×

মুক্তচিন্তা

আমাদের সংশয়াকুল নাগরিক জীবন ও সংশ্লিষ্টদের সক্ষমতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০১৯, ১০:১১ পিএম

দুর্ঘটনা ক্বচিৎ ঘটে। সতর্কতার অভাব থাকলে দুর্ঘটনার হার ও পরিমাণ উভয়ই বৃদ্ধি পাবে, এটাই স্বাভাবিক। অতি সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া এসব দুর্ঘটনা তাহলে সতর্কতার অভাব থেকে ঘটছে না প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ঘটছে, সে প্রশ্নের চেয়েও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে দুর্ঘটনা মোকাবেলায় আমাদের সক্ষমতা নিয়ে।

দুর্ঘটনার ওপর কারো হাত নেই। তবে দুর্ঘটনার আড়ালে কখনো কোনো নাশকতা থাকলে তা ভিন্ন কথা। নাশকতা হলে সেখানে মানুষের হাত থাকে- সে হাতকে আমরা বলি কালো হাত। কিন্তু হাত সাদা না কালো তা নির্ণয়ে প্রয়োজন পড়ে অনেক রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষার, প্রয়োজন পড়ে নানা মাত্রিক তদন্তের। সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সব তদন্ত ও যাচাই-বাছাইয়ের পর কথিত কালো হাতের নাগাল হয়তো পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা কালো হাতের নাগাল না পাওয়ারই পক্ষে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা তদন্ত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত দুর্ঘটনা হিসেবেই অনেক বিপর্যয়কে শনাক্ত করা হয় এবং সাধারণকে যে কোনো দুর্ঘটনারূপ বিপর্যয়কে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত সেই কবিতার মতো ‘সামান্য ক্ষতি’টুকু মেনেই নিতে হয়। না মেনে কোনো উপায়ান্তরও থাকে না। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড থেকে বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড এখনো পর্যন্ত দুর্ঘটনা হিসেবেই চিহ্নিত। দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডও। এসবের পশ্চাতে এখনো তেমন কোনো কালো হাতের স্পর্শ অনুভূত হয়নি। হয়তো বাস্তবে এগুলোর সবক’টিই ছিল নিছক দুর্ঘটনা মাত্র! অতএব যবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সবার কাছে পরিষ্কার হবে নিশ্চয়ই যে, এসব দুর্ঘটনার পেছনে কোনো কালো হাত-টাত নেই। কিন্তু আমরা আর কত এরূপ অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনার শিকারে পরিণত হব? আর কত স্বজনের প্রাণ এমন নির্মম ও ভয়ঙ্করভাবে বিসর্জন দেব?

দুর্ঘটনা ক্বচিৎ ঘটে। সতর্কতার অভাব থাকলে দুর্ঘটনার হার ও পরিমাণ উভয়ই বৃদ্ধি পাবে, এটাই স্বাভাবিক। অতি সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া এসব দুর্ঘটনা তাহলে সতর্কতার অভাব থেকে ঘটছে না প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ঘটছে, সে প্রশ্নের চেয়েও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে দুর্ঘটনা মোকাবেলায় আমাদের সক্ষমতা নিয়ে। আরো স্পষ্ট করে বললে, দুর্ঘটনা চলাকালীন উদ্ধার তৎপরতায় ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণের সক্ষমতা নিয়ে। দুর্ঘটনা-সংঘটনকালীন পরিস্থিতি সামাল দেয়ায় আমাদের দক্ষতা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একের পর এক সংঘটিত এসব দুর্ঘটনা নগরে বসবাসে আমাদের নাগরিক জীবনযাপনকে ভীষণ রকমের সংশয় ও আতঙ্কের জন্ম দিয়ে চলেছে। এককথায় আমাদের সামগ্রিক চিন্তার জগতে একপ্রকার অনিশ্চয়তারও জন্ম দিয়েছে। এই অনিশ্চয়তা বহুতল আবাসিক ভবন থেকে শুরু করে বহুতল শপিংমল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। জীবন রক্ষাগার হিসেবে পরিচিত নামিদামি বহুতল হাসপাতালগুলোও আতঙ্ক ও আশঙ্কা থেকে আমাদের একেবারে মুক্ত রাখতে পারছে না। এর আগে বিভিন্ন হাসপাতালে অগ্নিসংযোগের ফলে সে সম্পর্কেও এক ধরনের নাভিশ্বাস দেশবাসীর মনে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় বসবাসকারী নাগরিকদের মনে গভীর দাগ কেটে আছে। অর্থাৎ যাকে বলে ‘প্রাণ হাতে’ নিয়ে আমরা বেঁচে আছি এবং এরূপ আতঙ্কের মধ্যেই আমাদের সাম্প্রতিকের নাগরিক জীবনযাপন- দিন গুজরান চলছে। বছরের এই শুষ্ক মৌসুমে অগ্নি দুর্ঘটনাজাত আতঙ্ক আমাদের প্রাণের অনিশ্চয়তাকে আরো বেশি মাত্রায় শঙ্কিত করেছে। তবে সব বিষয়ে আমাদের সতর্ক ও সচেতন অবস্থান দুর্ঘটনা থেকে কিছুটা মুক্ত রাখতে পারে আর বিভিন্ন সংস্থার পেশাদারি সক্ষমতা নিঃসন্দেহে প্রাণের বিনাশ ও পঙ্গুত্ববরণকেও হ্রাস করতে পারে।

