×

মুক্তচিন্তা

শুধু বনানী পোড়েনি কপালও পুড়েছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০১৯, ০৮:৫১ পিএম

শুধু বনানী পোড়েনি কপালও পুড়েছে
শুধু বনানী পোড়েনি কপালও পুড়েছে

মানুষের জানের চেয়ে বড় আর কী আছে দুনিয়ায়? কিসের জন্য মুক্তিযুদ্ধ, কিসের জন্য দেশ স্বাধীন হয়েছিল? আজ আমরা একটি স্বাবলম্বী জাতি হিসেবে যখন পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে সামনে চলেছি তখন এই অশান্তি আর অনিরাপত্তা মানা কঠিন। কোথাও কিছু বিষয় ক্রমেই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ প্রবণতা বন্ধ করতেই হবে। মানুষ রাস্তায় মরছে। মানুষ ঘরে পুড়ছে। মানুষ চাকরি-ব্যবসা করতে গিয়ে ফিরতে পারছে না। এ অসহায়ত্বের দাবানল ভবনের আগুনের চেয়েও ভয়াবহ। কোনদিন তা জ্বলে ওঠে, সেটাই ভয়ের।

আমি যখন অস্ট্রেলিয়ার বড় বড় ব্যাংকগুলোতে কাজ করতাম, কিছু ট্রেনিং করা ছিল বাধ্যতামূলক। সেগুলো না করলে পদোন্নতি দূরে থাক চাকরি থাকারও নিশ্চয়তা ছিল না। তেমনি একটা ট্রেনিং ছিল ফায়ার ড্রিলিং। আমি তো অবাক আর ভয়ে থতমত খেয়ে গেছি। আমি আগুনের কী জানি? কীভাবে পাস করব আর কী বলব, কী উত্তর দেব। করতে গিয়ে যা জানলাম আর শিখলাম তার কোনো তুলনা হয় না।

ব্যাংকের চাকরির পর এখন করি পরীক্ষকের চাকরি। ছাত্রছাত্রী নিয়ে কাজ কারবার। সে চাকরিতেও দুই মাস আগে ফায়ার ট্রেনিং করতে হয়েছিল। এবার আবার দায়িত্ব বেশি। শীর্ষ জন জাপানে ছিলেন বলে আমাকেই মনোনীত করা হয়েছিল প্রধান হিসেবে। লাল, সবুজ, হলুদ কোন জার্সির কী ব্যবহার, কোন যন্ত্র কীভাবে চলে সব হাতেকলমে ট্রেনিং। এবং ব্যবহারিক দশতলা ভবন পুরো খালি করে মহড়া হলো নিচে নামার। সঠিক জায়গায় কীভাবে যেতে হবে, কী করতে হবে- এসব।

এমন না যে, এগুলো করতে হবে বলে করা। না করে দেখুন না। হাজার হাজার ডলার জরিমানা গুনতে হবে, সঙ্গে কারাবাসও বিচিত্র কিছু নয়। এই যে আপনারা উন্নতির জোয়ারের কথা বলছেন, তারা কি এই বিষয়টা নিশ্চিত করতে পেরেছেন? দেশের কোথাও কি এমন নিয়ম আছে? কেউ কি তা মানে আদৌ? জরিমানার বদল ঘুষ দেয়া সস্তার সমাজে এর বেশি আর কী হতে পারে? সবাই জানেন গলদ কোথায়। কিন্তু কেউ মুখ খোলেন না। মুখ খোলা নিষেধ কিনা জানি না। তবে মুখ খোলা নিরাপদও না। সেসব আঙুল ফুলে কলাগাছ ব্যবসা করেন তাদের নৈতিক মানদ- কী, সমাজ জানে।

এসব ভবন বা যেসব ব্যবসার কারণে আগুন এখন লেলিহান, সেগুলোর বিহিত করবে কে? কোনোটার কি সঠিক বিচার হয়েছে? সব কিছু প্রধানমন্ত্রীর কাঁধে চাপিয়ে সুখ নিদ্রা যাওয়া অনুচিত। তারপরও তাই ঘটছে। কোনো রাজনীতি নেই, যা পথ দেখাতে পারে। কে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে আসলে উন্নত সমাজে কী হয়। কীভাবে হয়। এই যে তারা নিত্যদিন নানা দেশে ঘুরে বেড়ান, তারা সব জানেন। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে সেসব বিষয় দেশে প্রয়োগ করা হয় না। অথচ উন্নত ডিজিটালের প্রমাণই হলো আধুনিকতা আর নিরাপত্তা।

আমি এ দেশে না এলে জানতামই না দমকল বাহিনীর মানুষরা কত বড় সেলিব্রেটি। এখানে তাদের বিভিন্ন সভায় অতিথি করে আনার পাশাপাশি তাদের বীরের মর্যাদা দেয়া হয়। বলা হয় ফায়ার ফাইটার। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট নিজেই ছিলেন একজন ফায়ার সার্ভিসের ফায়ার ফাইটার। সম্মান আর মর্যাদার ভেতর দিয়ে মানুষের মনে যে সম্ভ্রম আর কৌতূহল জাগিয়ে তোলা সেদিক থেকে আমাদের দেশে ফায়ার সার্ভিস কোনোকালেই সে জায়গা পায়নি। মনে করা হয় আগুন লাগলে তারা আসে আর নিজেদের কাজ করে।

