×

মুক্তচিন্তা

নবায়নযোগ্য শক্তি বায়ু থেকে বিদ্যুৎ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০১৯, ১০:১০ পিএম

নবায়নযোগ্য শক্তি বায়ু থেকে বিদ্যুৎ
নবায়নযোগ্য শক্তি বায়ু থেকে বিদ্যুৎ

যতভাবেই বায়ুকল বানানো হোক না কেন, তা দিয়ে বায়ুশক্তির শতভাগ কাজে লাগানো সম্ভব নয়। বায়ুশক্তির অন্যতম গবেষক জার্মান পদার্থবিদ আলবার্ট বেটজের মতে, বায়ুশক্তির সর্বোচ্চ ৫৯.৩ শতাংশকে রূপান্তর করে বায়ুকলে কাজে লাগানো সম্ভব। বাংলাদেশেও বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।

সাধারণত সূর্য তাপের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভূপৃষ্ঠে পৌঁছে বায়ুপ্রবাহ বা বায়ুশক্তির সৃষ্টি করে। এই বায়ুশক্তির অবিশ্বাস্য রকমের সক্ষমতা রয়েছে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনে। বর্তমানে সমগ্র পৃথিবীতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহৃত হয় তার দশগুণ বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করা সম্ভব শুধু পৃথিবীর বায়ুবহুল অঞ্চলগুলোর বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে। কিন্তু যথাযথ প্রযুক্তি, দক্ষতা বা পর্যাপ্ত উদ্যোগের অভাবে বায়ুশক্তি থেকে এখনো পৃথিবীর মোট বিদ্যুৎ চাহিদার অতি সামান্য অংশ (০.১%) পূরণ হচ্ছে। তবে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুশক্তির ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমছে। পৃথিবীব্যাপী বায়ুশক্তির বহুবিধ সাধারণ ব্যবহার যেমন- কাপড় শুকানো, পালতোলা নৌকা ইত্যাদি কমপক্ষে ৫ হাজার বছর আগে শুরু হয়েছে। প্রাচীন আরব যুগে আধুনিক নগর ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনে বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চিন্তাভাবনা শুরু হয়। তারই প্রেক্ষাপটে আনুভূমিক তলের ওপর উলম্বঅক্ষের চারদিকে ঘূর্ণায়মান প্রথম বায়ুচালিত কলটি চালু হয় নবম শতাব্দীতে পূর্ব পার্সিয়ায়। ১৩০০ শতাব্দীতে এই বায়ুকল বা উইন্ডমিল সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে বায়ুকলের নতুন সংস্করণ হিসেবে দেখা যায় বৃহদাকার বায়ু টারবাইন, যা বায়ুশক্তির পথিকৃৎ চার্লস ফ্রান্সিস ব্রুশ ১৮৮৮ সালে আমেরিকায় নির্মাণ করেন।

১৯০০ সালে ডেনিস শিক্ষাবিদ পল-লা-চউর প্রথম বায়ুচালিত বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মাণ করেন। কয়লা ও তেলের ঘাটতি থাকায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ডেনমার্কের এফএল স্মিথ কোম্পানি ৬০-৭০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বায়ু টারবাইন নির্মাণ করে। তারও প্রায় ২৫ বছর পর ১৯৭০ সালে ডেনমার্কে ১২-১৫ মি. উচ্চতা ও ২০ মি. ব্যাসবিশিষ্ট ২০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বায়ুু টারবাইন নির্মিত হয়। তৎপরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে বিশ্বজুড়ে শক্তি সংকটের কারণে আবার বায়ুশক্তি নিয়ে ক্রমবর্ধমান আগ্রহের সৃষ্টি হয়, যা বহুলাংশে বিকাশ লাভ করে। বায়ুকল উলম্বঅক্ষের চারদিকে ঘূর্ণায়মান পাখা দ্বারা তৈরি হয়, যা বায়ুশক্তিকে ঘূর্ণনশক্তিতে রূপান্তরিত করে এবং এই ঘূর্ণনশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। সমুদ্রতীর, পাহাড়ি এলাকা কিংবা বাতাসের বেশি প্রবাহ রয়েছে এমন স্থানে বায়ুকল দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা যায়। প্রয়োজন এবং বাতাসের প্রাপ্যতার ওপর ভিত্তি করে বায়ুকলে দুই, তিন বা তারও অধিক পাখা বসানো যেতে পারে। আধুনিক বায়ুু টারবাইন সাধারণত ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০০ ফুট বা তার অধিক উচ্চতাসম্পন্ন বায়ুপ্রবাহ থেকে দ্রুত ঘূর্ণনের সুবিধা নিতে পারে। বায়ু যখন টারবাইনের ব্লেডের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন বায়ুুর গতিশক্তি ওই ব্লেডগুলোতে ঘূর্ণন তৈরি করে যেখানে ব্লেডগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত রোটর ঘূর্ণনের ফলে সক্রিয় হয়। রোটর জেনারেটরের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে ঘূর্ণনের দ্বারা বিদ্যুৎ তৈরি করে।

