ছে সাড়ে ৫ কোটি থেকে ৬ কোটি টাকা। ডেমু ট্রেনের ইঞ্জিনগুলো প্রতি ৫ বছর পরপর ওভারহোলিং (বড় ধরনের মেরামত) করতে হয়। কিন্তু চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলাচলকারী ডেমুগুলোর চলাচলের মেয়াদ ৫ বছর পার হয়ে গেছে। এসব ট্রেনের ইঞ্জিনের কোনো ধরনের ওভারহোলিং করা হয়নি। সে কারণে নষ্ট হওয়া ডেমু মেরামতের মতো যন্ত্রাংশ ও ইঞ্জিনিয়ার রেলের নেই। এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জানান, ডেমু মেরামত করার মতো রেলের অবকাঠামো নেই। তা ছাড়া এটির জন্য যে অত্যাধুনিক ওয়ার্কশপ লাগে এবং যন্ত্রাংশ লাগে তা না থাকায় ডেমু ট্রেনগুলোর ইঞ্জিন মেরামত করা যাচ্ছে না। যার ফলে রেলের সমস্যা হচ্ছে। এগুলো ওয়ার্কশপে পড়ে আছে। তবে ডেমু ট্রেনের অনেক নষ্ট হয়ে বিভিন্ন ওয়াকর্শপে পড়ে আছে তা স্বীকার করে রেলের উপমহাপরিচালক (অপারেশন) মিয়া জাহান ভোরের কাগজকে জানান, ডেমু ট্রেন এখন প্রায় অর্ধেক সেটই নষ্ট। এগুলো কমলাপুরসহ পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন ওয়ার্কশপে পড়ে আছে। আর ডেমু থেকে লোকসানের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, রেল একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, এখানে লাভ-লোকসান বড় কথা নয়। রেল সেবা দিতে পারছে কিনা তাই বড় কথা। তবে ডেমু ট্রেনগুলো এ দেশের জন্য উপযুক্ত ততটা ছিল না বলে জানান তিনি। রেলের যুগ্ম মহাপরিচালক (মেকানিক্যাল) মঞ্জুর উল আলম চৌধুরী জানান, ডেমুর ওভারহোলিং করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রেনগুলো মেরামতে বিশেষায়িত ডেমু ওয়ার্কশপ না থাকা এবং স্পেয়ার পার্টসের সংকটে দীর্ঘদিন ধরে অচল হয়ে থাকা ডেমু ট্রেন মেরামত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে আমরা নিজস্ব লোকবল ও টেকনোলজি ব্যবহার করে ডেমু মেরামতের চেষ্টা করছি। আশা করি এ বছরের মধ্যে এসব ট্রেন ঠিক হয়ে যাবে। তবে প্রতিটি ট্রেন মেরামতে কত টাকা খরচ হবে তা তিনি জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, প্রতিটি পার্টসই বিদেশ থেকে আনাতে হবে। সে কারণে খরচ কত হতে পারে তা এখন বলা সম্ভব নয়। রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে চলাচলকারী ট্রেনগুলোতে পাঁচ কোটি টাকারও কম দামে কেনা একটি এসি চেয়ার কোচ থেকে দৈনিক ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। যে টাকায় ডেমু কেনা হয়েছে, সেই টাকা দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে নতুন চার-পাঁচটি ট্রেন চালু করা যেত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App