×

মুক্তচিন্তা

পুরান ঢাকা- অভিজাত ঢাকায় শুধু নয় গোটা দেশেই এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০১৯, ০৮:৫৮ পিএম

বনানী ও গুলশানের অগ্নিকাণ্ড যে বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল তা হলো অভিজাত এলাকায়ও সুউচ্চ ভবন বা মার্কেট খুব একটা নিরাপদ নয়। সেগুলোতেও রয়েছে জীবনের মারাত্মক ঝুঁকি। এফ আর টাওয়ারের আগুন মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। কোনো মানুষেই ভাবতে পারেনি এসব টাওয়ার তাদের মরণফাঁদ হয়ে আছে। সেখানে রাজউকের আইন মেনে দালান করা হয়নি। ভেতরেও বিদ্যুৎ সংযোগসহ অন্যান্য সুবিধাদি খুব নড়বড় অবস্থায় চলে আসছে।

এতদিন ভাবা হতো যে, পুরান ঢাকার অলিগলি, বাড়িঘর, দোকানপাট, শিল্পকারখানা ইত্যাদি সব একাকার হয়ে আছে। সে কারণে যে কোনো মুহূর্তে আগুন লেগে গেলে নিমতলী, চকবাজার বা অন্যান্য ঘুপচি-ঘাপচিতে আগুনে সম্পদের হানি এবং মানুষের অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনা রোধ করা মোটেও সহজ কোনো কাজ হবে না। এরই মধ্যে সেখানে কর্তৃপক্ষ নানা ধরনের অভিযান পরিচালনা করে যেসব স্থাপনা পেয়েছে সেগুলো প্রায় সবকটিতেই অগ্নিকাণ্ড ঘটার সম্ভাবনা থাকার কথা বলা হয়েছে। এখানে বেশকিছু দাহ্য পদার্থের কারখানা, গুদাম এবং পণ্যসামগ্রী গোদামজাত করা নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। সরকারের শীর্ষ মহল থেকে এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান রয়েছে বলেও দেশবাসী আশস্ত হয়েছে। তাতে ধারণা করা হয়েছিল শত শত বছরের পুরান ঢাকা আসলেই এখন বসবাসের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। কেননা আবাসিক বাড়িঘর এবং রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের দোকান, কারখানা ইত্যাদি একসঙ্গে থাকার বিপদ যে কত ভয়াবহ হতে পারে তা নিমতলী ও চকবাজারের ঘটনা থেকে সবাই অনুমান করতে পেরেছে। সে কারণে চকবাজারের বাড়ির মালিক এবং দোকানের মালিকরা সরকারের নতুন এলাকায় নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগকে অনেকেই বাধা দিতে পারছিলেন না। কেননা যে কোনো মুহূর্তে বাড়ির মালিক বা দোকান মালিক-কর্মচারীরা দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন। আবার অনেক মালিক বুঝেশুনেই পুরান ঢাকায় নিজেদের প্রতিষ্ঠান থাকলেও নিজেরা অভিজাত এলাকায় ‘নিরাপদ’ ভেবে অবস্থান করছেন।

