×

জাতীয়

আলোচনায় ‘প্যারোল’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০১৯, ১০:৫৩ এএম

আলোচনায় ‘প্যারোল’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জোর আলোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। তবে রাজপথের আন্দোলন বা আইনি প্রক্রিয়ায় নয়; বিএনপিপ্রধানের মুক্তি মিলবে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমেই। তাকে ‘উন্নত চিকিৎসার’ জন্য প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লন্ডনে পাঠানোর জন্য সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। তবে এ ব্যাপারে দেখে-শুনে-বুঝেই এগোচ্ছেন তারা। দরকষাকষি বা সমঝোতা যাই হোক না কেন এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দাও বাগিয়ে নিতে চান দলটির নীতি-নির্ধারকরা। সরকারও খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি ও লন্ডনে তার চিকিৎসার ব্যাপারে ইতিবাচক। খালেদা জিয়া নিজে রাজি না থাকলেও পরিবারের সদস্যদের কাছে এ মুহূর্তে খালেদা জিয়ার সুস্থ থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। তার পরিবারও চায় যে কোনো উপায়ে তার মুক্তি। এমন বাস্তবতায় দলের কয়েকজন নেতা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে একাধিক বৈঠকও হয়েছে। এর মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টার সঙ্গে। সেসব বৈঠকে যথেষ্ট অগ্রগতিও হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। ওই সূত্র জানায়, ১০ দিন আগে কারাগারে বিশেষ ব্যবস্থায় খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। সে সময় পুরনো ব্যথা ও বার্ধক্যজনিত সমস্যা ছাড়া আর বিশেষ কোনো মারাত্মক শারীরিক অসুস্থতা নেই বলে মেডিকেল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। খালেদা জিয়া ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে রিউমাটোয়েড আর্থাইট্রিস, ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিস মেলিটাস এবং গত পাঁচ ধরে হাইপারটেনশন, আয়রন স্বল্পতা ও অ্যানেমিয়ায় ভুগছিলেন। রিপোর্টেও এর বেশি কিছু ধরা পড়েনি। কিন্তু এরপরও গত কয়েক দিন ধরেই দলটির পক্ষ থেকে ব্রিফিং করে বলা হয়, ‘খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ’। তিনি খেতে পারছেন না, বমি করছেন, এই মূহর্তে তার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন এমনই দাবি করে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অসুস্থতার কারণে খালেদা জিয়ার জীবননাশের আশঙ্কাও প্রকাশ করেন। এমন অবস্থায় গত ৩১ মার্চ রবিবার রাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিবসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতা। বৈঠকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারে মধ্যস্থতা করার অনুরোধ জানান তারা। এর পরদিন গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে ১২টায় খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) এনে ভর্তি করা হয়। তবে বিএসএমএমইউয়ে চিকিৎসা নেবেন না বলে বারবার ফিরিয়ে দেয়ার পর হঠাৎ করে খালেদা জিয়া কেন হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধুতে আসতে রাজি হলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সূত্র জানায়, খালেদা জিয়াকে হাসপতালে আনার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ লোক দেখানো। মূলত যে কোনো উপায়ে মেডিকেল বোর্ডের মাধ্যমে বিদেশে পাঠাতে একটি সার্টিফিকেট নেয়ার চেষ্টা করা হবে। কয়েক দিন আগেও ইউনাইটেট ছাড়া চিকিৎসা করাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকা খালেদা জিয়া বেশ হাসিমুখে বিএসএমএমইউয়ে এসেছেন। খুব গুরুতর অসুস্থতার কোনো লক্ষণও দেখা যায়নি। কেবিনে এসে চিকিৎসকদের সঙ্গে ভালোভাবেই কথা বলেছেন। এর আগেও তাকে দুদফা বিএসএমএমইউয়ে আনা হয়েছিল; সে সময় তার চিকিৎসার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করা হয়েছিল। তখন তাকে একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিল এবং যত দ্রুত সম্ভব তাকে কারাগারে পাঠানোর একটা তাগিদ ছিল। কিন্তু এবার সে তাগিদ নেই। মেডিকেল বোর্ড তার সঙ্গে কথা বলেছে, তার সমস্যাগুলো শুনেছে। চিকিৎসকরা তাকে কিছু ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। আস্তে-ধীরে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা করা হবে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। যতদিন চিকিৎসা প্রয়োজন খালেদার সুস্থতা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেয়া ও তিনি যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন সে জন্যে হাসপাতালের চিকিৎসকরা যথাযথ চেষ্টা করবেন এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলও। এদিকে, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি অংশ চায় তাদের সাজাপ্রাপ্ত দলীয় প্রধানের মুক্তির জন্য রাজপথে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে। তাদের বিশ্বাস সারা দেশের নেতাকর্মীরা একত্রিত হয়ে দাবি আদায়ে সোচ্চার হলে সরকার তাকে চাপের মুখে মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। পাশাপাশি থাকবে আইনি লড়াইও। ওই অংশটি খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে সরকারের কাছে নতি স্বীকার করতে নারাজ। তারা মনে করছেন, দরকষাকষির মাধ্যমে খালেদা জিয়ার মুক্তি হলে রাজনৈতিকভাবে যত সুবিধাই আদায় করা যাক না কেন, সেটা শেষ পর্যন্ত আপসই। এতে খালেদা জিয়ার দীর্ঘদিন জিইয়ে রাখা ‘আপসহীন’ ভাবমূর্তি আর থাকবে না। এমন সিদ্ধান্ত দলে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তাই বিদেশে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে প্যারোল দিতে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক আগেই আভাস দেয়া হলেও বিএনপির ওই অংশটি তাতে সাড়া দেয়নি। বিএনপির অন্য নেতাদের সন্দেহ খালেদার মুক্তির ব্যাপারে সরকার প্রথম থেকেই যে কঠোর মনোভাব দেখিয়ে আসছে তাতে আন্দোলন ও আইনি প্রক্রিয়া, কোনোটাই কাজে আসবে না। এর চেয়ে রাজনীতি থেকে খালেদা জিয়ার অবসর নেয়াই ভালো। তার বয়স হয়েছে, অসুস্থতা এমন অবস্থায় জেলে পচে মরার চেয়ে বিদেশে গিয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকুন তিনি, দলে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হোক। সেই সূত্র ধরেই গত ১৫ মার্চ বিএনপির ২ নেতা কারগারে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে সুচিকিৎসার স্বার্থে প্যারোলের বিষয়ে কথা বলেন। তবে সে পর্যন্ত খালেদা জিয়া এমন প্রস্তাবে রাজি হননি। সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে সরকারের সঙ্গে যে দরকষাকষি চলছে, তাতে সরকারের পক্ষ থেকে মূল শর্ত হলো লন্ডনে নিয়ে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে প্যারোল দেয়া হলে একাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচিত বিএনপির ছয় এমপি শপথ নেবেন। বিএনপির নেতারাও এই শর্তে রাজি হয়েছেন। দরকষাকষি করে যতটা পারা যায় রাজনৈতিক সুবিধা তারা আদায় করে নেবেন সরকারের কাছ থেকে। খালেদা জিয়ার মুক্তির পাশাপাশি ২৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে করা ৯০ হাজার মামলা প্রত্যাহার ও স্বাভাবিক রাজনীতি করার নিশ্চয়তা চাইবেন তারা। নেতারা মনে করছেন, খালেদা জিয়া কারাগারের বাইরে থাকা মানে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বাড়তি অনুপ্রেরণা। দেশের বাইরে চিকিৎসা চললেও দলের নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত জানা সহজ হবে। ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুতে শক্ত কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি বিএনপি। ঘরোয়া সভা-সেমিনারে দলের নেতারা খালেদা জিয়ার মুক্তি ও পুনর্নির্বাচনের কথা বললেও মাঠের কর্মসূচিতে সাড়া পাচ্ছেন না। ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচনে অংশ নেয়া ও ভরাডুবির পর তৃণমূল নেতারা ক্ষোভে ফুঁসছেন। তাদের একটাই দাবি ক্ষমতা নয়, চেয়ারপারসনের মুক্তি। এক নেতা অন্য নেতার ব্যর্থতা তুলে ধরে সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন। দলীয় অনৈক্যের সুযোগে একহাত নিচ্ছেন সিনিয়র নেতাদের। খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুতে রাজপথে কর্মসূচি না থাকার কৈফিয়ত চাইছেন, অশোভন প্রশ্নও ছুড়ে দিচ্ছেন তারা। যার ফলে ব্রিবতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। তাই রাজপথে নামার সামর্থ্য ও বাস্তবতা নেই এমন বিবেচনা থেকেই সরকারের সঙ্গে সমঝোতাকেই দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তির পথ মনে করছেন তারা। দলীয় প্রধানের প্যারোলে মুক্তির চিন্তা করা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এটা একটা বিশেষ বিধান। যখন একজন মানুষ চরম অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তার চিকিৎসা দরকার। আর আইন অনুযায়ী আদালতে জামিন পেতে তার অনেক সময় লেগে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকার ইচ্ছা করলে তাকে প্যারোলে মুক্তি দিতে পারে। চিকিৎসার জন্য দিতে পারে। বিশেষ কারণেও দিতে পারে। সেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধিকার সংরক্ষণ করা আছে। যে কোনো সময়ের জন্য প্যারোল দিতে পারে। খালেদা জিয়ার প্যারোল চাইবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নীতি-নির্ধারকরা যদি তাকে পরামর্শ দেন, স্ট্যান্ডিং কমিটি যদি তাকে পরামর্শ দেয়, সে পরামর্শ অনুযায়ী তিনি প্যারোলে যাবেন কি যাবেন না, এটা সম্পূর্ণ তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। যেহেতু খালেদা জিয়া সাধারণ কোনো ব্যক্তি নন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, রাজনৈতিক অঙ্গনে জনপ্রিয় নেত্রী তার সিদ্ধান্ত অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। সূত্র জানায়, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর আলোচনা আওয়ামী লীগের মধ্যেও রয়েছে। চিকিৎসার জন্য তিনি বিদেশ যেতে চাইলে ক্ষমতাসীন দলটির কোনো আপত্তি থাকবে না। বরং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে তারা। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মনে করেন, খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানো দল ও সরকার উভয়ের জন্য স্বস্তির হবে। এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়ে আবেদন করা হলে সরকার বিবেচনা করে দেখবে। গত বছর ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বিএনপি চাইলে বিদেশে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, খালেদা জিয়ার সর্বোচ্চ চিকিৎসার জন্য কারা কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়েছে। এরপরও মেডিকেল বোর্ড যদি বিদেশে চিকিৎসার জন্য সুপারিশ করে, তাহলে অবশ্যই সরকার বিষয়টি বিবেচনা করবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App