বাংলাদেশের ৩০টি আবহাওয়া স্টেশনের তথ্যানুসারে ১৯৮২ সালে একটি প্রারম্ভিক গবেষণায় দেখা যায়, শুধু চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় বায়ুুর গতি বায়ুু টারবাইন স্থাপনের উপযুক্ত। এরপর প্রথমবারের মতো ফেনীর মুহুরি বাঁধ এলাকায় একটি ০.৯০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পাইলট প্রকল্প বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যাত্রা শুরু করে, যা জাতীয় পাওয়ার গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত। বায়ু টারবাইন থেকে টেলিকম টাওয়ারে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রথম কাজ করে টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো প্রতিষ্ঠান ইডটকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড। ইডটকো ২০১৬-এর অক্টোবরে উপকূলীয় অঞ্চল টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ এবং কক্সবাজারে সফলভাবে দুটি বায়ু টারবাইন স্থাপন করে। পরিবেশবান্ধব বায়ু টারবাইন টেলিযোগাযোগ অবকাঠামোর জন্য বিদ্যুতের বিকল্প উৎস। এটি প্রথাগত উৎস থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুতের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত চাহিদা পূরণ করতে পারে, যা মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের বিদ্যুৎবিহীন অথবা অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ রয়েছে এমন সব স্থানে স্থাপনযোগ্য। প্রতিটি টারবাইন প্রতিদিন ১০ কিলোওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। বাতাসের গতি বৃদ্ধি পেলে বায়ু টারবাইনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের গতি আট গুণ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

কুতুবদিয়া উপজেলার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের তাবলারচর গ্রামের বেড়িবাঁধের পাশে বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০টি টারবাইন বা বায়ুকল দিয়ে দেশের প্রথম বায়ু-বিদ্যুৎ পাইলট প্রকল্প স্থাপন করা হয়। কিন্তু প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখার আগেই ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর গত ২০১৬ সালে প্রায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন আঙ্গিকে ২০টি টারবাইন দিয়ে বায়ু-বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনঃস্থাপন করা হয়। গত ২০১৭-এর ফেব্রুয়ারিতে ২ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এই বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্বোধনের মাধ্যমে শুরু হয় বিদুৎ সরবরাহ। এখন প্রায় ৮০০ পরিবার এই বায়ু-বিদ্যুতের সুবিধাভোগী। এ ছাড়া বায়ুপাম্পকে কাজে লাগিয়ে কুতুবদিয়ায় খাবার পানি এবং চট্টগ্রামে শস্য উৎপাদনে সেচের পানি উত্তোলনের প্রযুক্তি চালু আছে। সরকারও রিনিউঅ্যাবল এনার্জি বা নবায়নযোগ্য শক্তির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়েছে এবং রিনিউঅ্যাবল এনার্জি পলিসি বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নবায়নযোগ্য শক্তি বলতে মূলত সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি এবং পানিপ্রবাহের শক্তিকেই বোঝানো হয়। বায়ুশক্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে কোনো প্রকার দূষণ ছাড়াই যান্ত্রিকশক্তি বা বিদ্যুৎশক্তি তৈরি করা যেতে পারে, যা কোনো কার্বন নিঃসরণ করে না।