বনানী ও গুলশানের অগ্নিকাণ্ড যে বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল তা হলো অভিজাত এলাকায়ও সুউচ্চ ভবন বা মার্কেট খুব একটা নিরাপদ নয়। সেগুলোতেও রয়েছে জীবনের মারাত্মক ঝুঁকি। এফ আর টাওয়ারের আগুন মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। কোনো মানুষেই ভাবতে পারেনি এসব টাওয়ার তাদের মরণফাঁদ হয়ে আছে। সেখানে রাজউকের আইন মেনে দালান করা হয়নি। ভেতরেও বিদ্যুৎ সংযোগসহ অন্যান্য সুবিধাদি খুব নড়বড় অবস্থায় চলে আসছে। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র যেমন যথাযথভাবে স্থাপিত হয়নি একইভাবে ওপর থেকে মানুষের নিচে নামার সিঁড়িও যথাযথভাবে করা হয়নি। অথচ ২৩তলা এই ভবনের প্রতিটি তলায় নামিদামি প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে। যেগুলোতে অসংখ্য মানুষ চাকরি করছেন, কাজে যাওয়া-আসা করছেন, কিন্তু এমন ভবনে যে নিরাপত্তার সুযোগগুলো রাখাই হয়নি সেটি কে জানত? অথচ এই ভবনের মালিকরা ভবনটির প্রতি তলায় অফিস ভাড়া দিয়ে যে বিপুল অঙ্কের অর্থ আয় করেন তারা এত দায়সারা অবস্থায় দালানটিতে হাজার হাজার মানুষের অফিস করার ব্যবস্থা করেছেন, যা তাদের প্রত্যেকের জীবনকেই মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে রেখেছে। এরই প্রতিক্রিয়ার নমুনা আমরা গত বৃহস্পতিবার দেখেছি। নীরহ ২৬ জন মানুষ এখানে মারা গেছেন। আবার ৭০ জন আহত হলেন। যারা মারা গেলেন তাদের পরিবারগুলো এখন কতটা অসহায় হয়ে পড়েছে সেটি গণমাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের আহাজারি শুনে বুঝা গেল। তবুও কিছুটা সান্ত¦না এই যে, দমকল বাহিনী এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার উদ্ধার তৎপরতার কারণে অনেক মৃত্যুর মুখে থাকা মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা গেছে। দুর্ঘটনাটি দিনের বেলা ঘটায় হতাহতের সংখ্যাও কিছুটা কম হতে পেরেছে। কিন্তু যে বিষয়টি সবার ভাবনার সবটাই কেড়ে নিয়ে নিয়েছে তা হলো, এসব অভিজাত এলাকায় সুউচ্চ ইমারতগুলোতে এ ধরনের জীবনের ঝুঁকি রয়েই গেছে। পাশের বেশ কিছু টাওয়ার একই ধাঁচের। ফলে সেগুলোতেও বিল্ডিং কোড না মানা, রাজউক, অগ্নিনির্বাপণ সংস্থা, বিদ্যুৎ বিতরণের বিষয়গুলো প্রায় একইভাবে রয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মিডিয়া থেকে এও জানা গেছে, এফ আর টাওয়ারসহ পাশের অন্যান্য টাওয়ারেও ইতোপূর্বে বেশ কয়েকবার ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এর পরও মালিক পক্ষের বোধ হয়নি যে, তাদের এত মূল্যবান ইমারতটি মানুষের জন্য নিরাপদ করা দরকার। যদি কিছু ঘটে যায়, তা হলে তাদের তখন সবই যাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে তাদের করার কিছু থাকবে না। অবশেষে ২৮ তারিখের দুর্ঘটনার পর এফ আর টাওয়ারের মালিকরা এখন আইনের কাছে সোপর্দ হচ্ছেন। আশপাশে সুউচ্চ ইমারতগুলোরও একইভাবে সংস্কার জরুরি ভিত্তিতে করা দরকার। সেখানে যেসব প্রতিষ্ঠান অফিস গেড়ে আছে তাদের উচিত হবে এখনই ইমারতগুলোর সংস্কার সাধনের জন্য মালিক পক্ষকে বাধ্য করা।

বনানী এফ আর টাওয়ারে স্মৃতি জ্বলজ্বল অবস্থায় থাকার মধ্যেই অনতিদূরে গুলশান ১ ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লেগে প্রায় ২০০ দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাগ্যক্রমে কেউ মারা যাননি। তবে দোকানদারদের অনেকেই চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন। সেখানেও নানা অনিয়মে এই কাঁচাবাজারটি চলছিল। শুধু এফ আর টাওয়ার বা ডিএনসিসি মার্কেটটি নয়, নিয়ম না মেনে বহুতলবিশিষ্ট ইমারত, বিপণিবিতান, সুপার মার্কেট, কাঁচাবাজার, আবাসিক ভবন, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধরনের অফিস, বসতি যারা করছেন তাদের জীবনও অনেকটাই আগুনের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন। কেননা বেশিরভাগ ইমারতই বিল্ডিং কোড মেনে করা হয়নি। সেফটি সুযোগগুলো রাখা হয়নি। ফলে এসব সুউচ্চ দালান ভেতরে মৃত্যুফাঁদ নিয়েই অপেক্ষা করছে। অথচ এসব অভিজাত এলাকায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত লোকজন থাকেন। কিন্তু তাদেরও থাকা কিংবা ব্যবহারের জন্য যেসব ইমারত রয়েছে সেগুলোকে অনেকেই এতদিন নিরাপদ ভাবতেন। কিন্তু অনিয়মের রাজত্ব যখন পুরান ঢাকার মতোই অভিজাত এলাকাতেও যত্রতত্র রয়েছে সেখানেও বিপদের সমূহ সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। এ কারণেই আজ একটি ইমারতে আগুন লাগার খবরে যখন আমরা আতঙ্কিত হই, কালই দেখা যায় প্রায় একই রকম দুর্ঘটনা কোনো না কোনো আবাসিক এলাকায় ঘটেই চলছে। আমরা যেন অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। এখন শুধু ঢাকা শহরেই নয়, দেশের অন্যান্য শহরেও বাড়িঘর, অফিস, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র ইত্যাদি নির্মাণে আমাদের ধারণা ঢাকার চেয়েও নিয়ম ভঙ্গের চর্চা অনেক বেশি রয়েছে। সুতরাং সেসব শহরেও যে কোনো সময় যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। দু-একটা যে ঘটে না তা নয়। ঢাকার গণমাধ্যমে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই কেবল সেগুলো গুরুত্ব পায়। কিন্তু ছোটখাটো দুর্ঘটনা, প্রাণহানি কমবেশি সর্বত্রই ঘটছে।