অগ্নিকাণ্ডের পর আরেক প্রাকৃতিক শক্তির কাছে আমাদের হার মানতে হয়। সে হলো ঝড়ঝঞ্ঝা। বিশেষত কালবৈশাখী। চলতি মৌসুমে কালবৈশাখীর তাণ্ডবের কথাও আমাদের মাথায় ও মনে সব সময়ই রাখতে হবে। শুধু মনে রাখলেই আবার চলবে না। এরূপ তাৎক্ষণিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিছুটা প্রস্তুতিও আমাদের রাখতে হবে। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আবহাওয়ার পূর্বাভাস মোটামুটি অনেক আগেই টের পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা সেভাবে নিজেদের প্রস্তুত রাখি কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ভৌগোলিক কারণেই মার্চ থেকে মে পর্যন্ত যে কোনো সময় কালবৈশাখীর তাণ্ডবলীলা বয়ে যেতে পারে আমাদের দেশে। এ কেবল আবহাওয়াবিদই নয়, এ কথা যে কোনো সাধারণ মানুষই জানে। কিন্তু এ সম্পর্কিত প্রস্তুতি গ্রহণের বেলায় অনেকেই উদাসীন। এরূপ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদাসীনতাকে ক্ষমা করা গেলেও প্রাতিষ্ঠানিক উদাসীনতাকে কতটুকু ক্ষমা করা হবে কিংবা ক্ষমা করা উচিত উন্নয়নের অভিযাত্রায় সওয়ার হওয়া বাংলাদেশের, তাও ভেবে দেখার সময় এসেছে। এও ভেবে দেখার সময় এসেছে যে, ৭৪ কিলোমিটার বেগের ঝড়ের মাত্র এক মিনিটের তাণ্ডব যদি আমরা মোকাবেলা করতে না পারি, তবে আমাদের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বিরাট এক প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি হয়ে পড়ে না কি? মেনে নিলাম ৭৪ কিলোমিটার বেগের এক মিনিটের একটি ঝড়ে রাস্তার পাশে থাকা গাছপালা ভাঙবে, ভেঙে সেগুলো রাস্তার ওপর পড়বে। কোথাও বা সেগুলো বিদ্যুতের তারের ওপরও পড়তে পারে। কিন্তু সেজন্য নাগরিক জীবন আট থেকে দশ ঘণ্টার জন্য একেবারে থেমে যাবে কেন? ঝড়ের গতিবেগ সে ক্ষেত্রে শতাধিক কিলোমিটার হলে আমাদের জীবনযাপনের চিত্র কী হবে, তা ভাবতেও তো কষ্ট লাগে! এবং সে রকম না হওয়ারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তা হলে অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে, বিপর্যয় মোকাবেলায় আমাদের একদিকে প্রস্তুতি যেমন নেই অন্যদিকে আমাদের সক্ষমতাও তেমনি বিরাট প্রশ্নেরই মুখোমুখি।