একের পর এক অগ্নিকা- ঘটছে দেশে। ক’দিন আগে চকবাজারের যে আগুন তার আঁচ এখনো নেভেনি। তার ভেতরই ঘটে গেল আরেক দুর্ঘটনা। এটি কোনো ছোট ঘটনা নয়। ঢাকার অভিজাত এলাকা বনানী। সেখানে বসবাস করা, চাকরি করা মানেই তো জাতে ওঠা। দুই বছর আগে আমি ঢাকায় এই বনানীতেই আমার শ্যালকের বাসায় ছিলাম কয়েকদিন। শুক্রবার সকালে আমরা হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। যেদিকে চোখ রাখি খালি উঁচু উঁচু দালান। একটা দালানের সঙ্গে আরেকটা দালানের পার্থক্য কয়েক আঙুলের। কোথাও দম ফেলার জায়গা নেই।

আমি খুব বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছিলাম, এমন অপরিকল্পিত নগরী দুনিয়ার কোথাও দেখিনি। ভিয়েতনামও একটি ঘনবসতির দেশ। রাজধানী হ্যানয়ের চেয়েও বড় শহর হো চি মিন সিটি। এককালের সায়গন। সেখানে ভবনের অভাব নেই। কিন্তু এমন অপরিকল্পিত নয়। হংকংয়ে দেখেছি দালানের জন্য তিল ফেলারও জায়গা নেই। কিন্তু কোথাও অপরিকল্পনার ছাপ নেই।

কলকাতায়ও দেখবেন কোথাও একটা পরিকল্পনা বা শান্তির চাপ আছে। যেভাবে উন্নয়ন বা সামনে যাওয়া তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢাকা চলছে সর্বনাশের পথে। সমাজ অগ্রগতি বলতে কিছু নেই। নেই কোনো যান নিয়ন্ত্রণ। ক্রমেই বসবাস অযোগ্য হয়ে উঠছে রাজধানী। একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে মানুষ যখন পোড়া আলুর মতো হয়ে মরছে তখন আমরা কী দেখছি? এখনো দোষ চাপানো আর দায় অস্বীকারের সংস্কৃতি। রাজউক অনুমোদিত নকশায় ভবন হয়নি। এ কথা বা বিষয়টা এতদিন পর জানা গেল?

রাজউকের কি কোনো শাখা নেই, যারা এসব নিশ্চিত করে? কেন এই ভবন থেকে বের হওয়ার সঠিক সিঁড়ি নেই? এটা তো গ্রামের ভবন নয়। ঢাকা নামের কসমোপলিটন সিটির অভিজাত এলাকার ভবন। এখানে এই ফাঁকের জন্য কারা কারা ঘুষ খেয়েছিলেন আর ঘুষ দিয়েছিলেন তাদের নামগুলো কি জানা যাবে?

আর একটা কথা, ভবনের নকশার ঠিক নেই, সিঁড়ি ঠিক নেই, নিরাপত্তার ঠিক নেই, বের হওয়ার নিয়ম নেই- খালি বিদেশের অনুকরণে কিছু চমৎকার কাচ আর আলিশান ডেকোরেশন করলেই হয়ে গেল? একের পর এক আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া মানুষদের স্বজনরা একদিন কিন্তু ইট খুলে নেবে।

এই যে আপনারা মিডিয়ায় বাহাদুরি করে বলছেন, মানুষ কেন জড়ো হয়েছিল এর মানে কী? আপনারা তো সেদিনও কেউ কেউ গান-বাজনা করেছেন টিভিতে। সাধারণ মানুষ ছুটে গিয়েছিল ভালোবাসা আর অন্তরের টানে। তারা তাদের স্বজনদের জন্য গিয়েছিল। বিকৃত উচ্চারণে বনানী থেকে অমুক বলছি, তমুক বলছি, আমাদের সঙ্গে থাকুন বলার জন্য যায়নি।

আর তাদের এক বিরাট অংশ কীভাবে সাহায্য করেছিল তা একটি বালকের ছবিতেই স্পষ্ট। যে ভাঙা পাইপটি ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল পানির স্রোত ঠিক রাখার। তার কাছ থেকেই শিখতে হবে দেশ ও জাতিকে। আজ সত্যি দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে মানুষের। এভাবে কি চলতে পারে? মানুষের জানের চেয়ে বড় আর কী আছে দুনিয়ায়? কিসের জন্য মুক্তিযুদ্ধ, কিসের জন্য দেশ স্বাধীন হয়েছিল? আজ আমরা একটি স্বাবলম্বী জাতি হিসেবে যখন পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে সামনে চলেছি তখন এই অশান্তি আর অনিরাপত্তা মানা কঠিন। কোথাও কিছু বিষয় ক্রমেই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।

এ প্রবণতা বন্ধ করতেই হবে। মানুষ রাস্তায় মরছে। মানুষ ঘরে পুড়ছে। মানুষ চাকরি-ব্যবসা করতে গিয়ে ফিরতে পারছে না। এ অসহায়ত্বের দাবানল ভবনের আগুনের চেয়েও ভয়াবহ। কোনদিন তা জ্বলে ওঠে, সেটাই ভয়ের।

মুখে বড় বড় কথা আর কাজের বেলায় ঠনঠনে রাজনীতি কি পারবে আগুন থেকে বাঁচাতে? অগ্নিদগ্ধ মানুষের আত্মার অভিশাপ কখন কোথায় লেগে যায় কে জানে?

অজয় দাশগুপ্ত: কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App