অনেক উপজেলাতে এখন পাল্লা দিয়ে বাড়িঘরে বাণিজ্যিক স্থাপনা করা হচ্ছে। সেখানেও কেউই দেখভাল করার আছে বলে মনে হয় না। গ্রামাঞ্চলেও এখন উঁচু-নিচু ইমারত তৈরি করা হচ্ছে। মানুষের হাতে অতিরিক্ত টাকা আসার কারণে অনেকেই দালান করছেন। কিন্তু তারা এসব দালান করতে গিয়ে ইমারত কোডের কথা খুব একটা জানেন বলে মনে হয় না। ফলে এসব বাড়িঘর কখনো না কখনো মানুষের জীবনের জন্য বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে আসতে পারে। সে কারণেই এখন সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর উচিত হবে ঢাকা এবং এর বাইরের শহরগুলো এমনকি গ্রামে নির্মিত ইমারতগুলোতে কী কী সমস্যা রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়া। পাশাপাশি কোন কোন ইমারত অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলোকেও চিহ্নিত করা- যাতে অদূর ভবিষ্যতে এগুলোর মালিক স্বীয় দায়িত্বে মানুষের বসবাস, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি মানুষের জন্য নিরাপদ থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা নিতে পারে।

যে বিষয়টি গণমাধ্যমে এ ক’দিন বেশ নজরে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে তা হচ্ছে, আমাদের দেশে একশ্রেণির মানুষ অর্থের কাঙালের মতো আচরণ করছেন। তারা এসব প্রতিষ্ঠান ভাড়া দিয়ে যে বিপুল অর্থের মালিক হচ্ছেন তা থেকে বেশিরভাগ মালিকই বাড়িগুলোকে মানুষের বসবাস কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা নেয়ার মতো করে রাখার জন্য যে অর্থ নিয়মিত খরচ করা দরকার তা তারা করছেন না। অথচ কিছু অর্থ নিয়মিত ব্যয় করে ইমারতগুলোর মালিকরা মানুষের ব্যবহার উপযোগী করে রাখলে জীবন ঝুঁকিমুক্ত হয় এবং তাদের ইমারতগুলোও ভালোই থাকে। এখন যেসব সুউচ্চ টাওয়ার নানা অনিয়মে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো মানুষের মধ্যে যে ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে তা ভবনের মালিকদের লাগামহীন উপার্জনের রাশ টেনে দিতে পারে। এটি কি তাদের জন্য লাভজনক হবে। আমাদের বিশ্বাস মালিকরা হিসাব কষলে এতদিন যেভাবে লাভ করেছেন সামনের দিকে সেটি নাও ঘটতে পারে। মানুষ এখন এত প্রাণের বিনিময়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর কথা ভাবতে শুরু করেছে। সুতরাং সব ইমারতের মালিককে নিজ নিজ ইমারতকে কীভাবে সংস্কার করতে হবে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ কীভাবে ঘটিয়ে ব্যবসা করবেন, সেটি তাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। তারা যদি এভাবে ভাবেন, তাহলে দেশে নিমতলী, চকবাজার, বনানীর মতো হতাহতের ঘটনা ঘটবে না। মানুষের জীবন বাঁচবে, সম্পদ নষ্ট হবে না। সুতরাং আইন মেনেই জীবনকে অপেক্ষাকৃত নিরাপত্তা দেয়ার শিক্ষা নিতে হবে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত) ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App