নানা ক্ষেত্রেই আমাদের কর্মদক্ষতা ও সক্ষমতা বিভিন্ন রকমের আকার-আয়তনের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ায় নিয়মিত। কোনো প্রশ্ন ছোট, কোনো প্রশ্ন মাঝারি, কোনো প্রশ্নবা আবার আকার-আয়তনে বেশ বড়সড়। আমাদের নৈমিত্তিকের জীবনযাপনের অনুষঙ্গে সৃষ্ট নানা রকমের বিপর্যয় আমাদের বিভিন্ন আকার ও প্রকারের প্রশ্নেরই মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। আমরা কেবল ভুক্তভোগীর মতো সব অভিজ্ঞতাই হজম করি- হজম করে যেতে হয়। কোনো বিকল্প নেই, নেই কোনো উপায়ান্তরও। সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্পের দিকে তাকালেও সংশ্লিষ্ট মহলের কর্মদক্ষতা বা সক্ষমতার প্রশ্নচিহ্নিত অবয়বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হতে পারি। প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি, প্রকল্পের কর্মপরিকল্পনা বা বাস্তবায়নের গতি দেখে আমাদের হৃষ্টচিত্ত হওয়ার ফুরসত পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। প্রকল্পগুলোর ধীরগতি এবং নানা আনুপাতিক হারে উত্তরোত্তর বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রবণতা পৃথিবীর উন্নত বা উন্নত হতে চাওয়া কোনো রাষ্ট্রে নেই। এমনকি অগ্রগতির নানা সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়া অনেক দেশেও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের চেয়ে কঠোর আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ব্যত্যয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আছে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুযোগ। জনস্বার্থই সেসব রাষ্ট্রে সবচেয়ে অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়; অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে মানবিক বিষয়গুলোও।

আমাদের দেশ উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক শর্ত পূরণ করেছে। ২০২৪ সালে পরিপূর্ণভাবে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার জন্য নানা ক্ষেত্রেই ইতিবাচক কাজ করে যাচ্ছে। সে লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্নরূপ উন্নয়ন প্রকল্পও বাস্তবায়নের জন্য সক্রিয় আছে। কোনো কোনো উন্নয়ন প্রকল্পকে ‘মেগা প্রকল্প’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এসব অধিকাংশ প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতির সঙ্গে ব্যাপক বৈপরীত্যও দৃশ্যমান। অনেক প্রকল্পের দিকে তাকালে ‘সক্রিয়’ শব্দটি আপনাআপনিই যেনবা লজ্জা পায়। এ ক্ষেত্রে সাধারণ জ্ঞানে আমাদের তো ধরে নিতে বিকল্প থাকে না যে, হয় প্রকল্প প্রণয়নকারীদের কর্মদক্ষতা বা সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে অথবা বাস্তবায়নকারী সংস্থার কর্মীদের মধ্যে বর্ণিত কর্মদক্ষতা বা সক্ষমতার অভাব রয়েছে। এসব বিভিন্ন বিষয়ের অভাব ও দুর্বলতার কারণে অনেক প্রকল্পের ব্যয় এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় উভয়ই ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার কোনো বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প থেকে কেবল একের পর এক সৃষ্টি হয়ে চলেছে জনদুর্ভোগ। এই দুর্ভোগ চরম থেকে চরমতম মাত্রায় পর্যবসিত হচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এর রাশ কেউ টেনে ধরছে না। প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার দায়ে কেউ কখনো আইনি নজরদারির আওতায়ও আসছে বলে আমাদের সম্মুখে দৃশ্যমান হয়নি। উন্নয়নের সঙ্গে জনদুর্ভোগ প্রায় একই সূত্রে গাঁথা বলে অনেকে প্রচারের চেষ্টা করেন। তা সত্ত্বেও জনদুর্ভোগের একটা মাত্রা থাকা উচিত এবং এজন্য সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা দরকার। যদিও জনস্বার্থেই উন্নয়ন, তবু জনস্বার্থকে কখনো মানুষের মানবিক বিভিন্ন বিষয়ের বিপরীতে দাঁড় করানো যাবে না। শোনা যায় বটে, বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টির পেছনে কখনো কখনো কারো কারো কালো হাতও সক্রিয় থাকে। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট- ‘জনস্বার্থে’ যে কোনো কালো হাতকেই আইনি প্রক্রিয়ার অধীনে এনে উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং প্রকৃত জনস্বার্থে শাস্তিমূলক উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। বলাবাহুল্য, এ লক্ষ্যে আইন ও সুরক্ষা বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সক্ষমতার ওপরই এসব বিষয় নির্ভর করছে। উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ী অভিপ্রায়ে সবাইকেই সক্ষমতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে; এর কোনো বিকল্প নেই।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App