একেবারে ভেঙে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো প্রকার প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এর কার্যক্রম আটকে থাকে না। বায়ুশক্তি থেকে যান্ত্রিকশক্তি উৎপাদনের বহুল ব্যবহার দেখা যায় নেদারল্যান্ডসে যেখানে শস্য মাড়াই বা পানি সঞ্চালন পাম্পের কাজে বায়ুশক্তিকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়। বায়ু থেকে বিদ্যুৎশক্তি রূপান্তরে সুবিধাগুলো হলো- বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ব্যাপকহারে হ্রাস পায়, উপযুক্ত স্থানে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ জেনারেটরের চেয়ে কম হয়, ভূমি রক্ষা হয় এবং পরিবেশবান্ধব। প্রসঙ্গক্রমে, কিছু সীমাবদ্ধতাও এখানে রয়েছে যেমন- বাতাসের গতি সর্বদা পরিবর্তিত হয়, বায়ুশক্তির ব্যবহার ভৌগোলিক অবস্থান দ্বারা সীমাবদ্ধ, বায়ুশক্তির রূপান্তর দক্ষতা অপেক্ষাকৃত কম, বায়ুশক্তির ব্যবহারে খোলা এবং উঁচু স্থান প্রয়োজন হয়।

বাংলাদেশের জন্য বায়ুশক্তি ব্যবহারের একটি অপার দিগন্ত রয়েছে সমুগ্র উপকূলবর্তী ৭২৪ কি.মি. দীর্ঘ তটরেখায় এবং বঙ্গোপসাগরের ছোট দ্বীপগুলোতে। গ্রীষ্মকালে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মৃদুমন্দ বায়ু ও দক্ষিণ-পশ্চিম আয়নবায়ু নামে পরিচিত এক প্রকার শক্তিশালী নিয়ত বায়ু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবাহিত হয়। আবার শীতকালে উত্তর-পূর্ব আয়নবায়ু এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে মৃদুবায়ু প্রবাহিত হয়। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গ্রীষ্মকালে বায়ুপ্রবাহের বেগ শীতকালের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি হয়। বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের গবেষণা থেকে জানা যায়, উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে বায়ুপ্রবাহের গতিবেগ অনেক বেশি যদিও সেখানে সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত কম এবং মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত বেশি বায়ুবেগ পরিলক্ষিত হয়। বায়ুর গতিবেগের এই মৌসুমি চক্রের বাইরে একটি দৈনিক চক্রও দেখা যায়, যেখানে বিকেল বেলা সর্বাধিক এবং রাতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল বায়ুবেগ দৃষ্টিগোচর হয়।

নবায়নযোগ্য শক্তি সূর্যরশ্মির মতো বায়ুশক্তিও স্থানীয়ভাবে লভ্য এবং দেশের শক্তি সুরক্ষায় একটি বড় ভূমিকা নিতে পারে। আমাদের দেশে যেখানে বাতাসের গতিবেগ বেশি সেখানে বায়ুশক্তি কেন্দ্র স্থাপনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াটের বায়ুশক্তি কেন্দ্র কাজ করছে এবং তা প্রায় ২ লাখ মেগাওয়াটে উন্নীত করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। শক্তি সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন ধীরে ধীরে কয়লা ও তেল নির্ভরতা কমানো ও সহজলভ্য এবং নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস যেমন- সৌরশক্তি বা বায়ুশক্তির ওপর আরো বেশি নির্ভর করা। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যতভাবেই বায়ুকল বানানো হোক না কেন, তা দিয়ে বায়ুশক্তির শতভাগ কাজে লাগানো সম্ভব নয়। বায়ুশক্তির অন্যতম গবেষক জার্মান পদার্থবিদ আলবার্ট বেটজের মতে, বায়ুশক্তির সর্বোচ্চ ৫৯.৩ শতাংশকে রূপান্তর করে বায়ুকলে কাজে লাগানো সম্ভব। বাংলাদেশেও বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।

ড. এম এ ফারুখ : অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App